ভাঙ্গা নদীর নাঙ্গা রূপ

নিবিড় রৌদ্র ২৫ মার্চ ২০২৩, শনিবার, ১১:৪১:২১পূর্বাহ্ন সাহিত্য ২ মন্তব্য

হুঁকার আগুন প্রায় নিভিয়া আসিতেছে। শুক্রবারের সন্ধ্যায় শুক্র গ্রহটির এই নিম্নগামী দশা দর্শন করিয়া- গভীরতা কিছুই না বুঝিয়া সন্তোষচরের শ্রীমান শুক্কুর চন্দ্র দাস স্থবির হস্তে তাহার ডিঙ্গি নৌকার চোদ্দতালির পালখানি তুলিয়া পুবের হাওয়ার তোড়ে হাওড়ের পশ্চিমের পানে নৌকাখানি ছাড়িয়া দিয়া খানিকটা তামুক টানিয়া লইলো। হুঁকার আগুন টিক্কা-তামাকসমেত সর্ব ও শেষ শক্তি খরচ করিয়া আরেকবার ফরফরাইয়া জ্বলিয়া উঠিয়া আবার নিভিয়া গেল।

জালে আজ হাঁটে বেচা তো দূর কি বাত খাওয়ার মতন মাছও পড়েনি। শুক্কুরের মন তাই বেজায় বিষণ্ন, মাথার ওপর চিন্তার মেঘ উঁকি দেয়। ঘন ও জমাট হইয়া ঘূর্ণিপাক খায় ঝাঁকবান্ধা কালো মেঘ। আজকের বাজারে ষাট টাকাতেও এককেজি চাল পাওয়া দুষ্কর, এই কথা মনে হইলেই বিদ্যুৎ চমকে। হাওড়ের দেড় বিঘা ক্ষেতের আধফলা অল্প খোরাক ফুরিয়েছে গতমাসেই! আকাশে ভাসমান মেঘের উড়াউড়ি দেখিয়া শুক্কুরের মনও অগত্যা এই অবসাদে কেমন যেন উড়িতে চায়। উড়ে উড়ে মাছরাঙ্গা, চিলের মত মাছের সন্ধান করিতে চায়। ওহারা যেমন মাছের দিশা ভেদ করিয়া জলে ঝাপাইয়া চোখের পলকে স্বদম্ভে মাছ তুলিয়া সবেগে উড়িয়া যায়, শুক্কুরও উড়ে উড়ে সেই দিশার সন্ধান চায়। তারপর মানুষের মতন গভীর জলের মাছ ধরিতে চায়।

মানুষের কুলে জন্মিয়া অকূলে ভাসিবার অভ্যাস তার জন্মগত, কর্মগত এবং মর্মগত। কিন্তু শুক্কুর পাখির মতন উড়িতে চায়, মেঘের পাখায় চড়িবার ইচ্ছা নিয়া। পাখিদের সার্বভৌমত্ব আছে, শুক্কুরের নাই। চারিদিকে রোধের প্রাচীর, বোধের প্রাচীর, ঈর্ষা ও ক্রোধের প্রাচীর। শুক্কুর কি তবে এই সকল সীমানা পাখি হইয়া পাখির মতন ডিঙ্গাইতে চায়? জলের ভারে ঢেউ যেমন করিয়া পাড় ভাঙ্গে, তেমনি সেও কিছু একটা ভাঙ্গিতে চায়। অভাবের ভারে স্বভাবে নদীর মতন তুমুলভাবে ভাঙ্গিতে চায়।

কী ভাঙ্গিতে চায় শুক্কুর? নিয়ম নাকি অনিয়ম? এই সমস্ত প্রশ্ন ভাঙ্গিয়া উত্তর বাহির করিতে পারে না সে। তাই তাহার আর ভাঙ্গা হয়ে উঠে না কোনদিন কোনকিছু। তবু প্রতিনিয়ত কত কিছুই সে ভাঙ্গিতে দেখিয়াছে নিজের চোখেই। স্বপ্ন, গাছ, নদীর পাড়, সংসার, মন, হাঁট, দেশ, আইন, পাহাড়- ক্রমাগত এসব ভাঙ্গার দৃশ্য দেখিবার অভিজ্ঞতা শুক্কুরের স্মৃতিতে ডাকঘরের ভাণ্ডারে পুরনো খাতাপত্রের জঞ্জালের স্তুপের মতন জমিয়া আছে। পেট মোটা পচা মরা কাতলা মাছ আকারের বইয়ের পৃষ্ঠা ভাঙ্গিয়া বিশেষ তথ্য চিহ্নিত করিয়া রাখিবার মতনই গাঁথা আছে সেসব শুক্কুরের মোটা ও প্রবীণ গোল মাথাটিতে। খুব বেশিদিন আগের কথা না, এই তো গেল বছরের আগের বছরও কী জানি এক ঝড়ের কবলে তার ঘরের চালা উড়িয়াছে, খুঁটি নড়িয়াছে, নৌকার পাটাতন ভাঙ্গিয়াছে, যেন প্রস্তর যুগের মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টিতে সমস্ত ধান ডুবিয়াছে, জমি ভাঙ্গিয়াছে- সবই মনে আছে তাহার, ঝড়ের নামটি ছাড়া।

রাত্রি বাড়িতেছে। বৃষ্টি আসন্ন। অন্ধকার ক্রমশ গাঢ় হইয়া ছড়াইয়া পড়িতেছে নদীর দুই ধার ছাড়াইয়া সমগ্র হাওড়ে । নিভন্ত হুঁকার ঠোঁট হইতে নিজের পোড়া ঠোঁট নামাইয়া শুক্কুর চন্দ্র নৌকার হাল ধরে। হালের তালে তালে ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ উঠিয়া মিশিয়া যাইতে থাকে ভাঙ্গা নদীর দুই পাড় ঘেঁষিয়া, শুক্লা তৃতীয়ার চন্দ্রতলে। শুক্কুরও ভাঙ্গিতে চায়। ঠান্ডা হাওয়ায় গরম শ্বাস ছাড়িয়া সে আসমান পানে তাকায় আরেকবার। ভাঙ্গার কথা ভাবে; শূন্য জাল, ভাঙ্গা হাল, ভাঙ্গা জীবন নিয়া ভাঙ্গা নামক এক হাওড় পল্লীর নদীতে ভাসিতে ভাসিতে শুক্রের বিন্দুটিকে একটি খণ্ড স্বরূপ দেখিতে পাইয়া শুক্কুর চন্দ্র ভাবে- আজ বোধয় স্বয়ং চন্দ্রদেবও ভাঙ্গিয়া খসিয়া পড়িয়াছে।

 

. . . . .

১৭৯জন ৬৫জন
0 Shares

২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ