মহীরূহ

এস.জেড বাবু ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, শনিবার, ০৯:৩৬:১৪অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২০ মন্তব্য

যতদুর মনে পড়ে, মামা আমাকে কাঁধে করে পুকুরে নিয়ে যেতেন। বরাবরই জলের এক সিঁড়ি উপরে গামছা কোলে খালি গায়ে গোমড়া মুখে বসে থাকতাম। মামা প্রায় পাঁচ একর পুকুরের অর্ধেকাংশ সাঁতরে যেতেন নিলু ঠাকুরের ঘাটে। কোনদিন চন্দ্রকুলি, কোনদিন আপেল মিষ্টি, কোনদিন দুটি লবঙ্গ ছোট একটা পলিথিনে পেঁচিয়ে এক হাত উঁচু করে সাঁতরে ফিরে আসতেন। আমি সানন্দে পানিতে নামতাম, গোছল সারতাম। সাঁতার কাটতে শিখিয়েছিলেন মামা। পেন্ট চেঞ্জ করার সময় আমার কোমড়ে গামছা পেঁচিয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে টেনে টেনে ভেজা পেন্ট খুলতে সহয়তা করতেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে মাথা মুছে দিয়ে আবারও কোলে অথবা কাঁধে করেই বাসায় নিয়ে যেতেন। আমি সেই নিলু ঠাকুরের যে কোন একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার হাতে নিয়ে বাসায় ফিরে স্কুল ড্রেস পড়তাম। মিষ্টি আমার চিরকালের প্রিয় খাবার। চুল কাটার আগে মিষ্টি আর গোছলের বাহানায় পোড়া পোড়া গন্ধের গাঢ় ক্ষির/ চিনির চন্দ্রাকৃতি সন্দেশ কখনো মিস করতাম না।

মামার শশুড় বাড়ি বেড়াতে গিয়ে আমার জীবনে প্রথম সিনেমা হলে যাওয়া। আদিল আমার দেখা সিনেমা হলের বড় পর্দায়, প্রথম বাংলা ছবি।
এস.এসসি পরীক্ষার শেষে মামার কোলে বসেই রিক্সায় করে মুরাদনগর থেকে রামচন্দ্রপুর ফিরেছিলাম। পাশে আমার বাবা ছিলেন। বাবা নেই প্রায় দু’বছর হতে চলল। বড় মামার এক্সিডেন্ট এর পর থেকে সেদিনের সেই রিক্সা জার্নিটা বারবার মনে পড়ছে।

আট ভাই তিন বোনের মধ্যে মামা দ্বিতীয় এবং আমার মায়ের ইমিডিয়েট বড় ভাই। আর আমি ভাগিনাদের মধ্যে সবার বড় হওয়ার কারনে মামা বাদেও এমনকি মামার চাচাত ভাইবোনদের মধ্যে কারও অন্ধকার মুখ কখনো দেখিনি আজ পর্যন্ত। তাদের সবার মাঝে সদা হাস্যোজ্জল এবং শৈশব কৈশরে সবচেয়ে কাছের মানুষ এই “মজিব মামা” বাবা হারানোর পর আপনজনদের তালিকায় আমার নিকটতম মুরব্বী। পরবর্তিতে ব্যাবসায়িক জীবনে লম্বা সময় কেটেছে উনার কাছাকাছি।
অবস্থানগত দিক থেকে মামার ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের দুরত্ব আমার বাসা থেকে একশ গজের ও কম। বাসার ছাদে দাড়ালে দেখা যায়।

গাড়িতে বসলে মামার ঘুমানোর অভ্যাস ছিলো। পূর্ণ যৌবনকালে তিনি একবার ট্রেনে করে চট্রগ্রাম থেকে কুমিল্লায় ফিরছিলেন, উনার ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন তিনি নরসিংদী পৌঁছেছেন।

গত শুক্রবার ১লা ফেব্রুয়ারি/২০ইং- রামচন্দ্রপুর থেকে শ্রীকাইল যাওয়ার পথে চলন্ত সিএনজি হটাৎ ব্রেক কষলে, তিনি পিছনের সিট থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যান। দুর্ভাগ্যবশত মাথা নিচের দিকে থাকা অবস্থায় রাস্তায় আঘাত পেলে নাকে মুখে রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং তাৎক্ষণিক মুরাদনগর হয়ে ঢাকায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। স্কয়ার হাসপাতাল থেকে পরেরদিন শনিবার সকালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত অপারেশানের কথা বলে আইসিও তে রাখা হয়। যথারীতি পরদিন সকালে প্রায় লাখ পঞ্চাশেক টাকার একটা সুদীর্ঘ টাকার অংকের হিসেব ধরিয়ে দেয়ার বিপরিতে টুয়েন্টি পার্সেন্ট সফলতার পূর্ভাবাস শোনানো হয়।

অবস্থা আঁচ করতে পেরে আমার ছোট ভাই, মামাত ভাই এবং উপস্থিত অনান্য আত্মীয় স্বজনরা ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়ে দৌড় ঝাপ / যোগাযোগ শুরু করে এবং শনিবার সন্ধ্যায় উনাকে ঢাকা মেডিকেলে স্থানান্তর করলে দুদিনের মধ্যেই উনার সফল অপারেশন হয়। ( ৪/২/২০)

টানা ২৪ তারিখ পর্যন্ত তিনি ভেন্টিলেশনে ছিলেন- অতঃপর উনাকে সাধারণ বেড়ে স্থানান্তর করা হয়। ইতিমধ্যে তিনি বেশ কয়েকবার ঠোঁট নেড়েছেন, হাত নেড়েছেন। স্বজনেরাও আশার আলো খুঁজছিলেন, তিনি ভালো হয়ে উঠবেন সেই ভরসায়।

গতকাল (২৬/২/২০) বুধবার- বিকেলে শুনতে পাই মামা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরলোকে চিরস্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন।

একে একে আমার আট মামাদের মধ্যে তিনজনই অল্প সময়ের ব্যাবধানে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। দুটি মৃত্যূ অনাকাঙ্খিত/ দুর্ঘটনাপ্রসূত।

২৭ ফেব্রুয়ারি মামার দাফন সম্পন্ন হয়, উনার এক ছেলে তিন মেয়ে। কবরস্থান থেকে ফিরতি পথেই মামা বাড়ি, দেখতে যাইনি- মনে হচ্ছিল, বাবা হারানোর যন্ত্রনার একমাত্র ঔষধ সম্ভবত চোখের পানি। দুনিয়ার এমন কোন শব্দ নেই যে শব্দের বিনিময়ে পিতৃবিয়োগে শান্তনা দেয়া যায়।

আজ ২৯শে ফেব্রুয়ারি, আবারও একটা জানাযায় দাড়িয়েছি সেই একই ঈদগাহ মাঠে, আমার নানাদের আট ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ জন, সবচেয়ে গুণধর ব্যাক্তিত্ব- টানা পয়ত্রিশ বছর যিনি ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ছিলেন, আশপাশের দশ এলাকায় যিনি একজন বিশ্বস্থ বিচারক হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বাস্তব জীবনে একজন সফল ব্যাবসায়ি ছিলেন- হাজী আব্দুল মালেক মেম্বার সাহেব। একটা গল্পে যাকে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না।

কতটা কষ্টে মানুষ পাথর হয় জানা নেই। হয়তো ততটা কষ্ট সহ্য করার মতো ক্ষমতা বিধাতা আমায় দেন নি।

তবে নির্বাক হয়ে যাই, কখনও নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। মনে হয় খুব একা হয়ে যাচ্ছি। দাদা-দাদী, নানা-নানী হারানোর ব্যাথা ততটা কাতর করতে পারেনি যতটা কাতর হয়েছি বাবাকে হারিয়ে। আজ মনে হচ্ছে - মাথার উপর থেকে ছাঁয়াগুলি সরে যাচ্ছে, মেঘ সরে যাচ্ছে, নিজের বড় হওয়ার ইচ্ছেটা পূর্ণতা পেতে পেতে নিজেই হয়ে যাচ্ছি সুউচ্চ কোন মহীরূহ, যার ছাঁয়াতলে বেড়ে উঠছে আমাদের পরবর্তি প্রজন্ম।
খুউব ইচ্ছে করে দাদা, বাবা, নানা, মামাদের মতো হতে, সময় আর বাস্তবতা যাদের কেড়ে নিয়ে শূণ্য মাঠে তেজোদ্যিপ্ত সূর্যটা রেখে গেল মাথার উপর।

দেখা না হলেও সোনেলার উঠানে সহ-লিখকগণ প্রত্যেকেই আমার অন্তরের আপন, প্রিয়দের চেয়ে প্রিয়- আমাদের পরিবারে যারা আছেন এবং যাদের হারিয়েছি তাদের জন্য দোয়া করবেন, যেজন যে জগতে আছেন সেখানে সবাই সেখানকার মতোই ভালো থাকুন। বিধাতা তাদের সর্বোচ্চ সম্মানের সহিত কবুল করুন।

আমিন

-২৯/০২/২০২০

0 Shares

২০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ