মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১৩)

শামীম চৌধুরী ১৭ আগস্ট ২০২০, সোমবার, ০৮:০৬:৫১অপরাহ্ন ভ্রমণ ২১ মন্তব্য

আগের পর্বের লিংক- মাামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-১২)

পর্ব-১৩

কালোবকের ছবি তোলার সময় আমার রিক্সার পার্টনার খোন্দকার কিসমত ভাই অন্য পাখির ছবি তোলায় ব্যাস্ত ছিলেন। আমার সঙ্গীরা কেউই আমার সঙ্গে ছিলেন না। তাঁরা সবাই যার যার মতন ছবি তুলছিলেন। দলের সাথীরা কালোবকের ছবি তুলতে না পারায় আমার মনটা খারাপ ছিলো। পরে এক সঙ্গে হলে আমি উনাদের কালোবক সম্পর্কে বলি। তখন সবাই ছবি তোলার  আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা সবাই কালোবক খুঁজতে থাকি। পুরো ঝোপ তন্ন তন্ন করে খুঁজি। কোথাও কালোবকের দেখা পেলাম না। আমি জানি আমার সতীর্থদের কারো এই পাখির ছবি তোলা নেই। ঘন্টা খানিক খোঁজার পর যখন পাখিটির দেখা পাওয়া গেল না তখন সবার চেহারায় লক্ষ্য করলাম যেন, না পাওয়ার একটা চাপা বেদনার ছাপ ফুঁটে উঠেছে। নিজেকে সে সময় বেশ অপরাধী মনে হচ্ছিল।
 
দলবদ্ধ হয়ে ছবি তোলার সময় আমার ভিতর দুটি ক্রিয়া কাজ করে। প্রথমতঃ আমি কোন অচেনা ও নতুন পাখির সন্ধান পেলে দলের সবাইকে সেই পাখি তোলার জন্য অগ্রাধিকার দেই। নিজে না তুলে দলের সাথীদের আগে পাখিটির ছবি তোলার ব্যাবস্থা করে দেই। দ্বিতীয়তঃ দলবদ্ধ হয়ে ছবি তুলতে গেলে যদি কেউ ছবি না পায় তবে তার মনে একটা কষ্ট কাজ করে। সেটা আমি বুঝতে পারি। আর এই কষ্টটা অনেক বড় একটা কষ্ট। দলের সঙ্গীদের এই সুযোগ করে দেই বলে তাদের কাছ থেকে যে সম্মান ও ভালোবাসা পাই সেটা আমার জীবনে সবচেয়ে বড় পাওনা। অনেক সময় এই পাওয়া না পাওয়া নিয়ে দলের মধ্যে অনেকের সঙ্গে মনোমালিন্যও হয়ে থাকে। আমি আগের কোন এক পর্বে বলেছিলাম ফটোগ্রাফী অনেকটাই ভাগ্যের উপর নির্ভর করে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে এখানে কিছুই করার থাকে না। যার জন্য অধিকাংশ সময় আমি একা একা ছবি তোলায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি শুধুমাত্র এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য।
 
আমি এই বনে Yellow-eyed Babler বা হলদে-চোখ ছাতারে ও Greater grey Babler বা বড়-ধুসর ছাতারে নামক দুটি নতুন পাখি পেয়ে গেলাম। Yellow-eyed Babler তোলার জন্য ২০১৫ সালে ঠাঁকুরগাও ছুটে গিয়েছিলাম। সারাদিন ঘুরাঘুরি করেও পাখিটির দেখা না পেয়ে সেদিন রাতেই ঢাকায় চলে আসি। পরের দিন স্থানীয় ফটোগ্রাফাররা Yellow-eyed Babler এ ছবি পায়। আর Greater-grey Babler আমাদের দেশে পরিযায়ী পাখি। পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলায় এই পাখিটি মাঝে মাঝে দেখা যায়। অনিশ্চয়তা বলে কোনদিন এই পাখির ছবি তোলার আগ্রহ জাগে নি। আমার দলের সাথীরা সবাই নতুন পাখি দুটির ছবি তুলতে পেরে কালোবকের কষ্ট অনেকটাই ভুলে গেলেন। তারা সবাই মহা খুশী। তাঁদের খুশী মাখা চেহারা দেখে আমিও আনন্দিত। আবেগে বলে ফেললাম একটা হারানোর পুরস্কার স্বরূপ দুইটা নতুন পাখি সবাই পেয়ে গেলাম। তারা অট্টহাসি হেঁসে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলো। তাদের এহেন ভালোবাসায় আমি আপ্লুত হয়ে গেলাম। আমার পাঠক বন্ধুদের জন্য নতুন পাখি দুটি শেয়ার করলাম। তাঁরাও যেন পাখি দুটির ছবি দেখে আমাদের মতন তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেন।
Yellow-eyed Babler বা হলদে-চোখ ছাতারে
Greater grey Babler বা বড়-ধুসর ছাতারে
কালোবকের ছবি তুলতে না পারায় আমার সঙ্গীরা দলছুট হলো না।
তাঁরা আমার সঙ্গে থাকবে বলে পণ করলো। আমরা সবাই ৫ নাম্বার জোনে পৌছালাম। রিক্সা থেকে নেমে জোনের মুখে দাঁড়ালাম। চারিদিক ভাল করে তাকালাম। জোনটাকে বুঝার চেষ্টা করলাম। মূল সড়কের (যদি মূল ফটক থেকে আসতে হয় তবে বাঁ দিকে। আর শেষ প্রান্ত থেকে আসতে হলে হাতের ডান দিকে) হাতের ডান দিকে ৫ নাম্বার জোন শুরু। পায়ে চলার মেঠো পথ। চওড়া ১০ফুট। লম্বা প্রায় দুই কিলোমিটার। জোনের মাটির পথ ধরে হেঁটে ২০০ গজের মতন সামনে গেলে হাতের ডান দিকে আরেকটা সরু ৪ ফুটের মাটির পথ। সেই সরু পথের দুই ধারেই বিলের মতন বিছানো। শুধু পানি আর পানি। তৃণ জাতীয় উদ্ভিদে বিলটা আবৃত। জলজ পাখিদের মূল খাবার হচ্ছে জলজ তৃণ উদ্ভিদ। বিলটা দেখে আমার বুঝতে অসুবধিা হলো না এখানে কি কি প্রজাতি পাখির দেখা পাওয়া যাবে।
 
আমাদের দেশে অধিকাংশ হাঁস জাতীয় জলজ পাখি পরিযায়ী হয়ে শীত মৌসুমে আসে। Gad-wall বা পিয়াং হাঁস ছাড়া অন্য কোন হাঁস পাখির এত বড় ফ্লক বা ঝাঁক দেখা যায় না। রাজশাহীর পদ্মার চর ও ফেনীর মহুরীর বাঁধে প্রায় ২০০-২৫০ পিঁয়াং হাঁসের ঝাঁক দেখা মিলে। অন্য প্রজাতির হাঁস পাখি সংখ্যায় ৩/৪টি আসে। অথচ এই বনের জলাশয়ে এই পিয়াং হাঁসের দেখা পেলাম অগণিত। গুনে শেষ করা যাবে না। পিয়াং হাঁসের জলকেলী ও জল স্নান আমাকে মুগ্ধ করলো। এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ কখনই দেশে হয়নি। পদ্মার চরে বা মুহুরীর বাঁধে হাঁস পাখিগুলি বেশ দূরে থাকে। সাইলো ইঞ্জিন বোটের শব্দে পাখিগুলি আকাশে উড়ে যেত। অথচ এই কেওলাদেও বনের বিলে হাঁস পাখিগুলিকে এত কাছে পাবো কোনদনি কল্পনা করিনি। আমার লেন্সের যে মিঃমিঃ তাতে ফুলফ্রেম শট হবে। অথচ এই ফুলফ্রেম শটের জন্য নিঝুম দ্বীপে জানুয়ারী মাসের শীতে মাথায় জলজ উদ্ভিদে ঢেকে গলা সমান পানিতে দাঁড়িয়ে ইউরেশিয়ান উইজিওন বা সিঁথি হাঁসের ছবি তুলেছিলাম। যে কোন ফটোগ্রাফারের কাছে যে কোন পাখির ফুলফ্রেম ছবি মানে হাত দিয়ে পাখিটিকে ধরে ছবি তোলার মতন।
 
যদিও অধিকাংশ হাঁস জাতীয় পাখির পূর্বে তোলা ছিলো। তারপরও ভাল মানের ছবির জন্য লোভ কাজ করলো । Puprle Swamphen বা বেগুনী কালিম, Darter গয়ার বা সাপ পাখি, Gaeganey বা গিরিয়া হাঁস  ও Indian spotbill বা মেটো হাঁসের ছবি ফুলফ্রেমে তুলতে পেরে আমরা সবাই মহা খুশী। একটানা ছবি তুলে দলের সবাই ক্লান্ত। এরই মাঝে জীতেনকে ফোনে বলা হলো চা ও বিস্কিট আনার জন্য। ফোন পেয়ে জীতেন রিক্সা নিয়ে বনের ভিতরে ক্যান্টিনে চলে গেল। আমাদের মাঝে যাদের ধুমপানের অভ্যাস ছিল তারা ধুমপান সেরে নিলো। এখানে বলে রাখা দরকার এই ৫ নাম্বার জোনে প্রায় ১৫০ প্রজাতির জলজ পাখির আবাসন। পাঠক বন্ধুরা একাবার ধারনা করুন কত বড় জলাশয় হতে পারে।
Puprle Swamphen বা বেগুনী কালিম।
Gaeganey বা গিরিয়া হাঁস 
Darter গয়ার বা সাপ পাখি
Indian spotbill বা মেটো হাঁস
(চলবে)
0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ