বোবা ভাষা (পর্ব- ০৪)

এস.জেড বাবু ২০ জুন ২০২০, শনিবার, ০৮:৪৮:১০অপরাহ্ন গল্প ১৬ মন্তব্য

 

ঘরে চারজন মানুষ অথচ কোনও সাড়া শব্দ নেই। একজন থেমে গেছে শুরুর আগেই। যার কোনও নাম হয়নি, হবেও না। নামের দরকার ও নেই, জীবন থাকলে নাম পরিচয় দরকার, সুনাম বা দুর্নামের প্রয়োজনে। মৃতদের নামের দরকার হয়না। বাচ্চাটা জন্মেছে লাশ হয়ে, লাশ হয়েই কবরে যাবে। এখন শুয়ে আছে মেহগনি কাঠের চকচকে পলিশ করা সেন্টার টেবিলের কাঁচের উপর, মায়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে।

ঠিক জড়িয়ে নয়, শাড়িটা বাচ্চাটার গাঁয়ে কেমন যেন পেঁচিয়ে আছে। মায়া অনুভব করেন মরদেহটার নানী। কাছে এগিয়ে গিয়ে শরীরে জাপটে থাকা কাপড়টা কিছুটা আলগা করতে চেষ্টা করেন। কি সুন্দর তুলতুলে ছেলে বাচ্চার মুখ, খানিকটা বেশি সাদা। মোবাইলের কেমেরা অন করে থমকে যান মাকসুদা বেগম। না, ছবি তোলা যাবে না। এই ছবিটা মেয়ে রীতার ভবিষ্যত জীবনে শুধু কান্না ডেকে আনবে।

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন মাকসুদা বেগম। নিকশ কালো অন্ধকার, খানিক দুরের রক্তজবার গাছটাও দেখা যাচ্ছে না। তবুও মাকসুদা বেগম অনেক কিছুই দেখছেন। বাস্তবতা যখন চারপাশ থেকে অথৈ জলের গভীরতার মতো নিঃশ্বাস চেপে ধরে, অন্ধকার তখন হৃদয়ের দর্পন হয়ে উঠে। কখনও সে আয়নায় অতীত জীবনের যোগ বিয়োগ ফলাফল খুঁজে দেখা হয়- আর কখনও নিকটতম ভবিষ্যতের অনাগত সরল অংকের সমাধান খোঁজা হয়। মাকসুদা বেগম অন্ধকারের কাছে শান্তনা খুঁজছেন। নিজেকে সাবলীল রাখার মতো শান্তনা।

বুক ভরে কান্না করতে না পারার কারণে জীবনের এই কঠিনতম সময়ের সমস্ত যন্ত্রনা আটকে আছে মাকসুদা বেগমের চোখে। কান্নার ও হয়তো কিছুটা উষ্ণতা আছে, জল না গড়ালেও ভিজে আছে পাঁপড়ি। ড্রেসিং এর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের চশমাটা খুলে- নিজের চোখে জলের অস্তিত্ব খুঁজছেন তিনি।

চড়চড় শব্দে ষ্টিলের বাটিতে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। বৃদ্ধা কাজের বুয়া ঘরে এসেছে রাত এগারোটায়। মাকসুদা বেগম ফোন করে ডেকেছেন।  রীতার অচেতন দেহটা দুইজনে মিলে শোবার ঘরে স্থানান্তর করে কিচেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে করতে রাত একটা বেঁজে যায়। সেই থেকে বুয়া হাল্কা গরম জলে কাপড় ভিজিয়ে রীতার কপাল মুছে দিচ্ছে। অনবরত কান্না করছে বুয়া। রীতাকে সেই ছোটকাল থেকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন। আপন না হলেও, বেঁচে থাকলে বাচ্চাটা ওর নাতী ই হতো।

আলতো শব্দে ভাইব্রেশন এর সাথে ফোন বেঁজে উঠে।

কেমন আছেন মা ?

— ভালো, শুষ্ক জবাব দিলেন মাসুদের শাশুড়ি।

আমার ফ্লাইট ছয় ঘন্টা ডিলে হয়েছে, আমি দুবাই এয়ারপোর্টে আছি। ঢাকায় পৌঁছুতে সাতটা বেঁজে যাবে। দুপুরের আগেই বাসায় পৌঁছে যাবো।

—ঠিক আছে

আপনারা ঘুমিয়ে পড়ুন।

—আচ্ছা

মা

—বলো

এইবার কিন্তু আমার একটা বিশাল সারপ্রাইজ চাই।

—অবশ্যই বাবা।

মা, ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে, এখন রাখি। কাল দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।

কলিং মেশিন থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বুকপকেটে রেখে অনেকটা দৌড়ে দুইশত উনত্রিশ নাম্বার গেইটের দিকে যাচ্ছে মাসুদ। একটা মিসটেক হয়ে গেছে, রীতার কথা জানতে চাওয়া হয়নি। জানা হয়নি তার সন্তান দুনিয়ার আলো দেখেছে কি না। পরক্ষনেই ভাবলো, থাক- কাল দেখা হয়ে যাবে বাবা সন্তানের। এটা নাহয় আর একটা সারপ্রাইজ হবে মাসুদের জীবনে।

সামনের প্রতিটি মিনিট চুড়ান্ত হিসেব করে এগিয়ে যেতে হবে। কান্না এ সময়ে মানায় না। দেয়াল ঘড়িটা পরপর দুইটা ডিং ঢং শব্দ করে থেমে যায়। কিছুতেই সময় কাটছে না মাকসুদা বেগমের। বারোটা বাঁজবে তখন একবার দুই তিন মুহুর্তের জন্য জ্ঞান ফিরেছিলো রীতার। নড়েচড়ে চোখ মেলেই বুয়ার হাত ধরে আড়ষ্ট কন্ঠে জানতে চেয়েছিলো- “খালা ! আমার কি হয়েছে ? আমার পেটের বাচ্চাটার কোনও ক্ষতি হয়নি তো?___”

প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগে শেষ হয়ে গিয়েছিলো রীতার ক্ষণস্থায়ী চেতনা।

মাকসুদা বেগম অদুরে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। বুঝতে পারলেন রীতা এখনও দুর্ঘটনার সবটুকু পরিনাম বুঝতে পারেনি। তবে সম্পূর্ণভাবে জ্ঞান ফিরে আসার আগে একজন ডাক্তার ডাকা দরকার।

সবচেয়ে কাছের গাইনোকোলজিষ্ট ডাক্তার সুমী, মাকসুদা বেগমের প্রাক্তন ছাত্রী। তাকে ফোন করার পর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে সমস্ত দুর্ঘটনা এবং পরবর্তি সময়ে বাচ্চা ও বিশেষ করে রীতার বিষয়ে খুঁটিনাটি সব জানার পর তার প্রাক্তন বিচক্ষণ প্রধান শিক্ষিকাকে শতভাগ নির্ভয় দিয়ে আসস্থ কর। ডা. সুমী দুঃখের সাথে জানালো যে, হাতের দুইটা জরুরী অপারেশন অবশ্যই যথাসময়ে শেষ করতে রাত তিনটা বেঁজে যাবে। এদিকে রীতার অবস্থা তেমন খারাপ ও না। যেহেতু শিশুটি বেঁচে নেই এবং গ্রসবকালীন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়নি- তাই তাকে আরও চার থেকে ছয় ঘন্টা ঘুম পাড়িয়ে রাখা যাবে।  আপাতত এইটুকু সময়ের জন্য রীতার রানের মাংসে  একটা চেতনা নাশক ইঞ্জেকশন পুশ করার কথা বলে ডা. সুমী। মাকসুদা বেগম সুস্থির ভাবে স্পেনিশ সহ সাদা কাগজে ইঞ্জেকশন এর নাম লিখলেন।  পাশের ফার্মেসী থেকে ইঞ্জেকশন সংগ্রহ করে নিজেই গভীর মাংসে পুশ করতে পারবেন বলে সম্মতি দেন।

ভোর চারটায় স্থানীয় সরকারি হাসপাতালের সামনে  মাকসুদা বেগম কে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে বলেন গাইনকোলজিষ্ট।

ড্রাইভ করছেন মাকসুদা বেগম। রাত বিরাতে তেমন একটা গাড়ি চালানো হয়না।তবে এই একই পথে তিনি রোজ গাড়ি নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করেন। হাসপাতালে যেতে; স্কুল পেড়িয়ে আরও দশ কিলোমিটার পথ। স্কুলের পরপর ছোটখাট বাজার, বাজারের দুই কিলোমিটার পর থেকে পথের দুইপাশ জনবসতিহীন ঘন জঙ্গল। মাকসুদা বেগমের এই পথটা বেশ পরিচিত। হাসপাতাল এর পর আরও এক কিলোমিটার সামনে রীতা মাসুদের অস্থায়ী বাসা। ভয় না পেলেও মাকসুদা বেগম মেয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে এই জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে যেতে গা ছমছম করতো। আজ নিজের ভাগ্যের উপর বিরক্ত তিনি। আরও বিরক্ত হয়েছেন গাড়ির উপর। কিছুক্ষন পরপর ষ্টার্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অনাকাঙ্খিত বিড়ম্বনায় মাত্র জঙ্গলের শুরুতে প্রবেশ করেছে গাড়ি। ঘড়িতে চারটা বেঁজে কুড়ি মিনিট, তারমানে অলরেডি ২০ মিনিট লেট। শূণ্য পথে গাড়ির গতি সামান্য বাড়িয়ে দিলেন মাকসুদা বেগম।

 

চলবে___

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ