স্ত্রী এবং কন্যার সাথে খালেদ মোশাররফ।

একজন অনন্য মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের নেপথ্য নায়ক খালেদ মোশাররফ, পর্ব ০৩

আগরতলার শালবাগানে ছিল ভারতীয় ডেলটা(ডি) সেক্টরের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর সদর দপ্তর , যার অধীনে ছিল আমাদের ১,২ এবং ৩ নাম্বার সেক্টর। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের একদিন শোনা গেল ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং , মেজর জিয়াউর রহমান এবং খালেদ মোশাররফের সাথে মিটিং করছেন। দুপুরের খাবারের সময় বিমান বাহিনীর অফিসারদেরও কনফারেন্স রুমে ডাকা হল। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বসেছিলেন ঘরে ঢুকতেই টেবিলের এক প্রান্তে। সবার সামনে উপুর করা খাবার প্লেট। সাবেগ সিং-এর বামে বসা খালেদ ডানে জিয়া।
হঠাত এবং অপ্রাসঙ্গিকভাবে ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বাঁয়ে তাকিয়ে মেজর খালেদকে বললেন,'খালেদ তোমার এত রেশন লাগে কেন'?
খালেদ জবাব দিলেন, " স্যার আমি ঢাকার সবচেয়ে কাছে,কুমিল্লা এবং নোয়াখালীর সাথে লাগোয়া। সকালে যদি আমার ক্যাম্পে ৫০০ ছেলে থাকে, দুপুরে থাকে ১৫০০, রাতে ৩০০০ থাকে। কোন কিছুই ঠিক নেই।"
ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং বললেন," আমি দুঃখিত খালেদ। আমাকে তোমার রেশনের হিসেবটা নিতে হবে।"
খালেদ বুঝতে পারলেন সাবেগ সিং ইঙ্গিত করেছেন তাঁর সততার প্রতি। খালেদ সাথে ডান হাতে খাবারের প্লেটটা সামনের দিকে ঠেলে দিলেন। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর চোখে চোখ রেখে পরিষ্কার ভাষায় এবং প্রত্যয়ী কন্ঠে বললেন "ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং আপনি, আপনি নিশ্চয় চান না আমি আমার রাইফেলের ব্যারেল দুই দিকে ঘুরাই।" বলেই ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর পিছনের দরজা তিনি বেরিইয়ে গেলেন। প্রায় সাথে সাথে মেজর জিয়াও বের হয়ে গেলেন। জিয়া বের হয়ে খালেদের হাত ধরে  বলতে লাগলেন,"খালেদ এটা রাগারাগি করার সময় না,জায়গাও না। মাথা ঠান্ডা রাখো। ফেরত আসো।"
এতক্ষনে সাবেগ সিংও তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। তিনিও বের হয়ে এসে ক্ষমা চেয়ে খালেদকে হাত ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে ঢুকলেন।

এই ছিলেন আমাদের খালেদ। পেশাজ্ঞান, বুদ্ধি, দেশপ্রেম এবং অমায়িকতা দিয়ে মেজর খালেদ ভারতীয় অফিসারদের বুঝিয়ে দিয়েছিলেন 'আমি খালেদ'। পরে অবশ্য আমি দেখেছি ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং এর সাথে খালেদের অন্তরঙ্গ সখ্য। ত্রিপুরার রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক আর জনগণের মাঝে খালেদের জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক। তিনি সবার সঙ্গে খোলা মন নিয়ে মিশতেন,আড্ডা দিতেন। যুদ্ধের সময় KMT বলে একটি কথা ছিল। অর্থাৎ খালেদ মোশাররফ টাইম। তিনি সবসময় একটু পরে এসে উপস্থিত হতেন। বলা হত খালেদের ঘড়ি সবসময় পিছনে চলে।
২২ অক্টোবর কসবার কাছে কমলা সাগরে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আক্রমণ অবলোকন করার সময় শত্রুর কামানের গোলার স্প্লিন্টার উনার মাথার ভেতরে ঢুকে আহত হন সেটিও দেরিতে উপস্থিত হওয়ার কারণে। ভোর রাতের আক্রমণ তিনি দেখতে গেলেন প্রকাশ্য দিনের আলোয় বেলা সকাল সাড়ে ৭টায়।
সেবার কোনাবন যাবেন ক্যাপ্টেন গফফারের সদর দপ্তরে। গাড়ি অপেক্ষা করছে। তিনি আড্ডা দিচ্ছেন ক্যাম্পের মানুষদের সাথে। আমি বারবার তাগদা দিচ্ছি। তিনি আসছি আসছি বলে আমাকে নিভৃত করছেন আমাকে। এবার মনে করিয়ে দেওয়ার সুরে হয়ত একটু তাগদার ভার বেশি ছিল। তিনি ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে বাম হাতে পড়া ঘড়িটির কাঁচ ঘষতে ঘষতে বলতে লাগলেন "এই ছোট হাবিলদার মেজরটির জন্য কোথাও একটু শান্তিমত বসতে পারলাম না। "
যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কখনও আমার বন্ধু, কখনও অভিভাবক, কখনও কমান্ডার।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এই প্রথম এবং শেষবারের মতো খালেদ চলেন গেলেন সময়মতো নয়। সময়ের অনেক আগে,মাত্র ৩৭ বছর বয়সে।

সুত্রঃ “খালেদের কথা”।
লেখকঃ মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ