মামাকে দেখতে যাওয়া-(পর্ব-১৫)

শামীম চৌধুরী ২১ আগস্ট ২০২০, শুক্রবার, ০২:৩৯:৪৮অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৯ মন্তব্য

আগের পর্বের লিঙ্ক এখানে- মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৪)

পর্ব-১৫

বেশ কয়েক প্রজাতির পাখির ছবি তুলে আমরা ৫ নাম্বার জোন শেষ করলাম। দুপুরের আহারের জন্য বনের ভিতর কেন্টিনে গেলাম। আমাদের ট্যুর অপারেটর সুজিত বেরা নুডুলস,পরেটা, ভাজি, কমলা লেবু ও ফলের জুস পাঠালো। সেগুলি দিয়েই আহারটা শেষ করি।পরে মনের মাধুরী মিশিয়ে এক কাপ চা-পান করে ৪ নাম্বার জোনের উদ্দেশ্যে রিক্সায় উঠলাম। ভোর ছয়টা থেকে একটানা পাখির ছবি তুলে যাচ্ছি। শরীরে বিন্দুমাত্র ক্লান্তির রেশ নেই। যতই বনে ঘুরছি ততই নতুন নতুন পাখির দেখা মিলছে। আগের তোলা পাখির ভাল ছবিও বোনাস হিসেবে পাচ্ছি। সবকিছু মিলিয়ে খুশীতে আমাদের মন চাঙ্গা। সব পরিশ্রম ভুলিয়ে দিচ্ছি ভাল ভাল পাখির ছবিগুলি। ফটোগ্রাফারের স্বার্থকতা এখানেই। দিনের শেষে যখন দেখতে পায় নিজে ক্যামেরায় ২/১টি ভাল ছবি ফ্রেম বন্দী করেছে তখন পরিশ্রম ও কষ্টের কথা ভুলে যায়।

 
সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে আস্তে আস্তে হেলে পড়ছে। তখন সময় দুুপুর ২ টা। ছবি তোলার জন্য হাতে আরো সাড়ে ৪ ঘন্টা আলো পাবো। ততক্ষনে আমরা ৪ নাম্বার জোনটা শেষ করতে পারবো। এই জোনটা মূলতঃ তিনটি জলাশয়ের মিলন স্থল। এখানেও বেশ কিছু জলজ পাখি পাওয়া দেখা গেল। এরই মধ্যে ভারতীয় কয়েকজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি জেনে তাঁরা খুবই আশ্চর্য্য হলো। কারনঃ এত দূর থেকে আমরা কেওলাদেও বনে এসেছি দেখে। অথচ তারা দিল্লীতে থেকেও আসার সুযোগ পায় না এমনটিই বললো। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তাদের সঙ্গে সেলফি তুললাম। অক্ষয় ভাগ্যত নামকরা একজন ভারতীয় ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। তার সঙ্গে আমাদের সবার পরিচয় হওয়ায় খুশী হলাম। অক্ষতের সহধর্মিনী আমাদের জানালো ৫ নাম্বার জোনের মূল রাস্তার বাঁ দিকে শাখা রাস্তায় তারা White Pelican বা সাদা-গগনবেড়ার ছবি তুলেছে। আমি খুব একটা আগ্রহ দেখালাম না। কারন ফ্লেমিংঙ্গোর জন্য বেশ সময় নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া আমরা আরো একদিন ভরতপুরে থাকবো ও বনে ছবি তোলার সুযোগ পাবো। তাই অক্ষয়ের মিসেসের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ৪ নাম্বার জোনে মনোনিবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ম্যাপে দেখা গেল ৪ নাম্বার জোনের শেষ মাথায় মাটির রাস্তাটি উত্তর দিকে চলে ৫ নাম্বার জোনের শাঁখা রাস্তার দিকে বাঁক খেয়েছে। তাতে স্পষ্ট ধারনা করলাম ৪ নাম্বার জোনের শেষ মাথা থেকেই পেলিকেনের ভাল ছবি পাওয়া যাবে। আমার সতীর্থরা তখনই পেলিকেনের ছবির জন্য ৫ নাম্বার জোনে যেতে বললে আমি তাদেরকে ধমকের সুরে না করি। তাদের বুঝাতে সক্ষম হই পেলিকেনের জন্য উল্টো হাঁটার চেয়ে এখানে পাখির দিকে মনোনিবেশ দিলে ভাল ফল পাবো।
কিসমত খোন্দকার ভাই সহ ভারতীয় ফটোগ্রাফার বন্ধুদের সঙ্গে আমি।
যেহেতু পেলিকেন এই বনে পরিযায়ী হয়ে এসেছে তাই এরা বনেই থাকবে। তার কারনও ব্যাখ্যা করলাম। তাঁরা সন্তুষ্ট হয়ে আর কোন কথা না বাড়িয়ে আমার সঙ্গে রওনা হলো। ৪ নাম্বার জোনটা বনের মধ্যখানে হওয়ায় পুরা বনটি দেখে নেবার বেশ সুযোগ রয়েছে। এই জোনের পশ্চিম দিকের শেষ প্রান্তে ভরতপুর জেলার দিঘুলী গ্রাম। গ্রামের সুন্দর সুন্দর ঘর বাড়ি নজর কেঁড়ে নিলো। গ্রাম ও বনটিকে বিভক্ত করে রেখেছে একটি মাত্র বিল। গ্রামের লোকজনদের বনের ভিতর প্রবেশ নিষেধ। তাঁদের বাঁধা দেবার জন্য তেমন কোন কাঁটাতারের বেড়া ও প্রহরী নেই। সরকার নিষেধ করেছে ও বনটি পাখির অভয়ারণ্য বলে তাঁরা নিজ থেকেই বনের ভিতর প্রবেশ করে না। আর এই অঞ্চলের সব মানুষ নিরামিষভোজী। তাই বিলে মাছ ধরার কোন আগ্রহ নেই। এমনটাই জানালো গাইড জীতেন।
 
এখানে যে জলজ হাঁস জাতীয় পাখিটি পেয়ে গেলাম তা বহুবার চেষ্টা করেও দেশে ছবি তুলতে পারিনি। Red-Crested Pochard বা রাঙ্গামুড়ি বা মৌলভী হাঁস । আমাদের দেশে এই হাঁস জাতীয় পাখির আঞ্চলিক নাম মৌলভী হাঁস। আমাদের কাছে। মৌলভী হাঁস নামেই পরিচিত। পুরুষ পাখির মাথায় যে ঝুটি উঁচু হয়ে থাকে সেটা দেখতে অনেকটাই টুপির মতন। তাই গ্রামাঞ্চলে মৌলভী হাঁস নামেই ডাকে। বাংলাদেশে টাঙ্গুয়া হাওড়ে ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার রোহনপুরের বিলে প্রতি বছর মৌলভী হাঁস পরিযায়ী হয়ে আসে। সংখ্যায় কমও না। প্রায় ১৫০-২০০ এর মতন ঝাঁকে দেখা যায়। কিন্তু এরা বিলের মাঝ খানে থাকে। আর বিলে নৌকা ছাড়া চলার কোন উপায় নাই। তাই নৌকা নিয়ে সামনের দিকে আগালেই উড়ে যায়। ভাল মানের ছবি পাওয়া যায় না। তবে আমি দুবার এ পাখির জন্য রোহনপুর যাই। কোনবারই ভাল ছবি পাইনি। সংগ্রহে আছে ব্যাস্ এতটুকুই সান্তনা। তাই মনের ভিতর তেমনটা আশা কাজ করতো না। অথচ এই বনের বিলে খুব কাছে পেয়ে গেলাম। মনের মতন শ’খানে ছবি তুললাম। যা ছিলো আমার কাছে সবচেয়ে বড় একটি প্রাপ্তি ও আনন্দের।
Red-Crested Pochard বা রাঙ্গামুড়ি বা মৌলভী হাঁস

রাঙ্গামুড়ি হাঁসের বৈজ্ঞানিক নাম: Netta rufina বা মৌলভী হাঁস। এরা Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Netta (নেটা) গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রজাতির ডুবুরি হাঁস। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। রাঙ্গামুড়ির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ লাল হাঁস। সারা পৃথিবীতে এক বিশাল এলাকা জুড়ে এরা বিস্তৃত, প্রায় ৩০ লক্ষ ৬০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এদের আবাস।বিগত কয়েক দশক ধরে এদের সংখ্যা অপরিবর্তিত রয়েছে, আশঙ্কাজনক পর্যায়ে যেয়ে পৌঁছেনি। সেকারণে আই. ইউ. সি. এন. এই প্রজাতিটিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত বলে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

এরা মিঠা পানির জলাশয়, হাওড়, বিল ও নদীতে বিচরন করে। সর্বক্ষণ বড় বড় ঝাঁকে চলাফেরা করে। এরা পানিতে সাঁতার কাটতে খুব স্বাচ্ছ্যন্দ বোধ করে। মাঝে ডুবুরীর মতন ডুব দিয়ে খাবার খোঁজে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে,জলজ উদ্ভিদ, লতাপাতা, কচিকা মুকুল, আগাছার বীজ, জলজ পোঁকামাকড়, ছোট ছোট শামুক ও ব্যাঙাচি।
এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে এরা প্রজনন করে। প্রজননকালে নিজেরাই জলাশয়ের ধারে লতাপাতা গুল্ম ও ঘাসের স্তুপ দিয়ে নিজেদের পালক দিয়ে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় ১০-১৪টি ডিম দেয়। ২৮দিন পর ডিম ফুঁটে বাচ্চা বের হয়। মা-বাবা দুজনেই সমান ভাবে ছানাদের পরিচর্যা করে থাকে।

Red-Crested Pochard বা রাঙ্গামুড়ি বা মৌলভী হাঁস। (মেয়ে)

আমর সঙ্গীরাও যার যার মতন করে মৌলভী হাঁসের ছবি তুললো। সবার ভিতর একটা আনন্দের ছাঁপ ফুঁটে উঠলো। আমরা এই জোনে আরো বেশ কিছু পাখির ভাল ভাল ছবি পেলাম। তারমধ্য থেকে Crested-Serpent Eagle বা তিলা-নাগঈগল, Great Egret বা বড় বক, Hooded Pitta বা খয়েরী-মাথা বনসুন্দরী, Yellow-footed pigeon বা হলদে-পা হরিয়াল, White-breasted kingfisher বা সাদা-বুক মাছরাঙ্গার কয়েকটি ছবি আমার পাঠক বন্ধুদের দেখার জন্য পোষ্ট দিলাম। আশা করি আমার পাঠক বন্ধুদের কাছে পাখিগুলি ভাল লাগবে।

Crested-Serpent Eagle বা তিলা-নাগঈগল
Great Egret বা বড় বক
Hooded Pitta বা খয়েরী-মাথা বনসুন্দরী
Yellow-footed pigeon বা হলদে-পা হরিয়াল
White-breasted kingfisher বা সাদা-বুক মাছরাঙ্গা।
(চলবে)
0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ