মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৪)

শামীম চৌধুরী ১৯ আগস্ট ২০২০, বুধবার, ০৬:৩২:২৩অপরাহ্ন ভ্রমণ ২৭ মন্তব্য

আগের পর্বের লিংক মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৩)

 

পর্ব-১৪

৫ নাম্বার জোনের সরু পথ থেকে মূল পথে একটি ওক গাছের নীচে আমরা সবাই বসলাম। সকাল থেকে একটানা ছবি তোলায় শরীরটা ক্লান্ত হয়ে উঠে। এরই মধ্যে জীতেন চা-বিস্কিট নিয়ে চলে আসলো। চা-পান সেরে সামনে অগ্রসর হলাম। সবার চেহারায় তাকিয়ে বুঝতে পারলাম দলের সঙ্গীরা ভালো কিছু ফুলফ্রেম ছবি পাওয়ায় খুশী। হঠাৎ সঙ্গী ডাঃ নাজমুল ভাইয়ের নজরে পড়লো, হাঁস প্রজাতির বেশ কিছু পাখি পাখার ভিতর ঠোঁট দিয়ে চুলকাচ্ছে। জলজ পাখিরা দীর্ঘ সময় পানিতে থাকে না। তার মূল কারন পানিতে পালক থাকায় দেহ ভারী হয়ে উঠে। তাই কোন বিপদের সম্মুখীন হলে উড়তে কষ্ট হয়। পৃথিবীর সব প্রাণীই নিজেদের নিরাপত্তা মাথায় রেখে চলাফেরা করে। মানুষও তার ব্যাতিক্রম নয়। আমাকে ইশারায় পাখিগুলি দেখালে আমি বুঝতে পারলাম এরা Grey-lage Goose বা ধূসর রাজহাঁস।

Grey-lage Goose বা ধূসর রাজহাঁস আমাদের দেশে ২০ বছর আগে দেখা যায়। তারপর আর আসেনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গলের বাইক্কা বিলে একটি ঝাঁক আসে। আমি সেদিন ভাগ্যক্রমে বাইক্কা বিলে ছবি তুলছিলাম। হঠাৎ মাথার উপর দেখলাম এক ঝাঁক পাখি উড়ছে। বুঝে গেলাম এরা বিলে বসার জন্য জায়গা খুঁজছে। তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল ১০টা। আমার সঙ্গে থাকা অনুজ ফটোগ্রাফার পাখিটির পরিচয় জানতে চাইলো? এত উপরের পাখি চেনাটা অসম্ভব। তারপরও দূরবীন দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। আস্তে আস্তে পাখির ঝাঁকটি নীচে নেমে আসলো। পাখিগুলি আমার পরিচিত নয়। অচেনা পাখিগুলি দেখে শরীরে উত্তেজনা বেড়ে গেল। এক সময় বিলের উত্তর দিকে ফসলি জমিতে বসলো। জমিতে মাত্র ধানের চারা রোপন করা হয়েছে।

আমি নৌকা নিয়ে খুব সাবধানে আগালাম। পাখি সম্পর্কে আমার যে অভিজ্ঞতা তা থেকে আমি নিশ্চিত ছিলাম সহজে এরা উড়ে যাবে না। হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে এসেছে। তাদের এখন খাবার দরকার। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, পরিযায়ী পাখিরা প্রথম যেখানে বসে, বার বার একই জায়গায় তার ফিরে আসে।

আমার  ১৬ বছরের ফটোগ্রাফী জীবনে যেহেতু এই পাখির দেখা পাইনি তাই বুঝতে কষ্ট হলো না এই বিলে তারা বেশীক্ষন থাকবে না। খাবার খাবে। রোষ্টিং করবে একদিন বা রাতটুকু। পরে আবার উড়ে যাবে। তারপরও কথা আছে, যদি এখানে তাদের ঝাঁকের সবার খাবারের জোগান হয় তাহলে মার্চ মাস পর্যন্ত থেকেও যেতে পারে। যাক সে কথা।

যদি কোন কারনে ভয় পেয়ে উড়ে যায় তবে আমার সংগ্রহের তালিকায় যোগ হবে না ভেবে দূর থেকে কয়েকটি শট নিলাম। মাঝিকে নৌকা আগাতে বললাম। বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকা আটকে গেল। অনেক সময় ধরে নৌকায় অপেক্ষা করলাম সমানে আসে কিনা। ইতিমধ্যে পাখিগুলি জমিতে ধানের চারা খাওয়া শুরু করেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত নৌকায় বসে রইলাম। কিন্তু পাখিগুলি বিলের পানিতে নামলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম পরের দিন ভাল ছবির আশায় রাতটা থেকে যাবো। বিলের ধারে একটি মাছের খামারের টঙ ঘরে রাতটা কাটালাম। ভোরে উঠে বিলে যেয়ে পাখিগুলি আর খুজে পেলাম না। আসলে এরা খাবার খেয়ে রোষ্টিং করে শক্তি সঞ্চয় করে উড়ে গেছে।

আমি ও আমার সঙ্গী ছাড়া সেদিন কেউ বাইক্কা বিলে এই পাখির ছবি তুলতে পারেনি। অথচ স্বপ্নের এই পাখিটি কেওলাদেও বনের জলাশয়ে পেয়ে গেলাম। আমার সঙ্গীদের কারো এই পাখি তোলা দূরের কথা। চোখেও দেখেনি। আজ আমরা সবাই রাজহাঁসের ছবি তুলবো। সবার মনে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। ডাঃ নাজমুল ভাই যেখান থেকে পাখিগুলি দেখেছেন সেখান থেকে তুললে ভাল ছবি হবে না। তারপরও উনাদের বললাম সবাই যেন বেশ কয়েকটি ছবি তুলে রাখে। নতুন কোন পাখির ছবি তুললে আমরা সেটাকে লাইফার বলি। তাই সবার লাইফার হবে ভেবে ছবি তুললো। আমি খেয়াল করলাম হাঁসগুলি যেখানে বসে রোদে পাখা ঝাপ্টাচ্ছে তার পিছনে একটা রাস্তা। জীতেন কে বললাম সেখানে যাবার কোন রাস্তা আছে কিনা? সে বললো চলো ম্যারা সাথ। একে বারে পাখির ধারে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেল আমরাও মনের মতন ছবি তুলে ফিরলাম।

মেটে রাজহাঁস

আমরা আরো কয়েক প্রজাতি পাখির ছবি তুললাম এদের মধ্যে Common Teal বা পাতি-তিলিহাঁস, Northern Pintail বা উত্তরে ল্যাঞ্জা হাঁস, White-cheek Bulbuli বা সাদা-গাল বুলবুলি , Common Coot বা পাতি কুট, Northern shoveler বা উত্তরে খুন্তি হাঁস ও Greater Cormorant বা বড় পানকৌড়ি উল্লেখ যোগ্য। পাঠক বন্ধুদের পাখিগুলির দেখার সুযোগ করে দিলাম।

Common Teal বা পাতি-তিলিহাঁস,

Northern Pintail বা উত্তরে ল্যাঞ্জা হাঁস,

 

White-cheek Bulbuli বা সাদা-গাল বুলবুলি ,

Northern shoveler বা উত্তরে খুন্তি হাঁস

Common Coot বা পাতি কুট,

Greater Cormorant বা বড় পানকৌড়ি

 

মেটে রাজহাঁস বৈজ্ঞানিক নাম: Anser anser বা ধূসর রাজহাঁস Anatidae (অ্যানাটিডি) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত Anser (আন্সের) গণের অন্তর্ভুক্ত এক প্রজাতির রাজহাঁস। পাখিটি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।

মেটে রাজহাঁস আন্সের গণের অন্যসব হাঁসের তুলনায় বেশ বড় ও মোটাসোটা। এর শরীর গোলাকার, নাদুসনুদুস এবং ঘাড় ও গলা যথেষ্ট মোটা। মাথা ও ঠোঁট তুলনামূলক বড়। এর পা ও পায়ের পাতা গোলাপি এবং ঠোঁট গোলাপি বা কমলা। ঠোঁটের আগা হালকা ও সাদাটে। এর দৈর্ঘ্য ৭৪ থেকে ৯১ সেমি (২৯ থেকে ৩৬ ইঞ্চি)। ডানা ৪১.২ থেকে ৪৮ সেমি (১৬.২ থেকে ১৮.৯ ইঞ্চি), লেজ ৬.২ থেকে ৬.৯ সেমি (২.৪ থেকে ২.৭ ইঞ্চি), ঠোঁট ৬.৪ থেকে ৬.৯ সেমি (২.৫ থেকে ২.৭ ইঞ্চি) ও পা ৭.১ থেকে ৯.৩ সেমি (২.৮ থেকে ৩.৭ ইঞ্চি)। এর ওজন ২.১৬ থেকে ৪.৫৬ কেজি (৪.৮ থেকে ১০.১ পা), এবং গড় ওজন প্রায় ৩.৩ কেজি (৭.৩ পা)। ডানার বিস্তার ১৪৭ থেকে ১৮০ সেমি (৫৮ থেকে ৭১ ইঞ্চি)। পুরুষ হাঁস সাধারণত স্ত্রী হাঁসের তুলনায় বড় হয়। পশ্চিমের তুলনায় পূর্বাঞ্চলের উপপ্রজাতিতে যৌন দ্বিরূপতা বেশি দেখা যায়।

মেটে রাজহাঁসের গলা বেশ লম্বা। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মাথা ও গলা হালকা ধূসর রঙের। কোমর কালচে ও উপরের লেজ-ঢাকনি সাদা। ডানায় সাদা চিকন ডোরা দাগ রয়েছে। দেহতল বাদামি-ধূসর। পায়ের পরে পেট অবসারণী-ঢাকনি পর্যন্ত সাদা। ওড়ার সময় ডানার ফ্যাকাসে সম্মুখভাগ স্পষ্ট চোখে পড়ে। স্ত্রী ও পুরুষ রাজহাঁস দেখতে একই রকম। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ হালকা খয়েরি এবং পেটের পালকের বেড় অস্পষ্ট। মেটে রাজহাঁস গৃহপালিত রাজহাঁসের মতই হঅঅঅঙ্ক... করে উচ্চস্বরে ডাকে।

পুরাতন বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে এ প্রজাতিটি ঘুরে বেড়ায়। সুবিধাজনক জায়গা পেলেই এরা প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি করে। একসময় সমগ্র ইউরোপ জুড়ে বংশবৃদ্ধি করলেও বর্তমানে কেবল দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপেই এদের বংশবৃদ্ধি করতে দেখা যায়। পুবে সমগ্র এশিয়া হয়ে একদম চীন পর্যন্ত এদের দেখতে পাওয়া যায়।

ব্রিটেনে এদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। বর্তমানে স্কটল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে এরা বংশবৃদ্ধি করছে। মেটে রাজহাঁস সমুদ্রোপকূল, নদনদী, হ্রদ, নিচু জলাবদ্ধ জমি, আর্দ্র তৃণভূমি ও ফসলি ক্ষেতে বিচরণ করে।
কচি ধান গাছ ও জলজ উদ্ভিদ থেকে পোঁকা ও উদ্ভিদের নরম ডগা এদের প্রিয় খাবার। কেঁচো ছোট ছোট শামুক ও চিংড়ি মাছ খায়।

(চলবে)

 

 

 

 

 

 

 

0 Shares

২৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ