বোবা ভাষা (পর্ব- ০২)

এস.জেড বাবু ১৮ জুন ২০২০, বৃহস্পতিবার, ০৮:২১:৩৫অপরাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

মাকসুদা বেগম বরাবরই বাস্তবতা মানিয়ে চলেন। বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে দুইবার আন্তঃজেলা “সেরা শিক্ষিকা” হিসেবে পুরস্কার গ্রহন করেছেন। কলিগদের কাছে ভিষন স্মার্ট হিসেবে উনার খ্যাতি আছে। কম কথা বলেন। মিষ্টি কথায় অল্পতে কাউকে কাবু করার ভিষণ রকম দক্ষতা আছে উনার।

কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর পরই পরিবারের বড় মেয়ে হওয়ার সুবাদে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয় তাকে।  মাত্র আঠারো বছর বয়সে বিয়ের দ্বিতীয় বছরে মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। একমাত্র মেয়ে রীতার জন্মের ছয় মাসের মাথায় উনার স্বামী চট্রগ্রাম যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। ভিষন আত্মপ্রত্যয়ী একজন মেয়ে হিসেবে তিনি তখনো ভেঙ্গে পড়েননি। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি বাবার বাড়িতে থেকে নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং একটানা এম.কম শেষ করেন। সৌভাগ্যবশত নিজ গ্রামের নব নির্মিত বালিকা বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করার মাত্র ছয় বছরের মধ্যে নিজ প্রতিভাবলে মেয়ে রীতার চৌদ্দতম জন্মদিনে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন।

মেয়েকে তিনি বরাবরই নিজের সৌভাগ্য হিসেবে বিবেচনা করতেন। উনার জীবনের একমাত্র চাওয়া পাওয়া ছিলো রীতার মুখের হাসি। কর্মজীবনের সমস্ত দিনের ক্লান্তি ভুলে যেতেন একবার মেয়ের মুখ দেখে।

সুন্দরী হওয়া সৌভাগ্য। সৌন্দর্য বিধাতার দেয়া অসীম দয়া, মানব জীবনে সর্বশ্রেষ্ট প্রাপ্তি। কিন্তু পিতৃহীন সুন্দরী মেয়ের মা হওয়া ততটা সুবিধার হয়ে উঠে না। সারাক্ষণ টেনশানে থাকতে হয়। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পোকামাকড় যেমন শীতের রাত্রীতে উঠানের আলোর নিচে উড়তে আসে, ঘরে সুন্দরী মেয়ে থাকলে আশেপাশের রাস্তাঘাটে কিশোর ছেলেদের তেমন জটলা থাকে। স্কুলে যাওয়ার সময়, স্কুল ছুটির পর এমনকি প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় মেয়ের পিছনে পাড়ার ছেলেদের দীর্ঘ লাইন লক্ষ করেন মাকসুদা বেগম। নিজের স্কুলে এসএসসি পাশ করার পর মেয়েকে তিন কিলোমিটার দুরের কলেজে ভর্তি করিয়ে তিনি মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে থাকেন। সহকর্মীদের সাথে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করে সহযোগিতা কামনা করেন এবং অতি অল্পতেই একজন সুদর্শন, শিক্ষিত এবং সদ্য আর্মীতে চাকুরীপ্রাপ্ত ছেলের সন্ধান পান।

মাসুদ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আট বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় তার বাবা মা একসাথে পরলোক গমন করেন। তারপর থেকে মাসুদ নানা বাড়িতে নানীর কোলে পিঠে চড়ে মানুষ হয়। সহকর্মীর মুখে এইটুকু শুনে মাকসুদা বেগমের কলিজা মোচর দিয়ে উঠে। না দেখেই ছেলেটার জন্য মনের মধ্যে কেমন যেন মায়া অনুভব করেন। পরদিন বাসায় আসতে বলেন। প্রথম দেখাতেই মাসুদ কে রীতার যোগ্য বর হিসেবে মানষিক ভাবে মেনে নেন। রীতার ও অপছন্দ হয়না। স্বল্পভাষী রীতা মুখে না বললেও- মেয়ের পছন্দ বুঝতে অসুবিধে হয়নি মায়ের।

বিয়ের পর প্রথম ছয়মাস শহরের অদুরে একটা বাংলো মতো বাড়িতে ভাড়া থেকেছে মাসুদ। দুজনেই ড্রাইভ করতে জানে তাই মাকসুদা বেগম নিজের গাড়ির চাবিটা মেয়ে জামাইয়ের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, যতদিন দেশে থাকো গাড়িটা তোমার কাছে রাখো। আবারও দেশের বাইরে সরকারি কোনও মিশনে গেলে রীতাকে আমার কাছে রেখে যেও।

মাসুদ মানা করেনি। চাকুরীর প্রথম বছর জাতিসংঘের ডাকে বাংলাদেশের হয়ে কম্বোডিয়ায় কাটিয়ে এসেছে এক বছর। দেশে ফিরতেই বিয়ে সংসার। আবার কখন ডাক পড়ে তার ঠিক নেই। ততদিন বৌ নিয়ে ভাড়া বাসায় কাটিয়ে দেয়া যায়। বিয়ের পরপরই সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স উইংস এ পদোন্নতি হয় মাসুদের। উইং কমান্ডারের কাছে দেশের বাইরে কোনও মিশনে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করে আবেদন করে সে। কখনো কোনও মিশনে গেলে রীতাকে তার মায়ের কাছে রেখে যাওয়াটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে মাসুদ।

বিয়ের ছয় মাসের মাথায় এমনি এক আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়ে নতুন মিশনে যোগ দিতে রীতাকে তার মায়ের কাছে রেখে যায় মাসুদ। কিছুদিন পরই মাকসুদা বেগম বুঝতে পারে যে রীতা অন্তঃস্বত্তা। আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে মা মেয়ের সংসারে। খবর পেয়ে মাসুদ ভিষণ খুশি। ছুটি পেলে সে দেশে আসার ইচ্ছে পোষণ করে।

মেয়ের খুঁটিনাটি সব বিষয়ের উপর তিক্ষ্ন দৃষ্টি রাখতে শুরু করেন  যোগ্য শিক্ষিতা শাশুড়ি। মেয়ে জামাইয়ের অনুপস্হিতিতে মেয়ে এবং তার অনাগত সন্তানের সকল দায়িত্ব নিজের উপর পেয়ে গর্ববোধ করেন মাকসুদা বেগম এবং তিনি নিজগুণে সে দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

মাত্র দুই ঘন্টা আগে আছরের আজান পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক ছিলো। আর মাত্র চারদিন পর রীতা ছেলে সন্তানের মা হবে। মাকসুদা বেগম নানী হবেন। হাসপাতালে সর্বশেষ পরিস্থিতি জেনে বুঝে মাসুদ কে ফোন করে তিনিই ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ জানিয়েছিলেন। সে সুবাদে মাসুদ গতকাল ফ্লাইট চেপেছে, আজই দেশে ফিরবে।

দুপুর থেকে রান্নাঘরে সহকারীর ভুমিকার ছিলেন মাসুদের শাশুড়ি মানে রীতার মা। তিনি স্কুল থেকে এক সপ্তাহের বিশেষ ছুটি নিয়েছেন। একমাত্র মেয়ে সন্তানের মা হবে, নয় মাস পর একটি মাত্র মেয়ের জামাই দেশে ফিরবে। চারপাশে কেমন যেন আনন্দ মিশে আছে।

আম, জলপাইয়ের আচারের বইয়াম পরিস্কার করা হয়েছে সেই দুপুরে। দুরকম মিষ্টি বানানো হয়েছে আগের দিন। আজ শুধু রান্না।

সেখানেই ঘটে বিপত্তি। হটাৎ করে বোয়াল মাছের পেটি কড়াইতে ছিটকে উঠে। মাকসুদা বেগম ফ্লোরে বসে আটা তেলে ময়ান করছিলেন। হটাৎ গরম তেলের ছিঁটা সহ্য করতে না পেরে রীতা সামান্য পিছনে যেতেই উল্টে পড়ে সয়াবিনের বোতল। পা পিছলে গিয়ে পড়বি তো পড় একেবারে রুটি তৈরীর পিঁড়ির উপর।

চার সেকেন্ডের এই ঘটনাটা মাকসুদা বেগম পরিস্কার দেখতে পেলেন। যতক্ষনে তিনি উঠে দাড়িয়েছেন ততক্ষনে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। মাকসুদা বেগম বরাবরের মতই অবিচল। বরং এই মুহুর্তও তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করছেন, তিনি ভালো করেই জানেন- এখন ছোট্ট একটা ভুল, সারা জীবনের জন্য কান্নার কারণ হতে পারে।  জ্ঞান হারিয়েছে রীতা, ওর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে লক্ষ করলেন প্রচন্ড রক্তক্ষরণ হচ্ছে সাড়ে ন মাসের গর্ভবতি মেয়ের।

 

চলবে____

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ