মমতার স্পর্শ

আরজু মুক্তা ৩০ জুলাই ২০২১, শুক্রবার, ০২:২৮:৫২অপরাহ্ন গল্প ২৪ মন্তব্য

করোনা পাল্টে দিয়েছে চেনা জীবনের ছক। বদলে দিয়েছে পৃথিবী। আগে যা ছিলো দূর কল্পনা,  তা হয়তো এখন বাস্তব।

লকডাউনে  যেমন অনেক পরিবারের মানুষ নিকটে চলে এসেছে। তেমনি, আবার আর্থিক অনটন বা দুইজনের মাঝে বনিবনা না হওয়াতে যে যার পথ বেছে নিয়েছে। এমনি এক পরিবারের নীরব সাক্ষী আমি। আমার স্ত্রী করোনায় মারা গেলেন। নিজের একাকীত্ব ঘুচাতে নাতনীকে নিয়ে বসি গল্পে। আমার একটাই ছেলে। পারিবারিক চরম সংকটে সে তার বৌকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। অফিসের কলিগের সাথে তার এতো প্রেম ছিলো যে তাকে নিয়েই নতুন সংসার পাতে। আমি এই বুড়ো মানুষ কেমনে বৌ মাকে ছেড়ে যাই। অমায়িক, ভদ্র মেয়েটা মুখ ফুটে  কিছু বলতে পারেনা। নীরবে চোখের জল ফেলে। চাকরি, পরিশ্রম আর মেয়ের আদর দিয়ে আমাকে আগলায় রাখে। এখন এই তিনজন এক পৃথিবী।

নাতনীর নাম প্রাযুক্তা। রবীন্দ্রনাথের মিনি। কথা শুরু হলে শেষ হতে চায় না। যেমনি স্কুল নাই। কারও সাথে মেলামেশা নাই। খেলাধূলাও নাই। মুখর করে রাখে সারাটা বাড়ি। ও হাসলেই বাড়ি হাসে। আমাকে গল্পের বই এর কয়েকটা প্যারা পড়তে দিয়ে বলবে,  বুঝিয়ে বলো। আবার অনেক সময় কঠিন ডায়ালগ গুলো অবলীলায় বুঝে ফেলে। দারুণ ছবি আঁকে সে। দেয়ালে দেয়ালে তার পেইন্টিং। রঙে রঙিন।

আচ্ছা দাদু, তুমি কী প্রেমে পরেছিলে ?

হঠাৎ তার প্রশ্নে ফিরে গেলাম ৪০ বছরে। ক্যালেন্ডার এর পাতা বলছে ১৬ ই বৈশাখ। পাতাগুলো এক এক করে উল্টে যাচ্ছে। ঝকঝক করছে আয়নার মতো। বকবক করছে স্মৃতির পাখিরা।

নাতনীকে বললাম, প্রভা হালিশহর থাকে।

" কে দাদু ?  তোমার সেই প্রেমিকা ?

"হ্যাঁরে। ইচ্ছা করছে ওদের বাসায় যেতে। "

" এখন গেলে সবাই কী মনে করবে ? ওর চেয়ে মোবাইল নং থাকলে ফোন করে ; অন্য কোথাও দেখা করতে পারো। "

" ও রে পাকনা বুড়ি।"

" উনি দেখতে কেমন? "

" কবরী ! "

কাঁপা হাতে কী প্যাড চেপে সেই নাম্বারে ডায়াল করে কিছু বলতে চেয়েও পারলামনা। অথচ অপর প্রান্ত নির্দ্বিধায় বুঝে ফেললো।

" এতোদিন পর মনে পরলো?

করোনায় ব্যস্ততা কমেছে। স্মৃতির ভীড় বেড়েছে। সিদ্ধান্ত হলো আমরা দেখা করবো। কে কখন পৃথিবী থেকে চলে যাই। হয়তো এটাই শেষ দেখা।

কর্ণফুলীর মেরিন ড্রাইভ ধরে হাঁটছি আমি আর নাতনী। অপেক্ষার প্রহর শেষে দেখা গেলো তাকে। ভারী চশমা। তবে হাঁটার ভঙ্গি আগের মতো নেই। হাঁটুতে সমস্যা মনে হয়। টেনে টেনে হাঁটছে। নাতনী বললো তোমার বর্ণনা পারফেক্ট। এখনও কবরী।

প্রভা এসে বললো, সামনে একটু এগুতে তো পারতে। ক্লান্তিতে ক্লান্তি এসে গেছে। নাতনীকে দেখে বললো, তোমার তো সঙ্গী আছে। আমার তাও নেই।

চৌকস নাতনী নিজের পরিচয় দিলো।

সূর্য দিগন্তে ডুবু ডুবু। সমুদ্রের কাছে গেলেই দেখা যেতো নৈর্সগিক দৃশ্য। সমুদ্রের বুকে কেমনে মুখ লুকায় সূর্য।

প্রভা বললো, কেমন আছো?  বিশ বছর পর দেখা। তখন মনে হয় একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিলো।

প্রতিউত্তরে বললাম, " তুমি ভালো তো, কবরী ? "

ন্যাকামি রাখো। সেই বয়স নেই। এখন শুনতে ভালো লাগে না। আমার স্বামী মারা গেছে, শুনছো?  মেয়ে একটাই। থাকে ঢাকা। উৎসবে আসে। ছেলে আমেরিকা। আসা যাওয়া কম। আমি অতো বড় বাড়িতে একা। পরিচারিকা আছে। সময় কাটতে চায় না। একঘেঁয়েমি লাগে।

আমিও নিজেরটা বললাম। কথাগুলো এখন গোধূলির মতো সংক্ষিপ্ত। প্রভা উঠতে চাইলো। আমি বললাম,একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্য চিঠি তো দিতে পারো?  না বলা কথাগুলো রিনিঝিনি আওয়াজ তুলতো। চিঠি হয়ে যেতো চলন্ত জীবন্ত ট্রেন। অভিমান আর খুনসুটির মেলবন্ধন।

প্রভা স্মিত হাসলো। আচ্ছা, এখন থেকে সপ্তাহে একটা চিঠি দিবো। তুমি লিখবে তো?

কেনো জানি শেষোক্তি কথাটাতে তার গলা ধরে এলো। আর আমার স্তব্ধতা। বলতেও পারলাম না, আর একটু বসো।

আমার নাতনী বললো, ওনাকে অসাধারণ লেগেছে। " অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলে" রবীন্দ্রনাথ এর এই গানটা তার জন্য পারফেক্ট।

"আরও মোলায়েম ছিলো। সংসার যুদ্ধ। এখন বুঝবি না। বড় হ আগে।"

" দাদু, তোমার সাথে ওনার বিয়ে হয়নি কেনো ? "

" বাসায় মনে করিস। বলবো।"

এখন চিঠির অপেক্ষা। আজ পাবো পাবো করে বৃহস্পতিবার পেলাম। খাম খুলে দেখি ; হলুদ পাতায় লেখা " মৃত্যুর ডাক এসেছে।" সাথে কতগুলো কাগজ পাঠিয়েছে। ঘেটে দেখি প্রেসক্রিপশন। কর্কট রোগে আক্রান্ত।  আর তিন মাস।

নাতনী জিজ্ঞেস করলো, " চিঠি পেয়ে খুশি না হয়ে মন খারাপ করলে যে ! "

তাকে সব খুলে বললাম। আমার চোখে পানি দেখে, সে চমকে উঠলো।

একটা গভীর মমতার হাতের স্পর্শে খানিকটা ভরসা পেলাম মনে হলো। তবে, দীর্ঘশ্বাস প্রতিদিনের মতো চাপাই থাকলো।

 

 

 

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ