বেরসিক দুপুরে

রোকসানা খন্দকার রুকু ১৩ অক্টোবর ২০২১, বুধবার, ০৭:৪৭:৫২অপরাহ্ন উপন্যাস ২১ মন্তব্য

একটা খরখরে বিশ্রী রোদের দুপুর ছিলো সেদিন। এমন দুপুরে  মেজাজ এমনিই বিগরে থাকে। নাকে মুখে ফোঁটা ফোঁটা লবনাক্ত ঘাম চাইলেও এডিয়ে যাওয়ার উপায় থাকে না। এমন দুপুরে যদি কারও প্রেমিকের সাথে প্রথম পরিচয় হয়। তাহলে সেটা সাধারণত গল্প উপন্যাসে চরম বেমানান। যতো প্রেমের উপন্যাস আজ অবধি পড়েছি সবগুলোতেই রোমান্টিক একটা সময় থাকে। সেটা অবশ্যই বর্ষা কিংবা শীতের মতো আমেজপূর্ন একটা সময় হয়ে থাকে।

আমার কপাল খারাপ বলেই হয়তো তা না হয়ে এমন বাজে খরখরে রোদ আর ঘামে ভেজা দুপুর জুটেছে। সেটা আবার কোন পার্ক, রেঁস্তোরা বা কোন নির্জন মায়াময় নদী তীরও নয়, একেবারে পরীক্ষার হল। হাতে কোন ফুল-টুল তো ভাবাই যায় না।

সাধারণত বড় কলেজগুলোতে অহরহই শিক্ষক বদলীতে কে যায় খুব একটা খেয়াল বা মনে রাখার মতো বিষয় নয়। শুধু নতুন কেউ এলে সেটা জানা যায়। কারন নতুন কেউ এলে তাকে নিয়ে আলোচনা হয়ে থাকে। প্রথম হয়তো সাবজেক্ট, বাড়ি এসব। তারপর তার চালচলন বা অন্যকিছুতে কিন্চিত হাসাহাসি না হলে যেন জমেই না। হাসাহাসির আলাদা আলাদা বেশ কিছু ছোট বড় দল থাকে। আমরা আমাদের দলে তিনজন। আমি আনারী হলেও মজা নেয়ার জন্য জমে থাকি।

আমারসাথে তার তেমন আলাপচারিতা হয়নি। শুধু দুএকদিন দেখার সুযোগ হয়েছে। তিনি ডিপার্টমেন্টের ভারী পর্দা গলিয়ে ক্লাসে যান আর এসে ভেতরে ঢুকেই হারিয়ে যান। টিচার্স রুমে বসার কোন স্বাধ বোধহয় তার নেই। একসময় মুরগীর মতো পর্দার ভেতর থেকে বেডিয়ে সবার অগোচরে বাড়ি চলে যান। আমরা কম্পিউটার ল্যাবে বসে অসময়ে কলেজের নেট খরচ করে, প্রিন্সিপালকে ফাঁকি দিয়ে যে হিন্দি গান শুনি কিংবা হারমোনিয়ামে অযথা সুর তুলি এর কোনটাতেই তিনি নেই। তাই আমরা তার নাম দিয়েছি বেরসিক খটাস। নামটা তার জন্য পারফেক্ট সেটা হালিমার মতামত।

আজ পরীক্ষার হলে ঢুকেই তাকে দেখে আমি বেশ অবাক। কি বলবো, বা সে কি উত্তর দেবে। যদি ঠিকঠাক উত্তর না দেয়? কিংবা আমি ইতিহাস বলে সে আমার সাথে ভাব নেয় এজন্য ও চ্যাপ্টার বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীতেই মুখ গুঁজে থাকি। মোটামুটি কাজ শেষ করে হলরুমের একেবারে শেষ মাথায় দাডালাম এডিশনাল স্ক্রিপ্ট হাতে।

হঠাৎই বেরসিক আমার দিকে ধেয়ে আসছে। কি রকম যেন দ্রুত আর অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটে। মনে হয় বিষয় খুব জরুরী কিংবা তাড়া আছে এমন একটা ভাব। একটু লম্বা মানুষের শরীরে যদি মাংসের বালাই না থাকে তাহলে তাকে একটু অস্বাভাবিকই লাগে।

বেরসিক হেঁটে আসছে আর আমি তার পোশাক দেখছি। তার পোশাকের রুচি একটু কম বলেই মনে হলো। গায়ের শার্টটি বেশ ফ্যাকাশে ও মলিন, পায়ে সাধারণ চামড়ার স্যান্ডেল। প্রথম শ্রেণীর একজন মানুষ এমন পোষাক না পরলেও পারতেন। আর যে চশমাটি চোখে গলিয়েছেন তা আমার মোটেও পছন্দ হলো না। চশমার ফ্রেম কেমন অর্ধেক, আধাআধি আবার কি জিনিস? মনে হয় পাতলা রাবারের সুতো গলিয়ে এক্ষুনি চোখ থেকে কাঁচ মাটিতে পড়ে যাবে। কানা তখন নিজেই হাতরে হাতরে খুঁজবে। না পেলে কাউকে বলবেও না খুঁজে দিতে।

অবশেষে কাঁচবিহীন একচোখে রিকশা অলা বুডো মামাকে মামা না ডেকে ভাই ডেকে বাড়ি ফিরবেন। রিকশায় সংকোচে আটোসাটো, ভাবখানা এমন যেন সবাই তাকেই খেয়াল করছে। পৃথিবী যে নিজ নিজ কাজে মহাব্যস্ত থাকে। কাউকে সময় নিয়ে খেয়াল করার ইচ্ছে রাখে না এটা তার এখনো অজানা। আপাতদৃষ্টিতে এ মানুষগুলো একঘরে টাইপের হয়।

এরপর বাড়িতে ফিরেই লোকজন থাকলে যার তার উপর চড়াও হবে। অযথা বাড়ি মাথায় তুলে ওয়াশরুমে গিয়ে অনেকক্ষন কাটাবেন। তারাহুডো করে বাড়ি ফেরার কারণ হলো এই টাইপের মানুষের বেশ কয়েকটা আধা ফ্রেম অলা চশমা থাকে। বাড়ি এসেই একটা চশমা গলিয়ে ওয়াশরুমে যাবেন ফিটিংস দেখতে। অবশেষে নাক উঁচিয়ে এসে সোজা বসবেন খাবার টেবিলে। তারপর রুমে গিয়ে চিন্তিত মনে শুয়ে শুয়ে ভাববেন কে, কে যে দেখলো?

বেশি চশমা থাকার কারণ হলো ফিটিংস নিয়ে তিনি অতি খুঁতখুঁতে স্বভাবের। এনাদের ধারনা একবার যে দোকানে চশমা ফিটিং হয়েছে তিনি ছাড়া দুনিয়ার কারও সাধ্য নেই তার চশমায় ফিটিং দেয়ার। দৈবক্রমে চশমা ভেঙ্গে গেলে আবার সেই জায়গা না যাওয়া পর্যন্ত তিনি আর কোথাও চশমা বানাবেনও না, পরবেনও না। আসলে এটা যে তার মনের ভ্রান্তি সেটা তিনি কখনোই বুঝতে পারেন না।

যাই হোক, আমার দিকে বেরসিক খটাস দ্রুততার সাথে এগিয়ে এসেই আচমকা থেমে গেলেন। কিছু বলবেন হয়তো আমি চোখ তুলে তাকালাম। তিনি বলার আগে হাসলেন। অদ্ভুত মুগ্ধতা ও সারল্য তার হাসিতে। আমি পুরাই অবাক হয়ে হাসিতে আটকে গেলাম। এই চরিত্রের এই হাসি! আমিও কিছুটা সাহসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমার চৌপাটিও বের করলাম। তিনি হঠাৎই মলিন মুখে নিজের কথা বলতে শুরু করলেন।

আমাদের এক সিনিয়র প্রফেসর তাকে বলেছেন আমার সাথে কথা বললেই বাড়ি যোগাড় করা সম্ভব। এখন তিনি যেখানে আছেন সেখানে খুবই সমস্যা বোধ করছেন। বাজে-বিশ্রী পরিবেশ, খাবার ভালো না, পানি ভালো না। ইভেন মাথার চুলগুলোও সব উঠে যাচ্ছে। আমি চট করে বেরসিকের মাথার দিকে তাকালাম। চুলগুলো চমৎকার। টাক হলে চেহারার কেমন বেহাল দশা হবে এটা ভাবতেই আমার হাসি পেলো।

সংলাপ আপাতত এটুকুই। তবুও এই ঘর্মাক্ত দুপুরে আমি আরও ঘেমে গেলাম। মন বললো, এ মানুষটাকে আমার সাহায্য করা দরকার। অবশ্য অন্যকে সাহায্য করার কাজটা আমি পারিও ভালো। আমার মনে হলো, তিনি চাইলেই বাড়ি যোগার করতে পারতেন। শুধু তার সহজ হতে না পারার সমস্যাতেই কাজটি কঠিন হয়ে গেছে। আমি আমাদের বাড়িঅলার সাথে  কথা বলবো এমনটা কথা দিলাম। তিনি বোধহয় বেশিই আশ্বস্ত ফিল করলেন এবং আবার সেই মুগ্ধ হাসি ছুঁড়ে সামনে এগিয়ে গেলেন।

তার এবারের হাসিতে আমার চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। আর হাতের কলমটা ঠকাস করে মাটিতে পড়ে গেলো। আমি শব্দে চমকে উঠলাম। মনে হলো বেরসিক আমার হৃদয়ে কিছু একটা দিয়ে এইমাত্র একটা কঠিন ঘা বসালো। যা আর কোনদিন শুকাবে না। বাড়তে বাড়তে একসময় রোগে পরিনত হবে। যে কেউ দেখলে বলবে আমি খুব খারাপ রকম প্রেমরোগে আক্রান্ত। আমি নিজেকে লুকোতে পেছনের দরজা দিয়ে বেডিয়ে সোজা ক্যান্টিনে ঢুকলাম।

চলবে—-

ছবি- নেটের

0 Shares

২১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ