নাটোরের সিংড়া উপজেলার চলনবিল অংশে তিসিখালি নামক জায়গায় একটা মাজার আছে যা তিসিখালির মাজার বা ঘাসী বাবার মাজার নামে পরিচিত । প্রতিবছর এই সময় মাজারকে কেন্দ্র করে মেলা বসে । এই মাজার এর আরও অনেক কল্প কথা , ঐতিহাসিক ঘটনাও লোক মুখে শুনা যায় । ভাবলাম দেশের অনেক জাগায় গেলাম নিজ জেলাটাই ভাল করে দেখা হল না । আমরা পাঁচ জন ঠিক করলাম এবার মেলা দেখবো । ঠিক হল থাকবো ইটালি ইউনিয়ন এর একটি গ্রামে। মেলার আগের দিন বিকেলে নাটোর থেকে ৫ জন বের হলাম বাসে গিয়ে নামলাম জামতলি । আমরা সন্ধার পরে বের হয়েছিলাম বিধায় যেতে সময় লাগলো ১ঘণ্টা ২০ মিনিট এর মত । জামতলি নামার পরে রাত ৮ টা বাজলো । এখন বাহন হচ্চে ভটভটি ,কিন্তু সমস্যা হল গাড়ি আছে একটি কিন্তু তার আপত্তি ভাই ইটালি এখন যাব না। কেন যাবেন না ? ভাই এত কথা বলা যাবে না । পরে আমরা ৫ জন এবং আর ৩ জন মিলে দিগুন ভাড়া দিতে চাইলাম। শেষে সবার অনুরধে সে রাজি হল । আর বলল রাস্তায় গাড়ি থামাবো না । একটানা যাব আর কেউ ডাকলে অই দিকে তাকানোর দরকার নাই ।
যাহোক ইটালি পৌছালাম রাত ৯ টার পরে । সেখানে নামার পরে আমাদের সাথে থাকা একজনের খালাতো ভাই কে পেলাম । এবার শুরু হল ঐ গ্রামের দিকে চলা বন্ধুর খালা বাড়ি । আর সেখানে যেতে আমাদের পাড়ি দিতে হবে বিশাল একটি বিল । আর ওইদিকের বিল মানে আপনাকে হাঁটতে হবে কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা যদি ছোট বিল হয় । যাহোক আমাদের প্রায় দুই ঘণ্টা লাগলো । চাঁদনী রাত চারদিকে পাকা ধানের খেত তখন ধান কাটা শুরু হয়েছে মাত্র। বিলের মাঝে কিছু দূর দূর সুধু সেচ পাম্প এর ঘর মানুষ তেমন চোখে পড়লো না । পুরো বিলে ধান আর ধান , ধান গাছ গুলী প্রায় একই সমান আর চাঁদের আলোয় বিলের মাঝে প্রকৃতির যে রুপ আসলে স-চক্ষে না দেখাতে পারলে আপনাদের বোঝানো যাবে না। পুরা মজা লুটলাম গল্প করলাম একজন ছাড়া বাকিরা সবাই ধান ক্ষেতে পানি দেয়ার ড্রেনে পড়ে ভিজেছি কাঁদায় জর্জরিত অবস্থা ।
খালার বাড়ি গেলাম রাত ১১ টায় । গোছল আর রাতের খাবার শেষে। একটি মাচায় বসলাম সবাই বিলের বাতাস কলিজা ঠাণ্ডা করে দিল । আমাদের মাঝে একজন প্রস্তাব দিল চল সবাই কার্ড খেলি । আমি তেমন ভাল পারি না বলে ওরা আমাকে নিল না, চার জনে খেলা শুরু করল আমি অগাত্তা কাজ না পেয়ে খালাতো ভাই কে বললাম চল আমরা গ্রামের ভেতর ঘুরে আসি , খালাতো ভাই রাজি হল না । কি আর করা বসে বসে খেলা দেখলাম । তখন রাত বাজে প্রায় ১ টা । এমন সময় খালার কাছে পাশের বাড়ির একজন কি যেন বলে গেলো । খালা এসে বললেন তোমরা দ্রুত ঘরে যাও লাইট অফ করে শুয়ে পড়ো । কেউ এসে ডাকাডাকি করলে দরজা খুলবে না আর উঠার ও দরকার নাই । আমি কথা বলবো। কি সমস্যা ? কেন খালা এটা বলতেছেন ? আর গ্রামে তো কোন সমস্যা হবার কথা না । মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খাইতেছিল কিন্তু কেন ? আমি দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলছি খালা কি হইছে ? খালা বললেন গ্রামে সর্বহারা ঢুকছে । সর্বহারা সম্পর্কে যতটুকু ধারনা টা পত্র পত্রিকার কল্যাণেই । এর বেশি ছিল না । কিছুটা অবাক হলাম নাটোর জেলা শহর থেকে এই যায়গার দুরুত্ত সব মিলিয়ে ৬০ কিলোমিটার এর বেশি হবে না অথচ এই খানে সর্বহারা ???? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হল । কেমনে সম্ভব ?
যাহোক এক বিছানায় ৬ জন ঘুমালাম । ঘুম কি আর আসে ? সৌর বিদ্যুৎ লাইট চাড়া আর কিছু চলে না । আমার ভেতর একটা ভয় ধুকে গেলো সর্বহারা নাকি মানুষ খুন করে !!! আল্লাহ্ বাড়ি ফেরা বুঝি আর হবে না । কেন যে আসলাম । ধুর না আসলেই হত । চাপা গরম এর মাঝেই কাথা গায়ে দিলাম। রাত যারা জাগেন তারা মনে হয় একটা জিনিস খেয়াল করবেন তাদের কিছু খন পরে পরে বাথরুম যেতে হয় । অনেক কষ্ট হলেও বাথরুম যাওয়া দূরে থাক কাঁথার নিচ থেকে মাথা ও বাহির করি নাই আর গ্রামের বাড়ি বাথরুম তো ঘরের বাহিরের অনেক দূরে । আমি ছাড়া সবাই আস্তে আস্তে গল্প করতে ছিল বার বার থামায় দিতেছিলাম এর মাঝে আমারে ভীতু এই সেই যা যা বলা যায় বলল একটা উপাধিও দিল । সারা রাত আর ঘুম হল না । ভাবছিলাম কখন সকাল হবে মেলা দেখার এই ঠ্যালা মেলা দেখার দরকার নাই সকালেই বাড়ি চলে যাব। ফযরের আজান দিলে তারপরে বাহিরে বের হয়েছিলাম সেদিন প্রায় সর্বহারা সব বাড়িতে ঢুকলেও আমরা যে বাড়িতে ছিলাম সেদিন আসে নাই।
পরের দিন সকালে খাবার সময় আমি বললাম খালা এখানে সর্বহারা থাকে আপনারা পুলিশ কে বলেন না ? খালা উত্তর করলেন আমরা কি কাউকে চিনি নাকি !! মুখোশ পরে থাকে । তো তারা এখন আপনাদের কাছে কি চায় ? খালা বললেন ওরা এমনিতে কাউকে কিছু বলে না । ধান কাটা শুরু হয়েছে তো সেজন্যই আসছে , সামনে ধান দিতে হবে তাদের । সবাই আমার রাতের কাজ নিয়ে হাসা হাসি করলো ।
সকাল ৯ টার মধ্যেই আমরা বোতলে কিছু পানি নিয়ে তিসি খালির মাজারের দিকে রওয়ানা হলাম । একটি বিল পার হতে সময় লাগলো প্রায় ৩ ঘণ্টার মত । এর মাঝে থামার কোন জায়গা নেই আর রোদের তীব্রতায় মনে হয়েছিল তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রীর অপরে ছিল । যাহোক একটি বিলের শেষ মাথায় পৌঁছে একটু রেস্ট নিয়ে আবার আরেক বিলে কোনা বরাবর হাটা শুরু করলাম । এখন কিন্তু আমরা আর ৬ জন থাকলাম না অনেক কয়েক জন হয়ে গেলাম যাদের গন্তব্য মাজার জেয়ারত । হাঁটলাম প্রায় দেড় ঘণ্টার মত পৌঁছে গেলাম মাজারে । তখন চার দিক থেকে মানুষ আসতে ছিল । প্রথমেই কয়েকটি তাবু টাঙানো দোকান চোখে পড়লো । দোকান গুলীতে বিভিন্ন প্রসাধনী , আসবাবপত্র, ইত্তাদির দোকান ছিল । একটি দোকান ছিল সম্পূর্ণ আলাদা । আর তাহলো মাটির ছোট ছোট পুতুল মানে বিভিন্ন প্রানির পুতুল যা মাজার জেয়ারত কারীরা মন বাসনা পূর্ণ করার জন্য মাজারের চালায় নিক্ষেপ করেন । কথিত আছে এতে নাকি মনের আশা পূর্ণ হয়। যাহোক মাজারের ভেতরটা ঘুরে দেখলাম। সেখানে একটি মাত্র গাছ মাজার লাগোয়া এছাড়া আপনি আর কোথায়ও ছায়া পাবেন না কিছু ভাজা পোড়া খেয়ে আমরা বসে পরলাম গাছের নিছে । তখনো প্রচুর পরিমানে মানুষ আসতে ছিল বিলের চার দিক থেকে । দুপুর ১ টার দিকে দেখি মানুষ চারদিকে ছুটা ছুটি শুরু করেছে । আমরাও দিলাম দৌড় একটি ধান ক্ষেতের পাশে থেমে একজনের কাছে জানতে চাইলাম ভাই কি হইছে ? তিনি বললেন মাজারে অনেক টাকা আয় হয় । এত দিন এক গ্রামের মানুষ এটা নিয়ন্ত্রণ করছে । আজ অন্য গ্রামের মানুষ এটা দখলের চেষ্টা করে এই হামলা । আমরা আর পিছনে ফিরলাম না শেষ রাতের অভিজ্ঞতা আর এই । সব মিলিয়ে খালার বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম । সন্ধার কিছু পরেই বাসায় পোঁছে গেলাম ।
এখানে উল্লেখ্য
আমার এই মেলা দর্শন প্রায় ৪ বছর আগের ঘটনা । তবে সব চেয়ে ভাল লাগার বিসয় হল ঐ মেলা উদ্দেশ্য করে সেখানকার আস পাশের গ্রাম গুলীতে উৎসব চলে , নতুন ধান, পিঠা পার্বণ , জামাই , আত্মীয় সকলকে দাওয়াত দেয়া হয় ।
আমি কয়েক মাস আগে আবার গেছিলাম সে মাজারে চারদিকে থই থই পানি আর পানি একটি নৌকা ভাড়া করে ঘুরেছি চারদিক । মাজারে ছাত্রদের নিয়ে মাঝির কল্যাণে ফ্রি খিভুরি খেয়ে এসেছি
এখন আপনারা যদি কেউ তিসি খালির মাজারে যেতে চান । আপনাকে আমার মত অ্যাডভেঞ্চারে নামতে হবে না ।
বাংলাদেশের যেকোনো জায়গা থেকে নাটোর যাবেন সেখান থেকে চলনবিল গেট হয়ে সিএনজি আপনাকে নিয়ে যাবে তিসিখালির মাজারে সময় লাগবে খুব বেশি হলে ৪০ মিনিট । মাথা পিছু ভাড়া নিবে ৪০ টাকা । আর নাটোর থেকে বাস এ সিংড়া ২০ টাকা সেখান থেকে সিএনজি তে ১০ টাকা দিলেই আপনি পৌঁছে যাবেন তিসিখালির মাজারে । বগুড়া থেকে আসলে আপনাকে নামতে হবে সিংড়া। সিরাজগঞ্জ হয়ে আসলে আসতে হবে তারাশ-গুরুদাসপুর হয়ে। আরও জানতে ঘুরে আসতে পারেন নাটোর জেলার ওয়েব পোর্টাল বা সিংড়া উপজেলার ওয়েব পোর্টাল থেকে।
এই সুবিধাটি হবার কারন চলনবিলের মাঝ দিয়ে একটি রাস্তা বানানো হয়েছে সিংড়া-সিরাজগঞ্জের তারাশ উপজেলা পর্যন্ত । তবে চলনবিলের অপার সুন্দর প্রকৃতির রুপ ও মাজার যদি এক সাথে দেখতে চান আপনাকে যেতে হবে বর্ষা কালে । বর্তমানে বর্ষা মৌসমে একটি টুরিস্ট প্লেচ ও পিকনিক স্পট।
অনেক দিন পরে অনেকদিন আগের কিছু ঘটনার সম্মিলিত রুপ দিলাম মাত্র । ভাল থাকবেন সবাই ।
Thumbnails managed by ThumbPress
৮টি মন্তব্য
মেহেরী তাজ
নওগাঁ থেকে কিভাবে যেতে হবে বললেন না তো।
অনেক দিন পরে আপনার পোষ্ট পড়লাম। কই ছিলেন এতোদিন????
নাটোর শূন্য কিলোমিটার
আপনি ট্রেনে আসলে সহজ হবে । ট্রেন থেকে নেমে ১০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে মাদরাসা মোড় , তাঁর পরে সিএনজি ভাড়া করে ……….. পরের টুকু অপরে বলা আছে ।
নাটোর শূন্য কিলোমিটার
আসলে আগের মত আর সময় পাইনা । ইচ্ছা করলেও হয়ে উঠে না । কেমন আছেন?
মেহেরী তাজ
আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। সময় করুন। আমরা সবাই অনেক ব্যস্ত তারপরেও সময় করে নিই। এভাবে সোনেলাকে ভুলে গেলে চলবে কেনো????
খেয়ালী মেয়ে
সর্বহারা সম্পর্কে এই প্রথম জানলাম…
খুব ভয়ার্ত সময় যে কাটিয়েছেন লেখা পড়ে বুঝা যাচ্ছে…
দুপুর ১ টার দিকে দেখি মানুষ চারদিকে ছুটা ছুটি শুরু করেছে । আমরাও দিলাম দৌড় একটি ধান ক্ষেতের পাশে থেমে একজনের কাছে জানতে চাইলাম ভাই কি হইছে ?——————এই লাইনটা পড়ে মজা পেলাম 🙂
নাটোর শূন্য কিলোমিটার
বিলের লোকদের মারা মারির অস্র হল দা, বটি, ফলা, তরবারির মত লম্বা চাকু, বাঁশ এইগুলা দেখলে বলতে হবে না দৌড় দাও । আপনি কোন দিকে না তাকিয়ে দৌড় দিতে থাকবেন । :v
শুন্য শুন্যালয়
মনের বাসনা পূর্ন করার জন্যে হলেও তো এই মাজারে যাওয়া চাই। তা আপনার বাসনা পূর্ন হয়েছে তো? নাটোর রাজবাড়ী পর্যন্ত গিয়েছি। সত্যি যদি নাটোর শূন্য কিলোমিটার হতো, তাহলে এখনই যাওয়া যেত।
নাটোর শূন্য কিলোমিটার
নাটোর শহরে আসেন আমাদের জন্য পুরো শহরটাই শূন্য কিলোমিটার সমস্যা নেই । পূর্ণ বর্ষায় আসেন ইনশাল্লাহ দেখায় আনবো ।