প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা মানেই যে দুটো জিনিস আগে মানুষের সামনে আসে তার প্রথমটি ‘পিরামিড’ এবং দ্বিতীয়টি ‘মমি’
মমির প্রতি মানুষের বিশেষ একটা রহস্য ঘেরা আকর্সন আছে। পাথর খোদায় করা একটা গোপন কবরের মধ্যে একাকি বা অনেক গুলোর সাথে পড়ে থাকা লিনেনের ব্যান্ডেজ দিয়ে জড়ানো একেবারে মানুষের মতো একটা মৃতদেহ কেমন যেন একটা রহস্য ঘেরা শিহরন জাগায়।
একেকটা মমি মানে অনেক গল্প । যেমন এর বয়স কত , নাম কি, নারী না পুরুষ, কত দিন আগে মারা গেছে, কি ভাবে মারা গেছে বা কি অসুখ ছিল, সাধারণ মানুষ না কোন রয়াল না উঁচু শ্রেণীর এবং মমি কি ভাবে করা হয়েছে এইসব এইসব ।
আধুনিক টেকনোলোজি, যেমন DNA টেস্ট বলে দায় সে কোন পরিবারের, মমির গায়ে কিংবা মমি রাখা বাক্সে তারা নাম লিখে রাখা দেখে জানা যায় তার নাম, সিটি স্ক্যান দ্বারা বেরিয়ে আসে নারী না পুরুষ এবং তার বয়স, কাছে পড়ে থাকা পটারি বলে দায় কোন ডাইন্যাসটি এবং মমি করার পদ্ধতি বলে দায় সে কোন কিংডমের ।
একটা মমি এন্যালাইসিস করলেই জানা যায় প্রাচীন মিশরের মানুষের জীবন ধারণ সম্বন্ধে অনেক কিছু। মমি করার পদ্ধতি সব সময় একই রকম ছিল তা কিন্তু নয়।
আবার যার যেমন স্ট্যাটাস তার কবরও তেমন হয়। ফ্যারো ,এবং তাদের রানী আর পরিবারের কবর অনেক সুন্দর হয়। যেমন ‘ সেটি এক’ এর কবরে দশটি ঘর ছিল । রাজা রানীদের ঘর গুলোর দেয়ালে আঁকা থাকে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে তার হার্ট মাপা হচ্ছে, ভালো হলে সে মৃত্যুর পর সুন্দর জীবন পাবে।একেকটি কবর যেন একেকটি ‘ সিটি অফ ডেড’ ।
স্পেল থাকে যেমন “আমি হলাম ফনিক্স, দেবতা রে এর আত্মা, যে কিনা পরকালের দেবতা কে পরিচালনা করে পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় সে ভালো কাজ করেছিলো না কি তা সে পরীক্ষা করে।” এই ধরনের লেখা কবরের দেয়ালে দেয়ালে ছবি দিয়ে ব্যাখ্যা করা থাকে।
শুধু তাই নয় যে যেমন ধনী তার কবরেও দেয়া হয় তেমন জিনিস। রাজা রানী দের কবরে সব ফার্নিচার,কাপড়,গয়না, সোনা দানা থেকে শুরু করে খাবার দাবার এবং পানীয় সব বোঝায় করে দেয়া হয় পরকালের জীবনের জন্য। যাতে তাদের কোন অসুবিধা না হয় পরবর্তি জীবনে ।কারন মিশরীয়রা মনে করতো মৃত্যুর পর মানুষ আবার জীবন ফিরে পাবে । মাটি দিয়ে তৈরি চাকর বাকর এবং সেবা কারি সব দেয়া হতো তাদের সাথে । এগুলোকে বলা হয় ‘ সাপতি’ ।
তুতেন খামনের কবরে ৬০০০ হাজার জিনিস পাওয়া গেছে এবং তা ছিল ইমপ্যাক্ট অর্থাৎ পরিপুর্ন আর তা সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে তা সেই অবস্থায় ছিল ।সেখানে ছিল সলিড গোল্ডের মুখোস যার ওজন অনেক , কফিন বাক্স , তার খাট, মমি করার বিছানা, আর সিংহাসন সব দামী সোনা এবং মুল্যাবান পাথর দিয়ে মোড়ানো । তার কোমরে একটা ড্যাগার গোঁযা ছিল তা এই পৃথিবীর বস্তু দিয়ে তৈরি নয়, তা ছিল মহাশূন্য থেকে আসা Asteroids দিয়ে । ১৯২২ সালে হাওআরড কার্টার এই কবরটি ডিসকভার করেন। তিনি ছিলেন একজন মাইনর রাজা তার কবরেই এতো কিছু , না জানি অন্য সব শক্তিশালী ফ্যারো দের কবরে আরও কত কিছু ছিল।
ধনী বা ফ্যারো দের মৃত দেহ সমাহিত হবার পর পরেই কবর লুটপাট হয়ে যেতো । লুটপাট করতো তারাই যারা কবর বানাত। কারন তারাই জানতো কোন দিক দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এবং কোন কুঠুরিতে কি লুকানো আছে আর তাদের সঙ্গে কি কি মূল্যবান জিনিস দেয়া হয়েছে।
২১ ডাইনেসটিতে রয়াল মমি গুলোর কবর থেকে সব চুরি হবার পর তাদের কে পুনরায় শিরোমণির মাধ্যমে সমাহিত করে গোপন এক কবরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো । যাতে তারা পরবর্তি জীবনে নির্ভিগ্নে যেতে পারে ।
‘মমি’ প্রি ডাইনেসটীক পিরিয়োড
ডাইনেস্টি আরম্ভ হওয়ার আগে প্রাচীন মিসরীয়রা প্রাকৃতিক ভাবে মৃতদেহ সংরক্ষণ করতো( ব্রিটিশ মিউজিয়াম)
মমি করার পদ্ধতিতে ক্রমাগত ভাবে পরিবর্তন আসতে থাকে। Predynastic Period ( ৪৬৫০-৩০৫০ BC) অর্থাৎ যা কিনা ডাইনেসটি আরম্ভ হওয়ার আগের সময় টি, সে সময় সে সময় মৃত মানুষটির দেহ মমি না করে অগভীর বালুর নিচে রাখা হত এবং যা কিনা অটোমেটিক ভাবে সুর্জের প্রখর তাপে শুকিয়ে যেতো আর ন্যাচারাল ভাবে মমিতে পরিণত হত । তাছাড়া মরুভূমিতে কোন পানি থাকতো না যা দেহ শুকাতে সাহায্য করে। কোন ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারতো না। তার সাথে কিছু খাদ্য সহ মাটির জার এবং হালকা অলংকার , চিরুনি দেয়া থাকতো । মৃত দেহের মাথা দক্ষিণে এবং মুখটি ঘুরিয়ে পশ্চিমে অস্তমিত সূর্যের দিকে রাখা হত ।
‘মমি’ ওল্ড কিংডম
‘মৃত ব্যাক্তি আবার জেগে উঠে’ এই বিশ্বাসে মৃত দেহটিকে ঠিকঠাক মতো রাখার জন্য প্রাচীন মিশরীয়রা মমি করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনে । যাকে বলে আরটি ফিসিয়াল পদ্ধতিতে দেহ প্রিজার্ভ করা। ১৮৯৯ সালে ব্রিটিশ আরকেওলজিষ্ট Flinders Petrie ( ফ্লিন্দ্রেস পেত্রি ) ডাইনেসটি এক সময়কালীন রাজা ডিযের (DJER) এর মমি আবিষ্কার করেন খনন কার্জ চালিয়ে । কিন্তু যদিও মমিটি লিনেন দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা ছিল কিন্তু তা পচনের হাত থেকে রক্ষা পাইনি।
পরবর্তিতে তারা (২৬১৩-২৪৯৮) embalming পদ্ধতি আবিষ্কার করেন এবং তা হল মৃত দেহ টির ভিতরের অর্গান পেটের এক পাস কেটে বের করা ,নাক দিয়ে মগজ বের করে ফেলা এবং গজ কে গজ লিনেন দিয়ে শরীর পেঁচিয়ে ব্যান্ডেজ করা এবং তাতে রেজিন দিয়ে প্লাস্টার করা ( একরকম গাছের আঠা ) আর যার ফল স্বরূপ পরবর্তিতে রেজিন শুকিয়ে গেলে দেহটি একটি শক্ত দেহে পরিণত হতো ।
পরের দিকে দেখা যায় রেজিন ছাড়াও লবণের ব্যাবহার । ডাইন্যাসটি ৪, রানী হেতেফেরেস ( Hetepheres ) এর মমিতে লবণের সলিউসান পাওয়া যায় এবং কবরে লবন ভর্তি জার পাওয়া যায়। যাকে বলা হয় natron। তিনি গ্রেট পিরামিডের অধিকারী কুফুর মা ছিলেন।
‘মমি’ গ্রিসিও এবং রোমান পিরিয়ডঃ
নিউ কিংডমের পর মমি করার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। মমি গুলো প্রিজার্ভ হলেও মৃত দেহ টিকে ঠিক মানুষের মতো লাগেনা। তাই তারা মমি করার সময় মানুষের মতো রূপ দেয়ার জন্য হাত এবং পা গুলোতে চর্বি,মাটি, বালু, এবং কাঠের গুড়ো ঢুকিয়ে দিতো । চোখে পিঁয়াজ ঢুকিয়ে দিতো এবং মমি করার পর কাপড়ের উপরে চোখ,মুখ নাক এঁকে দিত ,যা কিনা একটা পুতুলের মতো লাগতো।
এগুলো সবই ডাইনেসটি ২১ এর পর পার্সিয়া, গ্রীস, রোম এদের দখলের পর। তারা মমি করার পদ্ধতি গ্রহণ করলেও আগের মতো সময় লাগাত না।
এমনকি অনেক মমি এক্স রে করার পর দেখা গেছে সেখানে দেহের হাত বা পায়ের পরিবর্তে পাম গাছের ছোবড়া দিয়ে নকল হাত পা বানিয়ে রাখা আছে।
এই হল মমির গল্প যা একাধারে রহস্যময় আবার তা থেকে প্রাচীন মিসরীয়দের জীবনবোধ এবং চিন্তাধারা মন মানসিকতা অনেক কিছু আমরা খুঁজে পাই ।
তথ্য সূত্রঃ
Egyptian Mumnies, Adam Barbara
Mummy , Putnam James
Mummies and their mysteries , Wileox
Picture ,Wikipedia
নিজস্ব ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে
২টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
মিশরের পিরামিড ও মমি যেন রহস্যময় এক নাম। যতো পড়ি ততই বিমোহিত হয়ে যাই। শুভ কামনা রইলো।
নার্গিস রশিদ
ঠিক বলেছেন আমার তাই । যেখানে যত ডকুমেন্ট বা তাদেরকে নিয়ে লেখা পাই পড়তে থাকি । অনেক ধন্যবাদ এবং শুভ কামনা।