এই ভাবি! কেমন আছেন? আপনি তিন তলায় উঠেছেন না?
হন্তদন্ত হয়ে অফিস যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে গেইট পার হবো, এমন সময় পেছন থেকে ডাক। ফিরে তাকালাম। দেখলাম প্রায় আমার সমবয়সী এক ভদ্রমহিলা বাচ্চাকে নিয়ে সম্ভবত স্কুলে যাচ্ছেন। বললাম
-হ্যাঁ, আপা। আপনি?
-পাচঁ তলায় উঠেছি।
-ও, তাই?
-কোথায় যাচ্ছেন?
-অফিসে।
-ও, আপনি জব করেন? তাইলে তো তাড়া আছে।
-হ্যাঁ, একটু। সমস্যা নেই, ইনশাহআল্লাহ দেখা হবে। বাসায় আসবেন।
-হ্যাঁ, আপনিও আসবেন।
আরো কয়েকদিন পর সন্ধ্যার সময় বাড়ির গেইটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। গেইট ভেতর থেকে তালা দেয়া কিন্তু কেয়ারটেকার আশেপাশে নেই। হাতে চাবিও ছিলো না। এখন থেকে সম্ভবত গেইটে তালা থাকবে, এখনো চাবি বুঝে পাই নি তাই অপেক্ষা। খানিকপর আবার সেই প্রতিবেশী ভদ্রমহিলা। এবারও সঙ্গে বাচ্চা, তবে দুটু। দেখেই আমি হাসি দিযে জিজ্ঞাসা করলাম
-কেমন আছেন?
-ভালো। আপনি কেমন আছেন ভাবি?
-ভালো আপা। আপা, আমার নাম রুবা। আমাকে এ নামেই ডাকবেন।
-কি বলেন আপা, নাম ধরে ডাকবো?
-কেনো নয়? আচ্ছা, তাহলে আপাই বলুন।
-আচ্ছা। স্মিত হেসে সম্মতি।
বুঝা যাচ্ছিলো ভদ্রমহিলা ’আপা’ সম্বোধনে অভ্যস্থ নয় বলে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। আমি প্রসঙ্গটা পাল্টাতে বাচ্চাদের দিকে মনযোগী হলাম।
-কেমন আছো তোমরা? কি নাম তোমাদের?
-তানিয়া
-আন্টি, আমি তাসনীয়া।
-বাহ! খুব সুন্দর নাম।
এমন সময় কেয়ারটেকার এসে হাজির। তালা খুলে দিলো। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। কেয়ারটেকার জানালো রাতে সবাইকে একটা করে চাবি দিয়ে দেয়া হবে। উপরে উঠে আমার ফ্লোরে আসার পর প্রতিবেশী আপাকে অনুরোধ করলাম বাসায় আসতে, পরে একদিন আসবেন বলে চলে গেলেন।
বাসা শিফট করলাম আজ প্রায় ৫ মাস। ফুলটাইম জব করার কারনে আশেপাশের ফ্ল্যাটের সবার সাথে সেরকম ঘনিষ্টতা তেমন হয়ে উঠেনি। আসা-যাওয়ার পথেই সবার সাথে দেখা। এই রমজান আসার পরেই ফ্ল্যাটের অন্যান্য পরিবারগুলোর সাথে কমবেশি দেখা-সাক্ষাত, আদান-প্রদান হচ্ছে। এর মধ্যে খেয়াল করে দেখলাম সমবয়সী সবাই একে অপরকে ভাবি সম্বোধনে ডাকছেন আবার গুটি কয়েকজন আপাও শুধাচ্ছেন কিন্তু আমাকে সবাই আপা বলেই সম্বোধন করছেন।
এর আগে যে বাড়িটিতে ছিলাম, সেখানে সমবয়সী আমরা একে অপরকে নাম ধরেই ডাকতাম অথবা ছোটবড় হলে আপা বলে সম্বোধনটা ছিলো। আর আমাদের থেকে আরেকটু সিনিয়রদের দেখতাম কেউ কেউ একে অপরকে ভাবি বলছেন, আবার কেউ কেউ আপা বলেই ডাকছেন।
এবার আসা যাক স্কূলগুলোতে। আমাদের সময়ে স্কুলে কোন কারনে যদি অভিভাবকের প্রয়োজন দেখা দিতো তবে অভিভাবক হিসাবে বাবাকেই স্কুলে যেতে হতো। কখনো মা সন্তানের স্কুলে যাবেন তা ভাবাই যেতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অনেক কিছু পাল্টে গেছে। আগে মা-বাবা নিশ্চিন্তে সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে দিতেন। সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে বা সন্তানটি বখে যায় কি না তা নিয়ে মা-বাবার কোন চিন্তাই ছিলো না। সে দিনগুলো এখন আর নেই। এখন সন্তানকে একা বাইরে পাঠালে মা-বাবাকে সর্বদাই উৎকণ্ঠায় কাটাতে হয়, কখন কোন বিপদে আবার পড়ে যায়। তাই সময়ের প্রয়োজনে সন্তানের পেছনে অভিভাবককে আঠার মতো লেগে থাকতে হয়। সব বাবার পক্ষে তো আর নিত্যদিন তা সম্ভব নয় তাই সে দায়িত্বটা স্বাভাবিকভাবেই মায়ের উপর বর্তায় আর সে কারনেই হয়তো স্কুলগুলোতে যে পরিমান ছাত্র-ছাত্রী দেখা যায় অনেকটা সে পরিমানই মায়েদের সমাবেশ ঘটতে দেখা যায়। খুব স্বাভাবিকভাবেই আগেকার মায়েদের তুলনায় এখনকার মায়েরা শিক্ষা-দীক্ষায়, সচেতনতায় অনেক এগিয়ে। এখনকার অনেক মা আবার চাকরী-বাকরীও করছেন।
আর তাই বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষা এবং সচেতনতার দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে প্রশ্ন উঠতেই পারে এখনো কেনো নারীকুল একে অপরকে দেখলে ’ভাবি’ সম্বোধন করেই কথা বলেন যেখানে ভাইটিকেই তাঁরা চিনেন না। এখনো কেনো নারীরা তাঁদের স্বকীয়তা খুঁজে পান না? আত্ম-পরিচয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন না? স্কুলটিতে আপনার প্রথম পরিচয় আপনি অমুকের ’মা’ কারন এখানে সন্তানকে কেন্দ্র করেই আপনি। কিন্তু ব্যক্তি আপনার সম্বোধনে ’ভাবি’ আসবে কেনো? ’আপা’ নয় কেনো? বিবাহিত হলেই কি আপনাকে বাধ্যতামুলক সব জায়গায় ’ভাবি’ হয়ে যেতে হবে? ব্যক্তি আপনার পরিচয় অন্য পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যেতে হবে? বিয়েটা সামাজিক এবং ধর্মীয় বন্ধন। বিয়ে নামক চুক্তির মাধ্যমে নারী-পুরুষ একসাথে সমাজে বিচরন করেন। বিয়ের মাধ্যমে শ্বশুড়বাড়িতে আপনি অমুকের স্ত্রী বলে আপনার পরিচয় ভাবি বা অমুকের বউ। সেটা সুন্দর এবং সঠিক। যেমন করে আপনার পরিবারে আপনার স্বামী কারো দুলাভাই বা কারো কাছে অমুকের জামাই। এমনকি স্বামীর নিজস্ব গণ্ডির মধ্যেও আপনি স্বামীর পরিচয়েই পরিচিত হবেন কিন্তু অন্য পরিবেশে? যেখানে আপনার স্বামীকে আগে থেকে কেউ জানেই না সেখানে? সেখানে কেনো আপনি আত্ম-পরিচয়ে দাঁড়াচ্ছেন না?
ভাবুন এবং স্বকীয়তা বজায় রেখে নিজের ’আমিত্ব’কে আবিষ্কার করুন।
এ বিষয়ে লিখার চিন্তাটা মাথায় আসলো ”চ্যানেল আই”তে কেকা ফেরদৌসির রান্নার প্রোগ্রাম থেকে। প্রতি রমজান আসলেই তিনি এই প্রোগ্রাম করেন। সারা রমজান মাসজুড়ে একেক জায়গায় একেকটি রান্নার প্রোগ্রাম আয়োজন করেন আর একেকদিন একেকজন ভাবিকে এনে উপস্থিত করেন। যদিও যে ভাইদের কেন্দ্র করে এই ভাবিদের নিয়ে আসছেন, সে ভাইদের কিন্তু আমরা দেখতে পাই না। এখানেও আমার প্রশ্ন যে অনুষ্ঠানটি বিশ্বব্যাপী সকল বাঙালী দেখছেন সেখানেও এই অসঙ্গতি কেনো?
এ লিখাটির মাধ্যমে আমি ”চ্যানেল আই”রও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
৩২টি মন্তব্য
আদিব আদ্নান
ভাবনাটি যৌক্তিক ই মনে হচ্ছে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ ভাইয়া।
অনিকেত নন্দিনী
আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সংসার জীবনে ঢোকার পর আমরা আমাদের অনেক অনেক স্বপ্ন-সাধের সাথে সাথে আমাদের আমিত্বকেও বিসর্জন দেই।
কেউ ভাবী বলে ডাকলে নিজের আমিত্বর অনুপস্থিতি খেয়াল না করে উল্টো আহ্লাদিত হই।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
যেখানে আমি আসলেই ’ভাবি’, সেখানে আহলাদিত হযে উঠা দোষের নয়, বরং পজিটিভ কারন স্বামীর বাড়ির সাথে আমার সম্পর্কটাই এমন।
কিন্তু সর্বত্রই কেনো আমি আমার অস্তিত্বকে অন্য একটি পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যেতে দেবো?
জিসান শা ইকরাম
ভালো একটি প্রসঙ্গ নিয়ে এলেন লেখায়।
অত্যন্ত যৌক্তিক।
এতদিন এ নিয়ে সামান্য চিন্তাও করিনি।
স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে এবং অর্জন করতে হবে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক তাই।
বৈবাহিক সম্পর্কটা হচ্ছে পাশাপাশি দুজন হাত ধরে জীবনের পথে এগিয়ে চলা। হাত ধরে এগিয়ে চলা মানে এই নয় যে নিজের আলাদা স্বত্তাকে বিলীন করে ফেলা।
স্বপ্ন
অচেনা ভাইয়ের বউ হিসেবে চেনা নারীকে ভাবি সম্মোধন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এর ধারাবাহিকতা।ভাল লিখেছেন আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সাথে সাথে নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতাও অর্জিত হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে পুরুষতান্ত্রিক ধ্যান-ধারনায়ও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। কাজেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবোধই যদি জাগ্রত না থাকে তবে পার্থক্য তো থেকেই যাবে।
সীমান্ত উন্মাদ
আমার কাছে অনেকের মতই যোক্তিক মনে হয়েছে লিখাটা, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বেবস্থা বনাম নারীর সর্বক্ষেত্রে স্বকীয়তা বজার রাখার ব্যাপারে আপনার লিখার উপস্থাপনায় বেশ ভালোভাবেই মনে করিয়ে দিচ্ছে যে এখনো অনেক কিছু শিক্ষার এবং করার এবং তা অভ্যাসে পরিনত করে চলার বাকি আছে আমাদের।
অনেক অনেক শুভকামনা জানিবেন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অসঙ্গতিগুলো দূর করতে হবে, তবেই পুরুষতান্ত্রিকতার জগদ্দল পাথরটা আস্তে আস্তে সরে যাবে।
শুন্য শুন্যালয়
খুব ভালো একটা লেখা আপু। আমরা যে আমাদের আমিত্ব কে নিয়ে ভাবছি অনেকে এটাই তো এগিয়ে যাওয়া। একদিন ঠিকই সব পাল্টে যাবে। অন্ধকার একটা যুগ থেকে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখেছে সেই কবে, আজও আমরা অন্ধকার দূর করতে পারিনি। তবে নিশ্চয়ই পারবো একদিন। আপনার পোস্ট মানেই কিছু ভাবনায় এগিয়ে যাওয়া। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ধন্যবাদ আপু। চাপিয়ে দেওয়া, মননে গেথেঁ দেওয়া ত্রুটিগুলো এক এক করে দূর করতে হবে
মেহেরী তাজ
সত্যি কথা তো! এটা আসোলেই একটা অসঙ্গতি।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হুম, অসঙ্গতি তো বটেই।
ব্লগার সজীব
নিজকে জানুন সবার আগে এবং আত্মবিশ্বাসি হোন।ভাল লিখেছেন আপু।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
হিলিয়াম এইচ ই
ভাল্লাগছে
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ 🙂
খেয়ালী মেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে লিখেছেন আপু—আপনার সাথে আমিও একমত–এখনো কেনো নারীরা তাঁদের স্বকীয়তা খুঁজে পান না?…অনেক নারী আবার নিজের স্বকীয়তা খুঁজতে চায়ও না…খুব অবাক লাগে যখন দেখি অনেক শিক্ষিত প্রতিষ্ঠিত নারী নিজেকে স্বামীর পরিচয়ে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে…..
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, বিষয়টা আমিও খেয়াল করেছি। আরে, স্বামীর প্রতি সন্মান তো থাকবেই কিন্তু নিজেকে বিলীন করে কেনো? নিজের আত্মমর্যাদাবোধ বজায় রেখেও তো করা যায়।
আমার কাছে ব্যাপারটা হাস্যকর লাগে।
খেয়ালী মেয়ে
হুমমমম আমার কাছেও ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হয়….
মিথুন
এমন ভাবনার জন্য হ্যাটস অফ আপু। (y)
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ধন্যবাদ আপু। 🙂
মোঃ মজিবর রহমান
এত সুক্ষভাবে ভাবি নাই।
এত সুক্ষমেধাও হইত নাই।
দারুন পয়েন্ট।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
হ্যাঁ, পয়েন্ট আউট করাটা সময়ের প্রয়োজন। নিজের আমিত্বকে আবিষ্কার করতে পারলেই নারী অনেকটা এগিয়ে যাবে।
ইমন
মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। 🙂
মারজানা ফেরদৌস রুবা
কেনো? মুল্যবান মন্তব্য আশা করছি। বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিয়ে সকলেরই মন্তব্য/মতামত জানা জরুরী।
ব্যাপারটা কেবল নারীকেন্দ্রিক ভাবলে হবে না। সমাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা যে এখনো একটা পুরুষতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে ঘোরের মধ্যে পড়ে রয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে।
নুসরাত মৌরিন
ভাল লিখেছেন আপু।প্রতিটা মেয়েরই একটা আত্মপরিচয়ের জায়গা থাকা চাই।মেয়েরা নিজের পরিচয়ে পরিচিত হোক,নিজের পায়ে দাঁড়াক-এটাই হোক প্রতিটা নারীর ব্রত।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক তাই, মৌরিন।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
ঠিক তাই।
লীলাবতী
আপু আপনার ভাবনার গভীরতা আছে।আমিও আমাকে ভাবি ডাকতে দেবো না।যদি আমার বরকে চেনে তখন ভিন্ন কথা।আমার সাথে পরিচিত জনদের অবশ্যই আমাকে নাম বা আপা বলতে হবে।অত্যন্ত ভাল পোষ্ট (y) -{@
মারজানা ফেরদৌস রুবা
মুলতঃ আমাকে যখন যেখানে যেমন মানায় আমি সেখানে তেমনই থাকতে চাই। আমার বরকে কেন্দ্র করে যে সম্পর্কগুলো গড়ে উঠেছে সেখানে সে সম্পর্কতেই আমি কমফোর্ট ফিল করি বাট অন্য জায়গায় আমি আমার স্বকীয়তা বজায় রাখতে চাই এবং মনে করি প্রতিটা নারীরই এমন স্বকীয়তাবোধ থাকা উচিত।
আর নারী অগ্রগতির প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত সবার মাঝে এই বোধকে জাগ্রত করা।