১৯৭১ সালে "বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবু" হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের একাদশ/দাদ্বশ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। ১৯৭১ সাল ছিল এদেশের ইতিহাসের জাতীয় রাজনীতির আন্দোলন আর সংগ্রামের সর্বপোরি বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী নয় মাসের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনসহ একটি ঘটনাবহুল ঐতিহাসিক বছর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চ লাইট নামক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত, নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের ওপর পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য, বর্বর, নিষ্ঠুর পৈশাচিক এবং মানবতা বিরোধী হামলা ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। মার্চের ২য় সপ্তাহ থেকে গুল মোহাম্মদ চৌধুরী বাড়ীর নুরুল আবছার চৌধুরী ও পূর্ব ফরহাদাবাদের দবিরুল আলম চৌধুরী প্রত্যেকদিন আমাদের বাড়ীতে আসতেন এবং বাবু দাদা ও জয়নুলের সঙ্গে অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ করতে দেখতাম। আমাদের বাড়ীর কাছারি ঘরে রক্ষিত পথিকদের জন্য রক্ষিত ডাল ভাত চারজনে মিলে খেয়ে বের হয়ে যেতেন। বাবু দাদা আর জয়নুল কখন ফিরতেন জানতাম না তবে তাঁদেরকে সকালে দেখা যেতো বাড়ীতে। এভাবে মে-জুন পর্যন্ত কেটে যায়। এরই মধ্যে আমাদের এলাকার বিভিন্ন বাড়ীতে সশস্ত্র বুক্তিবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিতে শুরু করে। আমার ভাই বাবু স্থানীয় যুবকদেরকে সংঘটিত এবং উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। আমাদের গ্রাম ফটিকছড়ি থানার সাবেক রোসাংগিরি ইউনিয়নের বি ওয়ার্ড এবং বর্তমান সমিতিরহাট ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৩৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । যা আমাদের এলাকার জন্য গর্ব, অহংকার এবং গৌরবের বিষয়। বিগত ২৪ আগষ্ট ১৯৭১ তারিখে আমার ভাই মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবুর নেতৃত্বে ১৩ জন যুবককে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে রওয়ানা দেন তাঁর দলের অন্যন্য সদস্যরা হলেন মরহুমআব্দুল মান্নান, মরহুম জহুর, আবুল কালাম, জয়নুল আলম ( ম্যানেজার), আহমেদ হোসেন বাবুল, আবুল হোসেন, মরহুম নুরুল ইসলাম, ছালেহ জহুর, মরহুম মোহাম্মদ মুসা, মরহুম সাইফুল আলম, রাশেদ এবং হাজী সোলায়মান।
ভারতে গিয়ে আমার ফুফা ডাঃ এখলাস উদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন তাঁরা। পরে তিনি আমার ভাই প্রতিবেশী সাইফুল আলম, রাশেদ, জয়নুল আলম এবং ফুফার ছোট ভাই সরোয়ার কামাল দুলাল মামাকে শেখ ফজলুল হক মণির বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সে (বিএলএফ) বা মুজিব বাহিনীতে যুক্ত করে ভারতের উত্তর প্রদেশে অবস্থিত টান্ডুয়া ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণের জন্যে পাঠিয়ে দেন। বাকীদেরকে আসামের লোহার ক্যান্টনমেন্ট এবং লায়লপুর ক্যান্টনমেন্টে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। কিছুদিন আগে আমার ফুফা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে বলেন, যখন আমি বাবু আর দুলুকে বিদায় দিচ্ছিলাম তখন আমার পকেটে ছিল ভারতীয় মাত্র ১৪ টাকা। তাঁদের দুইজনকে ৬ টাকা করে দেয়ার পরে আমার কাছে অবশিষ্ট ছিল মাত্র ২ টাকা। আমার অন্তরে খুব দুঃখবোধ হচ্ছিল আমার ছোট ভাই আর ভাগ্নেকে আর্থিকভাবে কিছু সাহায্য করতে পারছিলাম না বলে। অবশেষে ঘনিয়ে আসে দেশ ও জাতির সেই মহেদ্রক্ষণ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ক্ষণ। সবাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা শুনে আনন্দিত হয়ে উঠে। আনন্দ মিছিল করতে থাকে। পাশাপাশি গ্রামবাসী অধীর আগ্রহ রাতের বিবিসি’র বাংলা খবর শোনার জন্য। বাড়ীর মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। সঙ্গে বাজতে থাকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু আমার সেঝ ভাইসহ বিএলএফ’এ অংশগ্রহণকারী এলাকার চারজন মুক্তিযোদ্ধা তখনও ফিরে আসেনি। পরে ১৯ ডিসেম্বর যোহরের আগে আমার ভাই এবং সহযোদ্ধারা বাড়ীতে ফিরে আসে। জানা যায়, মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দল হিসেবে ছিল আমার ভাইদের বিএলএফ বাহিনী। তাঁরা আকাশ পথে আসামের দিমাগ্রী বর্ডার হয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হয়ে রাঙ্গামাটিতে প্রবেশ করার পথে ১৭ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটির ফারুয়া এলাকায় পাক আর্মি এবং মিজোদের একটি দলের সঙ্গে অতর্কিত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমার ভাই মিজোদের হাতে ধরা পড়ে যান কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে ছাড়িয়ে আনেন। পরে রাতে কাপ্তাই হয়ে ১৮ তারিখ সকালে চট্টগ্রামে প্রবেশ করেন। তাঁদের ঘাটি ছিল চট্টগ্রাম সিটি কলেজে এবং তাঁদের কামান্ডার হচ্ছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এ বি এম মহিউদ্দীন চৌধুরী। দেশ ১৬ তারিখ স্বাধীন হলেও তাঁদের ফিরে আসায় সবার সেকি আনন্দ। তাঁর পরনে জল্পাই কালারের মোটা ফ্লানেল শার্ট, কাপড়ের জুতা, ছাই কালারের হাফ হাতা সুয়েটার। জুতা খোলার পরে দেখা গেল পায়ের আংগুল ছিঁড়ে গেছে। অথচ তাঁর এসব অনুভবও হয়নি। আমাদের বাড়ীতে যখন আর্মিরা এসেছিল তখন তিনি ভারতে চলে যাওয়ায় বেঁচে যান। যুদ্ধ করতে করতে পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন কিন্তু তাঁর সহযোদ্ধারা তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনেন। তারপরেও আমার বাবু ভাই বাঁচতে পারেননি ভুল এবং অপ-চিকিৎসার কারণে নিজেদের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। হয়তবা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন তাঁর হায়াত এতটুকুই রেখেছিলেন। ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৮৬ ইং তারিখ ভোর রাত আড়াইটার দিকে ভেজাল ইঞ্জেকশান পুশ করার কারণে তিনি স্থানীয় একটি ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার মাধ্যমে দেশের লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধার অবদান শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি। মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লক্ষ অমর শহীদদের প্রতি রইলো গভীর এবং বিনম্র শ্রদ্ধা। গভীর এবং বিনম্র শ্রদ্ধা ইজ্জৎ সম্ভ্রম হারানো দুই লক্ষ মা-বোনের প্রতি।
ছবিঃ বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম মোহাম্মদ আকতারুল আলম বাবু'র ১৯৭১ সালে বি,এল,এফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তথা মুজিব বাহিনী) 'র পোষাকে তোলা ছবি।
৯টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
এই বীর মুক্তি যোদ্ধাকে হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
আল্লাহ তাঁকে ভাল রাখবেন।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার শ্রদ্ধাঞ্জলির জন্য আমি আপ্লুত। দোয়া করবেন ভাইয়া। ধন্যবাদ।
মোঃ মজিবর রহমান
এই বীর মুক্তিজোদ্ধাদের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা রইল।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই। দোয়া করবেন এ ভাইয়ের জন্য।
মোঃ মজিবর রহমান
মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন, আমিন।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
অনন্য শ্রদ্ধাঞ্জলী।
নিশ্চয় আত্মত্যাগীরা চিরকাল স্মরণীয়।
আন্তরিক শুভ কামনা জানবেন সতত।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
আপনার আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলির জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
মনির হোসেন মমি
মুক্তিযুদ্ধের ছড়িয়ে পড়ুক পুরো বিশ্বে।
তাঁর প্রতি বিনম্ভ্র শ্রদ্ধাঞ্জলী।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা বা স্মৃতি সবার জানা উচিৎ। ধন্যবাদ।