ছোট ছোট শিশুরা স্বাভাবিক কারণেই বিভিন্ন ধরণের খেলনার প্রতি খুবই কৌতূহলী এবং আগ্রহী হয়ে থাকে। বেলুন প্রিয় নয় এমন শিশু বলতে গেলে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। তার ওপর যদি হয় গ্যাসের বেলুন যা আকাশে উড়ে তাহলে তো কোনো কথাই নেই। সবাই সেদিকে ছুটে চলে। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের কাছে বেলুন কিনে দেয়ার আবদার আর বাহানার যেন শেষ নেই। এই গ্যাসের ফুলানো বেলুনের সিলিন্ডার বিষ্পোরণে যখন শিশুসহ মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক, আকস্মিক, অস্বাভাবিক এবং মর্মন্তুদ মৃত্যু ঘটে তখন স্বজনহারা মানুষের পক্ষে তা মেনে নেয়া কি আদৌ সম্ভব ? “মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে মেলায় বেলুন কিনতে এসে গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্পোরণে প্রাণ হারালো ৩ শিশু। এছাড়া এই ঘটনায় আহত হয়েছে আরও ১০ জন। গতকাল (২২ জানুয়ারি) শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০ টায় আজিজিয়া মাদ্রাসায় বার্ষিক সভা উপলক্ষে বসা মেলায় এই ঘটনা ঘটে {সূত্রঃ দৈ/ আজাদী, ২৩ জানুয়ারি’২১}।  প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে জানা যায়,বিষ্পোরণের তোড়ে সিলিন্ডারের আশেপাশে থাকা শিশুরা ৭/৮ হাত দূরে ছিটকে পড়ে এবং তিন শিশুর হাত-পা এমনকি শরীরের অর্ধেকাংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। আমাদের দেশে বেলুন ফুলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিষ্পোরণে অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা, মর্মান্তিক প্রাণহানি নতুন কোনো বিষয় নয়। গত ২৯ অক্টোবর’১৯ তারিখে ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকায় একজন বেলুন বিক্রেতার গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে চার শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ জন৷ ‘‘ভ্যানে করে গ্যাস সিলেন্ডার নিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করছিলেন এক বিক্রেতা৷ পাশেই বস্তি এলাকা হওয়ায় অনেকেই ভ্যান ঘিরে এবং আশপাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কেউবা বেলুন কিনছিল৷ এসময় হঠাৎ করে বিস্ফোরণ ঘটে৷''{ সূত্রঃ বিডি নিউজ টোয়েন্টি ফোর ডট কম, ৩০ অক্টোবর’১৯}। তাছাড়া  গত ২০ নভেম্বর’১৯ (শুক্রবার) ভোলায় বেলুন ফুলানোর গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুজন নিহত হয়েছে। দগ্ধ হয়েছে আরও দুজন। রাত ৯টার দিকে বোরহানউদ্দিন উপজেলার বাটামারা নসুর দোকান মোড় এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলো- বেলুন বিক্রেতা ও  স্থানীয় বাসু হাওলাদারের ছেলে মো. হাছনাইন (১৪)। স্থানীয় ও বোরহানউদ্দিন ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, বাটামারা নসুর দোকান মোড় এলাকায় অজ্ঞাত ব্যক্তি গ্যাস দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বাচ্চাদের কাছে বিক্রি করেন। শুক্রবার রাত আনুমানিক ৯টার দিকে হঠাৎ সিলিন্ডারটি বিস্ফোরিত হয়। এতে ওই অজ্ঞাত বেলুন বিক্রেতাসহ ওই এলাকার হাছনাইন নামের এক স্কুলছাত্র ঘটনা স্থলেই মারা যায়। এ ঘটনায় দগ্ধ হয় দুজন তার  মধ‌্যে একজনের একটি হাত উড়ে যায়।

“রাসায়নিক গ্যাস দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে বিক্রি করার পেশাটা কী ভীষণ প্রাণঘাতী ও ধ্বংসাত্মক হতে পারে, তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত রাজধানীর মিরপুর এলাকার রূপনগরে গত বুধবারের ট্র্যাজেডি। এক বেলুন বিক্রেতার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে চারটি শিশু, বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে সাত। বেলুন বিক্রেতা নিজেসহ আহত হয়েছে মোট ২০ জন মানুষ। তাদের কারও কারও অবস্থা আশঙ্কাজনক, মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় বিস্ফোরণের শিকার শিশু–কিশোর ও অন্যদের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে যাওয়া, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার যে চিত্র সংবামাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা যেন সন্ত্রাসবাদীদের আত্মঘাতী বোমা হামলাগুলোর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়” {সূত্রঃ প্র/ আলো,০১নভেম্বর’১৯}। অপর এক তথ্য থেকে জানা যায়, “বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসের সিলিন্ডার ও যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা করে দেখার বিধান আছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বিধান মানা হয় না। সেসব সিলিন্ডার জরাজীর্ণ হওয়ার একপর্যায়ে যখন আর ব্যবহারের কোনো উপায়ই থাকে না, তখন পরিত্যাগ করা হয়। সেসব পরিত্যক্ত সিলিন্ডার, কিংবা সেগুলো কেটে তৈরি করা সিলিন্ডার ব্যবহার করে বেলুনওয়ালারা শিশুদের জন্য মনোমুগ্ধকর বেলুন ফুলাতে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ডেকে আনছেন”।  পাশাপাশি বেলুন ফুলানোর জন্য গ্যাস তৈরির রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে বেলুন বিক্রেতারা সাধারণভাবে অজ্ঞ। তাঁরা যেসব সিলিন্ডার ব্যবহার করেন, সেগুলোও নিরাপদ ও বৈধ নয় কোনভাবেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বেলুনওয়ালারা বেলুন ফুলানোর জন্য নিজেরাই অ্যাসিড, সিসা, দস্তা, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতু ব্যবহার করে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করেন বলে জানা যায়। কিন্তু যথাযথ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ না থাকায় তাঁরা এ প্রক্রিয়ার ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে কিছুই জানেন না। জানেনা নিজেদের অজান্তেই জীবন এবং জীবিকার তাগিদে তাঁরা আত্মঘাতী বোমা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র। পাশাপাশি বিভিন্ন বয়সের মানুষের দুঃখজনক প্রাণহানির কারণ হচ্ছে। কেননা আমরা জানি, বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যমান্য কিছু প্রক্রিয়া আছে। বেলুনওয়ালাদের সেসব প্রক্রিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, অনুসরণ করার কোনো কারিগরি সুবিধাও নেই। বিপদের বিষয় হলো, সিলিন্ডারে গ্যাস তৈরির উপাদানগুলোর মিশ্রণে গ্যাস উৎপন্ন হতে শুরু করলে তার চাপ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। এ অবস্থায় বেলুন বিক্রি কম হলে অতিরিক্ত গ্যাসের চাপে সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণের ঝুঁকি বাড়তে থাকে অথচ দুঃখের বিষয় এ ব্যাপারে তাঁরা মোটেই ওয়াকিবহাল নন।

গ্যাস সিলিন্ডার নামক বিধ্বংসী বোমা সঙ্গে নিয়ে বেলুনওয়ালারা যখন পাড়া–মহল্লায় হাজির হন, তখন উৎসুক শিশুরা তাঁদের ঘিরে ধরে। শুধু কি তাই !আইনানুযায়ী গ্যাসের সিলিন্ডার ও যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজি সিলিন্ডার পাঁচ বছর পরপর পরীক্ষা করে দেখার বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে বিধান মানা হয় না। ফলশ্রুতিতে সরকারি, আধা সরকারি, বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার ছাড়া ভাড়ায় চালিত অনেক সিএনজি ট্যাক্সি, মাইক্রো, টেম্পু, বাস, ট্রাক, লরিসহ অনেক যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে এক একটি তরতাজা বোম হয়ে শহরে গ্রামে বন্দরে রাজপথে জনাকীর্ণ স্থানে হরহামেশা চলাচল করছে। আমরা প্রায় অনেকেই এসব যানবাহনে প্রতিনিয়ত চলাফেরা করছি নিজেদের অজান্তেই। জনস্বার্থে এবং অস্বাভাবিক,অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এবং অগ্নিদগ্ধদের পঙ্গুত্ব বরণের হাত থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য আত্মঘাতী বেলুন ফুলানোর কাজে বহুল ব্যবহৃত মেয়াদোত্তীর্ণ, বিপদজনক, অবৈধ গ্যাস সিলিন্ডারের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের বিষয়ে বিষ্পোরক অধিদপ্তর, ফায়ার ব্রিগেট সার্ভিস, সিটি কর্পোরেশন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কার্যকরী এবং যথাযথ পদক্ষেপ অতি দ্রুত গ্রহণ করা জনসাধারণের নৈতিক দাবী এবং প্রত্যাশা। পাশাপাশি সড়কে, মহা সড়কে, গ্রামে গঞ্জে চলাচলকারী সকল ধরণের সিএনজি গ্যাসচালিত যানবাহনের সিলিন্ডার মানসম্মত হওয়া এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত এবং বৈধ হওয়া অত্যাবশ্যক। তাছাড়া নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে পরীক্ষা করে সঙ্গে বৈধ মেয়াদের সনদ রাখার বিষয়ে তদারকি, নজরদারি রাখার ব্যাপারে বিআরটিএ এবং ট্র্যাফিক বিভাগকে সদা সজাগ সতর্ক থাকা খুবই আবশ্যক কেননা মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারগুলো এক একটা জীবন্ত বোমা হয়ে যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে বিষ্পোরণ ঘটিয়ে মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে। আমাদের সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে যথাযথ মান ও মেয়াদ না থাকার কারণে যানবাহনে সিলিন্ডার বিষ্পোরণের দুর্ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও সকলের বিবেচনায় নেয়া উচিৎ।  মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে অবহেলা এবং অহেতুক ছিনিমিনি খেলার অধিকার কারো নেই। মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ