ক্লান্ত দেহের অবসাদে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলাম। ভোর পাঁচটায় মুঠোফোনে এলার্ম দেয়া ছিলো। সব কিছুই আমার হুকুমে চলবে এমনটা ভাবা ঠিক নয়। মুঠোফোনের এলার্মকে যে হুকুম দেয়া ছিলো সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলো। এলার্ম এর শব্দে বাপ-বেটা ঘুম থেকে উঠে পড়লাম। সবাইকে রাতেই বলা ছিলো আমরা সকাল ০৬টায় বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে হোটেল থেকে বের হবো। আমাদের যাত্রা জয়পুর। বিমান বন্দর হোটেল সংলগ্ন হওয়ায় ১০ মিনিটে পৌছালাম। বোর্ডিং কার্ড ও লাগেজের কাজ শেষ করে নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ মিনিট আগে বিমানে উঠলাম। সকাল ০৮;০০ টায় বিমান ছাড়লো। ০৮:৩০ মিনিটে জয়পুর পৌছলাম।
জয়পুরে আগের থেকেই আমাদের বহন করার জন্য দুটি গাড়ি অপেক্ষায় ছিলো। আমরা সবাই গাড়িতে মাল-পত্র রেখে যার যার আসনে বসলাম। সকাল ৯:৩০ মিনিটে যাত্রা শুরু করলাম ভারতের রাজস্থান, আলওয়ার জেলায় সরিস্কা টাইগার রিজার্ভ ফরেষ্টের উদ্দেশ্যে। জয়পুর সিটি থেকে সারিস্কার দূরত্ব ২৯৫ কিলোমিটার। রাজস্থান রাজ্যের সবচেয়ে সুন্দরতম সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী জয়পুর। পিংক সিটি বা গোলাপী শহর নামেও জয়পুর শহর পরিচিত। জয়পুর শহরের কেন্দ্রস্থলে যন্তর মন্তর, সিটি প্যালেস, হাওয়া মহল ও বিড়লা মন্দির। আর শহরের বহির্ভাগে প্রাচীন জয়পুরের প্রধান কেল্লাগুলো শহরের উত্তর-পূর্বে আরাবল্লী পর্বতচূড়ায় অবস্থিত।
আমের কেল্লা (স্থা, ১৫৯২), সবচেয়ে প্রাচীন কেল্লা ও উত্তরভাগে অবস্থিত।
জয়গড় কেল্লা (স্থা, ১৭২৬), আমের কেল্লার পাশেই অবস্থিত, মূলত এটি প্রতিরক্ষামূলক কেল্লা।
নাহারগড় কেল্লা (স্থা, ১৭৩৪), দক্ষিণভাগে অবস্থিত, বর্তমান শহরের সুউচ্চ দর্শন পেতে আদর্শস্থান।
যেহেুত আমরা শহরের কেন্দ্রস্থল দিয়ে সারিস্কা যাচ্ছি তাই শহরের বহির্ভাগের স্থাপনাগুলি তখন নজরে পড়েনি। পিংক সিটির অপূর্ব দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে আসলাম জলমহলের কাছে। আহা কি যে নয়নাভিরাম দৃশ্য ও প্রকৃতির সৌন্দর্য তা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। এমনিতেই রাজস্থান মরুভূমি ও পাহাড় বেষ্টিত দেশ। সুতারাং পাঠকরা বুঝতেই পারছেন প্রকৃতির শোভা কেমন হতে পারে।
জয়পুর বিমান বন্দরে অবতরনের পর
উপর থেকে ঘড়ির কাঁটার ডানদিকে: জল মহল, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, অ্যালবার্ট হল মিউজিয়াম, হাওয়া মহল, যন্তর মন্তর।
জলমহলের প্রবেশদ্বার।
৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার ঝড়ো গতিবেগে আমাদের গাড়ি ছুঁটে চলছে। সবুজে ঘেরা দুই ধারে পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আমরা ছুটছি প্রকৃতির আমেজে। প্রকৃতির এই দৃশ্য উপভোগ করাও একটা ভাগ্যের ব্যাপার।
সকাল ১১:০০ টায় আমরা একটি হাইওয়ে রেস্তোরায় সকালের নাস্তার জন্য বিরতি নিলাম। রাজস্থান রাজ্যে সবাই নিরামিষভোজী। হোটেলগুলিতে কোন মাছ মাংস এমনকি ডিমেরও ব্যাবস্থা নেই। আমরা বাঙালী ভাত প্রিয়। সেই হিসেবে আমাদের নিরামিষভোজ কষ্ট হবার কথা। তারপরও আমরা মানিয়ে নিয়েছি ভিন্ন স্বাদের খাবার হওয়ায়।
সকালের নাস্তায় চানাডাল ভুনা,পনির কাবাব মাসালাম, আলুর দম ও পরেটা সাথে গরুর দুধের চা। এরা প্রোটিন নিয়ে থাকে মূলতঃ দুধ ও পনির থেকে। কার্ব পায় শাক-সব্জি থেকে। চর্বি পায় ঘি ও মাখন থেকে। সবার দেহ ও স্বাস্থ্য ছিমছাম গড়নের হালকা-পাতলা। মেদহীন অধিকাংশ মানুষ। ছেলে ও মেয়েরা দীর্ঘাদেহীর হয়। মেয়েরা মুখের উপর কাপড় টেনে মুখ আড়াল করে রাখে। এটাই হচ্ছে জয়পুরের মেয়েদের ঐতিহ্য। তাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির আরেকটি বিষয় নজরে পড়লো। সেটি হলো গ্রামের প্রতিটি বাড়ী মাটির তেরী। সামনে বিশাল উঠোন। আর উঠোনে বিছানো থাকে রশি দিয়ে বুনানো খাঁটিয়া। পরিবারের কর্তা ব্যাক্তির আরাম আয়েশের জন্য সেই খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকে। কোন অতিথি আসলে সেই খাঁটিয়ায় বসার ব্যাবস্থা করা হয়। বিত্তবান বা আর্থিক স্বচ্ছল একেক পরিবারের খাঁটিয়া ভিন্ন ভিন্ন কারুকাজের হয়ে থাকে।
নারিকেলে ছোবলা দিয়ে বিশেষ ধরনের রশি দিয়ে বুনানো খাঁট।
দ্বিতীয় রাজ জং সিংহ ফটক।
মানসিংয়ের তোরন।
হাওয়া মহলের সামনে।
গন্তব্যে পৌছার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ছুটে চলছি। আর ফাঁকে ফাঁকে গাড়ীর চালক ধর্মেন্দ্রজীকে জিজ্ঞাসা করছি ভাইসাব, সারিস্কা কেতনা দূর হ্যায়? উত্তরে বললো ধাই ঘন্টা লাগেঙ্গা। পথিমধ্যে আবারও চা পানের জন্য রাস্তার ধারে গাড়ি থামানো হলো। চা-ধুমপান ছেড়ে আবারও গাড়িতে বসলাম। এরই ফাঁকে স্থানীয় মধপুর নামক একটি জায়গায় নীল গাই ও শত শত বানর দেখা গেল। বানরগুলি এত কাছে ছিলো যে সেলফি তোলা সম্ভব হলো। জীবনের প্রথম নীল গাই দেখলাম। কোন এক সময় আমাদের দেশে নীল গাইয়ের অস্তিত্ব ছিলো। আজ বিলুপ্ত। রাস্তা ধরে সারিস্কার উদ্দেশ্যে যাচ্ছি আর পথে পথে ছবি তুলছি। কখন যে সময় কেটে গেল তা বুঝতেই পারলাম না। বেলা ০১:০০মিনিটে সারিস্কা টাইগার ফরেষ্টে এসে পৌছালাম।
আদি পুরুষের সাথে সেলফি। মধপুর রাজস্থান
নীল গাই (মেয়ে)
(চলবে)
১৫টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
ধুর! শেষ হয়ে গেল কেন!
আসলে আপনার লেখার আমার অপারগ মনের স্বপ্ন ভ্রমণ করি।
সব বর্ণনা চাই, একশত পর্বে। মনে থাকে যেন।
শামীম চৌধুরী
ভাইজান, প্রতিটি কদমের বর্ণনা দেয়া হবে লেখায়। আপনি শুধু পাশে থাকবেন। ভালো থাকেন ভাইজান।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
দারুন, চমৎকার লাগলো। আদি পুরুষের সাথে সেলফি, মেয়ে নীল গাইয়ের সাথে- সেলফি মজাই মজা। আপনার ভ্রমণ কাহিনী পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া। ছবিগুলো ও চমৎকার। মনে হচ্ছিল আমি যেন চলছি ভ্রমণ এ। শুভ সকাল
শামীম চৌধুরী
দিদিভাই, যে কোন গল্প আমরা যখন মন দিয়ে পাঠ করি তখন এমনই মনে হয় যে, আমি নিজেই সেই গল্পের মহানায়ক।
শুভ অপরাহ্ন দিদি।
ভালো থাকবেন। পাশে থাকবেন।
তৌহিদ
আপনার ভ্রমণ গল্প পড়তে দারুণ লাগে ভাইজান। জয়পুর সম্পর্কে অনেক কিছু জানলাম। লেখা পড়ছি আর মনে হচ্ছে যেনো কোন মুভি দেখছি।
চলুক গল্প।
শামীম চৌধুরী
পরের বার সঙ্গী হবে কোন এক ভ্রমনে। তৈরী থাকো।
কামাল উদ্দিন
পিংক সিটি যাবো যাবো করেও যাওয়া হলোনা। দেখি করোনাকালের বিদায় হওয়ার পর চেষ্টা করবো একবার ঢু মারতে।
শামীম চৌধুরী
ঘুরে আসুন একবার। ভাল লাগবে।
কামাল উদ্দিন
আগে আপনার গল্পটা শুনে নেই ভাই
হালিম নজরুল
আপনার এসব অভিজ্ঞতা পাঠ করে ভীষণ ভাল লাগছে। আশা করি নিয়মিত এই সুখ পেতে থাকব।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ভাইজান।
জিসান শা ইকরাম
সাথেই যাচ্ছি আপনার। নীল গাই এর কথা এই প্রথম শুনলাম। দেখলামও। রাজস্থান নিয়ে আমার প্রচুর আগ্রহ। কিছুটা জানলাম আপনার এই ভ্রমন পোস্ট এর মাধ্যমে।
পোস্টের মধ্যের ছবিগুলো আর একটু বড় করা যায় না ভাই?
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
ভাইজান এর চেয়ে বড় করা যায় না ছবি। আমি এব্যাপারে ইঞ্জা ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। পরের পর্বেও আপনাকে চাই।
নীরা সাদীয়া
ছবি দেখে প্রাণ জুরালো।
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ আপু।