মসজিদ

নাজমুল আহসান ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, বুধবার, ০১:৩৮:১৯পূর্বাহ্ন গল্প ১৮ মন্তব্য

আমি বেশ সাবধানে মোটরসাইকেল চালাই। খুব জোড়ে চালানো কিংবা রাস্তায় কারও সাথে টেক্কা দেওয়ার মতো কাজ আমি কখনোই করি না। তারপরও সেদিন একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেল।

কী একটা কাজে গোবিন্দগঞ্জ গিয়েছিলাম। গোবিন্দগঞ্জ আমাদের বাড়ি থেকে মোটামুটি বারো-তেরো কিলোমিটার দূরে। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। চারদিকে আবছা অন্ধকার। রাস্তার দুপাশে সারিসারি গাছ। হালকা শীত আর শিরশিরে বাতাস। মোটরসাইকেল চালানোর জন্যে বেশ চমৎকার পরিবেশ।

আমার পনের-বিশ হাত সামনে একটা সিএনজি অটোরিকশা যাচ্ছে। আমি চাইলেই অটোরিকশাটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে পারি। কিন্তু আমি জানি, আমি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই অটোরিকশা চালকের মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সে আমাকে পিছনে ফেলার চেষ্টা করবে। একটা অনাকাঙ্ক্ষিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং পেছনে পেছনে গেলেই ভালো। খানিকটা নিশ্চিন্তে যাওয়া যায়। সামনে থেকে কখন কোন গাড়ি আসছে -এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না।

হয়তো একটু বেখেয়াল হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি সামনের অটোরিকশা দাঁড়িয়ে পড়েছে। ডান পাশে উল্টো দিক থেকে অন্য একটা গাড়ি আসছে। আমার কিছু করার থাকল না। ব্রেক চেপে ধরলাম। এবং মুহূর্তের মধ্যে হুড়মুড় করে পড়ে গেলাম!

উঠে দাঁড়াতেই দেখি অটোরিকশা চালক কাঁচুমাচু মুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে যেটা বলল, তার সারমর্ম হল- রাস্তার বাম পাশে এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে ছিলেন। অটোরিকশা কাছাকাছি চলে আসার পর বৃদ্ধা রাস্তা পার হতে শুরু করেছেন। বাধ্য হয়ে তাকে ব্রেক করতে হয়েছে।

আমি মোটরসাইকেল তুলে দাঁড় করালাম। অটোরিকশা চালককে অভয় দিয়ে বিদায় করে দিলাম। ততক্ষণে সেই বৃদ্ধা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। খুব ব্যস্ত হয়ে খুঁজতে লাগলেন আমার কোথাও কেটে-ছিঁড়ে গেছে কিনা। রাস্তার পাশেই বৃদ্ধার ছোট মুদির দোকান। দোকানের সামনে একটা কাঠের বেঞ্চিতে আমাকে বসালেন। ঠিক তখনি খেয়াল করলাম আমার থুঁতনি থেকে ফোঁটাফোঁটা রক্ত পড়ছে।

হাত দিয়ে দেখলাম, থুঁতনির নিচের দিকে কেটে গেছে। বেশ গভীর ক্ষত। দ্রুত ধুয়ে ফেলা দরকার।বৃদ্ধাকে জিজ্ঞেস করলাম তাঁর কাছে পানি আছে কিনা। বৃদ্ধা “পানি তো নাই আব্বা” বলেই লাফ দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে এলেন। কাছেই তাঁর বাড়ি, বাড়ি থেকে পানি আনতে চলে গেলেন।

তাঁর ফেরার অপেক্ষা করতে করতে খেয়াল করলাম, রাস্তার উল্টো দিকে একটা মসজিদ। ওখানে নিশ্চয়ই পানি পাওয়া যাবে। বৃদ্ধা কখন আসেন কে জানে! আমি চট করে রাস্তা পার হয়ে এদিকে চলে এলাম।

মসজিদের সামনে একটা ছোট অজুখানা। বেশ সুন্দর। চকচকে। অজুখানার এক কোনায় একটা টিউবওয়েল। আমি টিউবওয়েল চাপতে যাব, পিছন থেকে কে যেন বলল- আমারে দেন। তাকিয়ে দেখি দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে। আমি সরে এলাম। ছেলেটা টিউবওয়েল চাপতে চাপতে বলল- কী হইছিল?
বললাম- মোটরসাইকেল নিয়ে পড়ে গেছিলাম। তোমার নাম কী?
- হাসান। দেখেশুনে মোটরসাইকেল চালাইয়েন।

রাস্তার এপারে এসে দেখলাম বৃদ্ধা তখনো আসেননি। ভদ্রতার খাতিরে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করা উচিৎ। কিন্তু তখনো রক্ত বন্ধ হয়নি। ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি মোটরসাইকেল নিয়ে চলে এলাম।

বাসায় এসে খেয়াল করলাম, পকেটে মোবাইল ফোনটা নেই। মনে পড়ল, বৃদ্ধার দোকানে বসে থাকার সময় বের করেছিলাম।

——————

পরদিন সেই দোকানে হাজির হলাম। বৃদ্ধা আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। ওষুধ খেয়েছি কিনা, ব্যথা কমেছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মোবাইল ফোনটা আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, “কাল পানি আনার পর দেখি তুমি নাই। মনডা খারাপ হইছিল!”
বললাম, "এই মসজিদের টিউবওয়েলের পানি দিয়ে রক্ত ধুয়ে ফেলেছিলাম।”

বৃদ্ধার চাহনি দেখে মনে হল, তিনি আমার কথা বুঝতে পারেননি। আমি ডান দিকে ঘুরে হাত দিয়ে রাস্তার ওপাশটা দেখাতে গিয়ে থেমে গেলাম। রাস্তার উল্টো দিকে কোনো মসজিদ নেই! সব আবাদি জমি। চারপাশে তাকিয়ে কোথাও কোনো মসজিদ চোখে পড়ল না।

আমি আর কিছু না বলে চলে এলাম।

রাতে আমার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলো।

0 Shares

১৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ