বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এক বন্ধু ফোন দিয়ে বলল, শিল্পকলার দিকে যেতে— ওখানে সবাই উপস্থিত, আড্ডা জমে ক্ষীর! আরেকজনের কথায় আমি সহজে বিভ্রান্ত হই না। তবুও কী মনে করে বের হলাম,— আকাশে কিছুটা আঁধার নেমেছে, আর কিছুটা আলো তখনো আছে। শহরে গাছপালা কম থাকে, কিন্তু আমার বাসার এদিকটায় কিছু গাছ এখনো আছে, বিশেষ করে তালগাছ। সে-ই গাছগুলোকে দেখে মনে হল, এরা পাগল হয়ে গেছে— ঝড় ওঠেছে, প্রচুর বাতাস। ঠিক এই সময়, পৃথিবীকে রহস্যজনক মনে হবার কথা; আমারও মনে হল। একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। এ'রকম অবস্থায় আড্ডা দিতে যাওয়ার কোন মানে হয় না, এটা একান্তই নিজস্ব সময়। আমি গন্তব্য বদলে ছাদে ওঠলাম, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নামছে, আর লোপামুদ্রা মিত্র ঠিক এমন সময় গাইছেন—
'... তুমি যদি না দেখা দাও,করো আমায় হেলা / কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল বেলা ...'
কেন জানি না, মাঝেমাঝে এই চার লাইনের ভেতর নিজেকে অন্যভাবে আবিস্কার করি, তারপর খুব অবাক হই। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারটি ছোট গল্প পড়লাম, গল্পগুলো হল— 'নিশীথে, অধ্যাপক, ডিটেকটিভ, এবং সম্পাদক।' এর মধ্যে অধ্যাপক দুর্দান্ত লেগেছে। এখনও অনেকটা প্রাসঙ্গিক, আঁতেলের গল্প তো! আর নিশীথে ভুতের গল্প অথচ ভুত নেই।
ভুত ছাড়া ভুতের গল্প ক'জনই বা লিখতে পারেন?
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর কিছু মানুষ ধারণা করতেন যে, সব শেষ, আর কিছু হবে না। সে জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরা যখন লিখতে এলেন, নিয়মিত রবীন্দ্রনাথকে ধাক্কা মারতেন। ওঁর একটা পঙক্তি আছে— 'তিন জোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্র রচনাবলী মাটিতে লুটোয় ..'
সম্প্রতি আমি এই পঙক্তি লেখার ইতিহাস খানিকটা উদ্ধার করেছি, বলছি,— তারাপদ রায়ের বাড়িতে সুনীল, শক্তি এবং আর কেউ কেউ আড্ডা মারতেন। সেখানে ওঁরা খাটে ঠেলাঠেলি করে শুতেন। তো, তারপদ রায়ের বইপত্তর খাটেই ছড়ানো থাকতো, সুনীলরা লাথি মেরে বইগুলো ফেলে দিতেন। সেখান থেকেই— 'তিন জোড়া' ব্যাপারটা এসেছে। ছোটবেলায় একটা সংস্কার থাকে, বইতে পা দিলে নমস্কার করতে হয়, সে-ই সংস্কারের ওপর লাথি মারার জন্যই বই ফেলে ফেলে দেয়া!
এই কয়েকদিনে বেশ কিছু ভুতের গল্প পড়া হয়েছে। যেমন,— একটি ভৌতিক কাহিনী (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়), মহেশের মহাযাত্রা (পরশুরাম), ডাইনী (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) এছাড়াও সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের বেশ কিছু গল্প পড়েছি, তাঁর অসাধারণ ভৌতিককাহিনী সমগ্র থেকে।
শ্রীউপেন্দ্রনাথ ঘোষ ছুটিতে বাড়ি গিয়েছেন, ছুটি শেষ, যেদিন ফিরে যাবেন, সেদিন রামপ্রসন্ন মজুমদারের সঙ্গে দেখা— তিনি বললেন, বাবা আজ না গেলে হয় না? কাল যেও। উপন্দ্রের নতুন চাকুরী, তাই তার চলে যেতে হয়। বিকেলের দিকে তার মা একজন লোক পাঠায়। সেই লোকের হাতে একটি কবচ ও চিঠি। মা লিখেছেন,— 'তুমি বাড়ি হইতে যাত্রা করিবার পর রাম প্রসন্ন মজুমদার মহাশয় আসিয়াছিলেন এবং একটি কবচ দিয়া বলিলেন—'মা তোমার ছেলে আজ প্রাতে সিউড়ী রওনা হইয়াছে পথে তাঁহার সঙ্গে দেখা হইল, তাঁহার জন্য আমি এই রামকবচ আনিয়াছি, তুমি যেমন করিয়া পার আজই এই কবচটি তোমার ছেলেকে পাঠাইয়া দাও এবং বিশেষ করিয়া লেখো যেন আজই সে কবচটি ধারণ করে।'' সে-রাতেই উপন্দ্রনাথ বিপদে পড়েন, তাই কোন বিপদে পড়েছিলেন তা জানতে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের— 'একটি ভৌতিক কাহিনী' গল্পটা পড়ে নিতে হবে।
মহেশ মিত্তির ঘোর নাস্তিক, ভুত বিশ্বাস করেন না। আর তার বন্ধু হরিনাথবাবু ঘোর আস্তিক এবং ভুত বিশ্বাস করেন। তিনি বন্ধুকেও ভুত বিশ্বাস করাতে চান। দুজনই শিক্ষক মানুষ। এক রাতে হরিনাথবাবু মহেশকে ভুত দেখাতে নিয়ে যান, সেখানে গিয়ে দেখলেন একটি কালো মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, দূরে আরও দুয়েকটি মূর্তি দেখা যাচ্ছে। হরিনাথ বাবু রামরাম করছেন এমন সময়— একটি মূর্তি নাকী সুরে বলল,— 'মহেশ বাবু আপনি নাকি ভুত বিশ্বাস করেন না?' মহেশবাবু ভুতের কাঁধ খামচে ধরে বললেন, 'কোন ক্লাস?' ভুত উত্তর দিল, 'সেকেন্ড ইয়ার স্যার।' আসল ভুত যারা আশেপাশে লুকিয়ে ছিল তারা মনে মনে বলল— 'আজি রজনীতে হয় নি সময়।'
তারপর বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে মহেশ হরিনাথবাবুকে ডেকে পাঠান, দশ হাজার টাকার উইল ভার্সিটিকে দিয়ে যান, আর বলেন এর সুদ থেকে প্রতিবছর একটা পুরস্কার দিতে হবে। যে ছাত্র ভুতের অনস্তিত্ব সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ লিখবে সে ওই পুরস্কার পাবে। এরপর মহেশ মারা যান, তাকে সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু যত সময় পার হচ্ছে, মহেশের ওজন ততো বাড়তে থাকে, একসময় ..,— না, আর বলা যাবে না। লেখক পরশুরাম (রাজ শেখর বসু) এর রসবোধ এমনিতেই অসাধারণ, তাই 'মহেশের মহাযাত্রা' পড়ে নেয়া জরুরী।
পরশুরামের গল্পসমগ্রের ভুমিকা লিখতে যেয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— 'পিতৃদত্ত নামের উপর তর্ক চলে না। কিন্তু স্বকৃত নামের যোগ্যতা বিচার করিবার অধিকার সমালোচকের আছে। পরন্ত অস্ত্রটা রূপধ্বংসকারীর, তাহা রূপ সৃষ্টিকারীর নহে। পরশুরাম নামটা শুনিয়া পাঠকের সন্দেহ হইতে পারে যে লেখক বুঝি জখম করিবার কাজে প্রবৃত্ত। কথাটা একেবারেই সত্য নহে। ...'
ডাইনী এবং তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প নিয়ে কিছু বলার নেই। এতে গল্পের স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আজ সোনেলায় ঢুকলাম একটা গল্প প্রকাশ করার জন্য। গল্পের দিকে না যেয়ে দিনলিপি লেখা শুরু করলাম। সেটাও হল না, দিনলিপির ভেতর ভুতের গল্প নিয়ে কচকচানি শুরু করলাম। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না!
সবাই ভালো থাকুন।
*৮ এপ্রিল, ২০১৬
Thumbnails managed by ThumbPress
৬টি মন্তব্য
আবু খায়ের আনিছ
একটি ভৌতিক কাহিনী (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়), মহেশের মহাযাত্রা (পরশুরাম), ডাইনী (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), তারানাথ তান্ত্রিকের গল্প (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়) এছাড়াও সৈয়দ মুস্তফা সিরাজের বেশ কিছু গল্প পড়েছি। আমিও তাই।
তারানাথ তান্ত্রিক তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্পগুলোও অনেক ভালো লেগেছে।
মহেশ এর মহাযাত্রায় লাশ কাধেঁ করে নিয়ে যাওয়ার সময় যে বর্নণাটা দিয়েছেন লেখক, অসাধারণ। ভয় না পাওয়া মানুষগুলোও ভয় পাবে এমন পরিস্থিতিতে পড়লে।
আপনার আড্ডার কথা শুনে লোভ হয়, যদি পারতাম এমন আড্ডায় থাকতে।
নাজমুস সাকিব রহমান
হা হা, আপনি কোথায় থাকেন? আপনার সঙ্গে আড্ডায় বসতে হবে দেখছি
শুভেচ্ছা নেবেন।
আবু খায়ের আনিছ
আমি মিরপুর ১ এ থাকি।
নাজমুস সাকিব রহমান
আপনি আমাকে ফেসবুকে একটা এড দিতে পারেন, Nazmus saqeeb Rahman নামে আছি।
খসড়া
খুব আধুনিক লেখকের ভুতের বই ভুত সমগ্র। মোঃ জাফর ইকবাল।
অতীতের সময়কে ধরে যেমন তাদের অনবদ্য রচনা তেমনি এই সময়ের রচনা ভূত সমগ্র।
নাজমুস সাকিব রহমান
ঠিক বলেছেন।