করোনাকালে মধ্যবিত্ত শব্দটা বহুল উচ্চারিত। আজকের মধ্যবিত্ত আর ৯০ পরবর্তী মধ্যবিত্ত, আকাশ পাতাল ব্যবধান। সেই নস্টালজিক জীবন থেকে আজকের জীবনের গল্পটা ধারাবাহিকভাবে লেখার ইচ্ছে পোষণ করছি। আজ ১ম পর্ব। আজ শুরু বলে প্রেক্ষাপট তৈরিতে একটু বড় করে লিখলাম। আগামী পর্বগুলো ছোট হবে।
.........৯০ পরবর্তী যারা কৈশোর তাদের জীবনের গল্পগুলো অন্য রকম। আজকের মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য যা খুবই সাধারণ, তখন তা ছিল ভাবনারও বাইরে।
মেহমান মিষ্টি নিয়ে বেড়াতে আসলে সেটাই ছিল মিষ্টি খাওয়ার দিন। বাচ্চারা অপেক্ষায় থাকতো মেহমান যদি ডেকে তাকে দেয়া মিষ্টির একটু ভাগ দেয়! কিংবা কখন মেহমান যাবে! তারপর ভাগে মিলবে মিষ্টি। তখন এক বাসায় মিষ্টি এলে চেষ্টা চলতো প্রতিবেশীদের বাড়িতে একটু পাঠানোর। একটু কম টাকাওলা মেহমান হলে নিয়ে আসতো পাইনাপেল বিস্কুট। আঙ্গুর-আপেল-কমলাও হয় মেহমান আনতো কিংবা কোন বড়লোকের বাসায় বেড়াতে গেলে দেখা মিলতো। গ্রামের বাড়ি থেকে যদি আম আসে! আজকের মতো মণ ধরে কেনার সুযোগ ছিল না। বড়জোর ফজলি আম ২/১ কেজি তাও বড়জোর ২/১ বার।
মুরগীর মাংস মানে এলিটনেস। গরীবের ঘরে রান্না হতো গরুর মাংস। গরীব মধ্যবিত্তের জন্য বাজারে ছিল চিংড়ি, কাচকি, মলা, ঢেলা, টাকি, শোল, বড়জোর রুই। আর ধনীরা খেতো পাঙ্গাস, কৈ। অসুস্থ ধনীরা খেতো শিং এর ঝোল। ইলিশ খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে যেত মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানেরা।
রোস্টের দেখা মিলতো শুধুমাত্র বিয়ে আর পিকনিকে। সে সময় সকালে রুটি খেলে মানুষ বলতো আহারে তারা রুটি খায়, অর্থাৎ ভাত খেতে পায় না। ডাল রান্না হলেও মানুষ তাদের নিয়ে আফসোস করতো, ভাবতো তরকারী কেনার অবস্থা নেই।
মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটা এমন ছিল যে, এক বাড়ির/বাসার মানুষ জানতো আরেক বাড়ির/বাসার লোকজনদের কার কি পছন্দের খাবার/তরকারী। ফলে এক বাড়িতে লাউ রান্না হলে, এক বাটি সেই বাড়ির কারোর জন্য চলে যেতো। একইভাবে অন্য বাড়ির পায়েস আরো দশ বাড়িতে।
তখন মধ্যবিত্তের ব্যাক্তিত্ব এবং আত্মসম্মানবোধ এতটা প্রখর ছিল যে, ৯০ এর মাঝামাঝি অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার, পুলিশ বা কাষ্টমস জাতীয় সেক্টরের কারো কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে চাইতো না শুধুমাত্র ঘুষ শব্দটার জন্য। লোক সৎ নাকি অসতের চেয়ে চাকরীর সেক্টরটা নিয়ে অসস্তিতে ভুগতো মধ্যবিত্তরা। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের উপর জরিপ করে এটা প্রতিবেদনও পত্রিকায় আসে এ ব্যপারে। মানুষও কথায় কথায় খোঁচা দিতে বলতো, মেয়ে জামাই তো তাহলে ভাল উপরি কামাই আছে! কেউ ঘুষ খেয়েছে এমন খবর এলে তার ছেলে-মেয়েরা লজ্জায় বাড়ির বাইরে আসতো না।
এমন হাজারো গল্প এবং সম্পর্ক আছে সে সময়টাকে ঘিরে। তারপর একদিন মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের সরলতায় লোভ নামক বিষবাষ্প ঢুকে যায়। 'উপরি কামাই' শব্দটাও জনপ্রিয়তা পায়। বিয়ের বাজারে বাড়তি দাম পেতে থাকে উপরি কামাইওলারা। টেবিলের নিচে নয়, উপর দিয়ে অনৈতিক লেনদেন শুরু হয়ে যায়। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে বর্তমানে ঘুষখোর বাবা-মায়ের সন্তানেরা তাদের বাবা-মায়ের এই অপকর্ম নিয়ে গর্বিত। তারা তাদের আয় এবং ব্যায়ের হিসেব কষে না। তারা জানে তাদের বাপ-মা চোর, দূর্নীতিবাজ। তবু তারা গর্বিত পিতা-মাতাকে নিয়ে।
আর এভাবেই একটি মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে একটি সমাজ, তারপর একটি দেশ দূর্নীতিতে ডুবে গেল। মধ্যবিত্তের অর্থ ছিল না, সম্মান ছিল। এখন অর্থ থাকলেও সম্মানের ঘরটা শুন্য।
চলবে....
২৩টি মন্তব্য
ফয়জুল মহী
অসাধারণ উপস্থাপন । লেখাটা। মুগ্ধতা নিয়ে পড়লাম, ভালো লাগলো।
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনি স্বর্নালী অতীত টাকে মনে করিয়ে দিলেন। খুব আফসোস হয় ঐ সময়টার জন্য। মিষ্টির কথা একদম ঠিক এমনকি ঈদ, পূজা আর পহেলা বৈশাখ ছাড়া কাপড় চোপড় ও কেনাই হতোনা। তখন জীবনযাপনে এতো চাকচিক্যের বাহাদুরি ছিল না। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন সবসময় শুভ কামনা রইলো
তির্থক আহসান রুবেল
শুভ কামনা
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
মানুষের জীবন যাপনের সুন্দর উপস্থাপনা। ধন্যবাদ।
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ
বন্যা লিপি
ভিন্নধারার বিষয় নিয়ে উপস্থাপন করেছেন সাবলীল ভাবে। একটানে পড়ে যাবার মতো।
ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
ছয় বছর পরে নতুন পোস্ট নিয়ে এলেন সোনেলায়। সময় কত দ্রুত চলে যায়।
আমাদের ছোটবেলার মধ্যবিত্তটা আসলে খুন হয়ে গিয়েছে। এমন কোনো দিন ছিলোনা যেদিন পারাপ্রতিবেশীদের সাথে রান্না ভাগ করা না হতো। আমাদের ফুফা পাইনেপেল বিস্কুট আনতেন যখন বাসায় বেড়াতে আসতেন। আম, মিস্টির উদহারন দিলেন, মনে হচ্ছে এটি আমারও উদহারন।
ঘুষ একসময় মধ্যবিত্ত জীবনের জন্য ছিল অসন্মানের। বর্তমানে ঘুষ হয়েছে গর্বের।
আগের সেই মধ্যবিত্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে নতুন এক অচেনা মধ্যবিত্ত জন্ম নিয়েছে।
ভালো লেগেছে লেখা। নিয়মিত লেখুন।
শুভ কামনা।
তির্থক আহসান রুবেল
হঠাৎ কাল রাতে মনে হলো নতুন কিছু লিখি। কয়েকটা পর্ব লেখার ইচ্ছে আছে। এখন দেখা যাক মন কতটা সাপোর্ট দেয়।
জিসান শা ইকরাম
লেখুন। লেখার আইডিয়া ভিন্নতর।
কামাল উদ্দিন
এখন সেই এলিটনেস মুরগী খায় নিম্নবিত্তরা, ধনীদের পাঙ্গাসও নিচের দিকে নেমে গেছে। আর যেই ইলিশ খেতে খেতে মধ্যবিত্তরা বিরক্ত হয়ে যেতো তা আজ বিলাসী খাবারে পরিণত হয়েছে। সব থেকে ভয়ঙ্গর যা তা হলো । টেবিলের নিচের জিনিস উপরে উঠে গেছে আর আমরা লোভী হয়ে গেছি…….লিখতে থাকুন, সাথেই আছি রুবেল ভাই।
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ
হালিম নজরুল
সময়ের সাথে সাথে জীবন ও জীবনের গতিপথ পাল্টায়। অতীত আমরা আর ফিরে পাব না। তবে বর্তমানকে যথাযথ মূল্যায়ন ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুন্দর পরিকল্পনা হয়তো আমাদের ভুলগুলো শুধরে দিতে পারে।
তির্থক আহসান রুবেল
স্বপ্ন দেখে যেতেই হবে। যতবারই ঘুম ভাঙ্গুক না কেন!!! স্বপ্ন ভাঙ্গতে দেয়া যাবে না।
তৌহিদ
দারুণ অনুভাবী একটি লেখা পড়লাম ভাই। আসলে মধ্যবিত্ত শব্দটির মধ্যে এক ধরনের মাধুর্যতা আছে। ছোট ছোট স্বপ্ন, আশা, ইচ্ছেপুরন, চাওয়া না পাওয়ার বেদনা এসব মিলিয়ে আমার কাছে সুখানুভূতির চরম প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। বড় চাওয়া এবং পাওয়ার পরে সেই সুখ অনুভূত হয়না বোধকরি।
এই প্রথম ব্লগে আপনার লেখা পড়লাম। অসম্ভব ভালোলাগা রেখে গেলাম। নিয়মিত লেখা পাবো আশা করি।
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ … চেষ্টা করবো নিয়মিত লেখার
আরজু মুক্তা
গতিপথ পাল্টে গেছে। এখন টাকাও নেই সম্মান নিয়েও টানাটানি মধ্যবিত্তের।
ভালো লাগলো
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ
সাবিনা ইয়াসমিন
নব্বইয়ের পরবর্তীতে কৈশোর পাড়ি দেয়া সেসব সোনালী দিনের কথা মনে পড়লে মনেহয় আমরা রুপকথার যুগে বেড়ে উঠেছি। তখন সকল আনন্দের মুলে ছিলো খেলার মাঠ, টিভিতে টিপু সুলতান,আলিফ লায়লার রোমাঞ্চকর ভুবন। নানা পদের ইলিশ-তরকারির অত্যাচারে, ক্রমাগত অতিষ্ঠ হয়ে উঠা প্রানে শান্তির পরশ নিয়ে আসতো তিন গোয়েন্দার অ্যাডভেঞ্চার সিরিজ। পাইন আ্যাপল বিস্কিটের প্যাকেট হাতে আনা মেহমানদের সেরা মেহমান মনে হতো। তখন ঘুষখোর / কালোবাজারী/ সুদখোর পেশার প্রকৃত মানে জানতাম না। শুধু বুঝতাম তারা খারাপ, তাদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। নয়তো সবাই আমাদেরকেও তাদের মতো খারাপ ভাববে।
সোনালী দিনের গল্প শুরু হলে অল্পতে শেষ হয় না,
চলুক, সাথে আছি আমরাও।
শুভ কামনা অবিরত 🌹🌹
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ। দেখা যাক কতটা চলতে পারি
এস.জেড বাবু
///মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটা এমন ছিল যে, এক বাড়ির/বাসার মানুষ জানতো আরেক বাড়ির/বাসার লোকজনদের কার কি পছন্দের খাবার/তরকারী। ফলে এক বাড়িতে লাউ রান্না হলে, এক বাটি সেই বাড়ির কারোর জন্য চলে যেতো। একইভাবে অন্য বাড়ির পায়েস আরো দশ বাড়িতে।
ঈদের দিন সকালে
সাতাশ রমজানের রাতে অনেক দৌড়েছি সেমাই, রুটি নিয়ে। মনে পড়ে গেল অনেক কিছু।
চাক্ষুস যারা দেখেনি ওদের চোখে কল্পকথা এই সেদিনের বাস্তবতা।
মুগ্ধতা লিখায়
ভালো থাকবেন ভাই
তির্থক আহসান রুবেল
ধন্যবাদ ….