রাজা নয়, রাণীও পারেন কল্পলোককে নিয়ন্ত্রণ করতে, যেমন পেরেছেন বেগম রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ (১৯০৮) নামক কল্পকাহিনীতে। রোকেয়া বন্দিনী ছিলেন। সেটা বোঝা যাবে তাঁকে যদি তাঁর পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে স্থাপন করি। জন্ম ১৮৮০তে। কলকাতা থেকে অনেক দূরে, রংপুরে। পিতা ছিলেন বিত্তবান, কিন্তু অপব্যয়ী ও রক্ষণশীল। দুই ছেলেকে তিনি কলকাতায় রেখে সাহেবদের স্কুলে পড়িয়েছেন; কিন্তু মেয়েদের শিক্ষায় বিশ্বাস করতেন না। বেগম রোকেয়া কারাবাসী ছিলেন। তার বড় বোনও তাই। এই বোনের ভীষণ আগ্রহ ছিলো বাঙলা শেখার। একদিন তিনি বাঙলা বই পড়ছিলেন। তাই দেখে পিতা ভয় পেয়ে গেলেন। “শুধু পড়াই বন্ধ হইল না-তখন করিমুন্নেসাকে অন্ধকার কারাগৃহে (অর্থাৎ বলিয়াদীতে মাতামহের প্রাসাদে) পাঠাইয়া দিয়া বিবাহের আয়োজন হইতে লাগিল।” ১৪ বছর বয়সে বোন করিমুন্নেসার বিয়ে হয়েছে। রোকেয়ার বিয়ে হয়েছে ১৬ বছর বয়সে। স্বামী উচ্চ শিক্ষিত, বিলেত গিয়েছিলেন ডিগ্রী আনতে, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন চাকরিতে, বেগম রোকেয়াকে উৎসাহিত করেছেন লিখতে। কিন্তু স্বামীগৃহকে আদর্শায়িত করবার কোনো উপায় নেই, সেও কারাগারই ছিলো আসলে। স্বামী ছিলেন উর্দুভাষী, থাকতেন তিনি বাঙলার বাইরে ভাগলপুরে। দুঃখ করে বেগম রোকেয়া লিখেছেন, ১৪ বছর তার ভাগলপুরে কেটেছে, যেখানে একজন বাঙালি ছিলো না যার সঙ্গে বাঙলায় কথা বলবেন, তারপর কলকাতা এসে প্রথম ১১ বছর তিনি একটি উর্দু বালিকা বিদ্যালয় পরিচালনা করেছেন। যেখানে ছাত্রী, শিক্ষিকা, কর্মচারী সবাই ছিলো উর্দুভাষী। বেগম রোকেয়া বাঙলা ও ইংরেজি শিখেছেন নিজের চেষ্টায়।

রোকেয়া কারাগার ভেঙে বের হয়ে এসেছেন; কিন্তু কোথাও উগ্রতা ছিলো না তাঁর, রূঢ় নন, কর্কশ নন, তার বিদ্রোহ বড়ই সাহসী, তাঁর সাহস বড়ই শান্ত। ২৯ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন, তারপর থেকে কলকাতায় ছিলেন; কিন্তু শহর কলকাতার উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক জীবন, তাঁর বিপুল কর্মদ্যোগ কোন কিচুর সঙ্গেই নিজেকে যুক্ত করতে পারেন নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নন, তিনি হলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের। পথে বের হবেন সে স্বাধীনতা ছিলো না; কিন্তু তাই বলে অন্তপুরের মানসিক কারাবাসকে তিনি কখনো মেনে নেননি, পদে পদে বাঁধা, পদে পদে লংঘন। পরিবেশের অকিঞ্চিতকরতা, পরিস্থিতির বৈরিতা সমস্ত কিছুকে দুহাতে ঠেলে কেমন করে এগিয়ে গেলেন তিনি, অনমনীয়। অমনভাবে বিদ্যাসাগরও একদিন এসেছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতাতে। ‘সুলতানাস ড্রিম’ও এক বিষ্ময়কর লেখা। সে কল্পলোকের কাহিনী। কাহিনীটি যিনি বলছেন তার নাম সুলতানা। তার ধারণা তিনি জেগেই ছিলেন। কিন্তু আসলে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। দেখেন তিনি এক আশ্চর্য জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নাম তার নারীস্থান। এখানে মশা নেই, পুলিশ নেই, অশান্তি নেই। কারণ কি? কারণ একটাই। পুরুষ এখানে শৃংখলাবদ্ধ। ভগিনী সারা নামে যে মহিলা সুলতানাকে সঙ্গ দিচ্ছে, সে বলছে, স্বয়ং শয়তান যেখানে শৃংখলাবদ্ধ সেখানে শয়তানীর সুযোগ কোথায়? মেয়েরা তাই ভারী নিরাপদ। পুরুষরা রয়েছে অন্তপুরে। জননিরাপত্তার স্বার্থে হিংস্র পশু ও বদ্ধ উন্মাদের যেমন অবাধে চলাফেরার স্বাধীনতা দিতে নেই, তেমনি পুরুষদেরও ছেড়ে দেয়া যায় না রাস্তায়। তারা থাকে ঘরে। তারা করে দেহের কাজ। মেয়েরা করে মস্তিষ্কের কাজ। এর আছে দেহ, ওর আছে মন। বিভজনটা এই রকমের। পুরুষ বন্দী হলো কেনো? হলো নিজের ব্যর্থতায়। পার্শ্ববর্তী রাজ্য থেকে কয়েকজন বিদ্রোহী, যারা ওই রাজ্যের দুঃশাসন মেনে নিতে পারে নি, তারা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো এই রাজ্যে। এ রাজ্যের রাণী তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। দেবেনই, তিনি ন্যায়ের প্রতিপালক, অন্যায়ের সংহারক। তখন লাগলো যুদ্ধ। দলে দলে সৈনিকরা (সবাই তারা পুরুষ) আহত ও নিহত হতে লাগলো। রাজ্য বিপন্ন, পুরুষ নিঃশেষ প্রায়। কি করা যায়? সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আহার নিদ্রা বন্ধ হবার উপক্রম। শেষে এগিয়ে এলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। বলার অপেক্ষা রাখে না যে তিনি মহিলা এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র নেই, সবাই ছাত্রী। দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবিকা নিয়ে রওনা দিলেন। না, সীমান্ত পর্যন্ত যাননি তারা। হাতাহাতি করেননি শত্রুপক্ষের সঙ্গে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগৃহীত সূর্যের কিরণ দূর থেকে নিক্ষেপ করেছেন শত্রু সীমান্তে।শত সহস্র সূর্য মর্ত্যে নেবে এলে যেমন প্রবল তাপ সৃষ্টি হবার কথা তেমন তাপ নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো শত্রুপক্ষের দিকে। তারা পালিয়ে বাঁচে না, যুদ্ধ করবে কী। যুদ্দযাত্রার আগে, অধ্যক্ষা শর্ত দিয়েছিলেন পুরষদের সবাইকে অন্তপুরে প্রবেশ করতে হবে। পর্দার প্রয়োজনে এটা আবশ্যক। সেই থেকে পুরুষরা সবাই ঘরে থাকে। মেয়েরা আছে বাইরে। নিরুপদ্রবে। সুলতানা পুরুষশাসিত পরাধীন ভারতবর্ষের মেয়ে, চলাফেরায় দ্বিধা ছিলো প্রথমে, লজ্জা ও সংকোচ জড়িয়ে যাচ্ছিলো পা; ভগিনী সারা বললেন, “এ রাজ্যে অমন পুরষপনা চলবে না, মেয়েরা এখানে স্বাচ্ছেন্দ্যে চলে।” বেগম রোকেয়ার এই লেখাটি তাঁর স্বামী এক নিঃশ্বাসে পড়েছিলেন; পড়ে ইংরেজিতে বলেছিলেন, “এ একটি ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ।” হ্যাঁ, তাই। কিন্তু ব্যক্তিগত নয়। প্রতিশোধটা সমষ্টিগত। তাছাড়া পুরষকে বন্দী করা রোকেয়ার লক্ষ্য নয়। লক্ষ্য নারীকে মুক্ত করা। যে জন্য তিনি বিজ্ঞানকে নিয়ে এসেছেন তার এই লেখায়।

প্রতিশোধ নয়,আসলে তিনি চান মুক্তি। মানুষের জন্য প্রকৃতির ভাণ্ডারে রয়েছে অফুরন্ত সম্পদ, সেই সম্পদ ব্যবহার করে জীবনকে উন্নত করা আবশ্যক। পুরুষকে জব্দ করা লক্ষ্য নয়। ওই কল্পরাজ্যে দুটি মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আমাদের দেশের মৌলবাদীদের কেউ কেউ স্বতন্ত্র মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষপাতি, কিন্তু বেগম রোকেয়ার বিশ্ববিদ্যালয় মৌলবাদীদের নয়, তার লক্ষ্য মেয়েদেরকে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়া নয়, সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়। এ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টিশীল গবেষণাকেন্দ্র। আর এ জ্ঞান অর্থহীন কূটতর্কের কারুকার্য সৃষ্টির কিংবা শশা থেকে সূর্যকিরণ বেরকরবার নয়। (গালিভারস ট্রাভেলস দ্রষ্টব্য) এ হচ্ছে মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির। বিশ্ববিদ্যালয় দুটির একটি আবিষ্কার করেছে মেঘ থেকে পানি সংগ্রহের পদ্ধতি, যার ফলে মানুষকে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়না। অপরটি আবিষ্কার করেছে সৌর শক্তি সংগ্রহের পদ্ধতি, যে শক্তি দিয়ে রান্নাবান্না থেকে যুদ্ধবিগ্রহ পর্যন্ত সবকিছু করা যায়। ওই রাজ্যে এরোপ্লেন চলে। ওরা বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে কৃষিকার্যে। স্মরণ করা যেতে পারে যে বেগম রোকেয়া যখন এ লেখা লেখেন তখন ভারতবর্ষে বিমান দূরে থাক, মোটর গাড়ি এসে থাকলেও তিনি দেখেননি। বিদ্যুৎশক্তি সম্পর্কেও তার কোন প্রত্যক্ষ ধারণা ছিলোনা। মেঘ থেকে পানি ও সূর্য থেকে শক্তি সংগ্রহের চেষ্টা সেকালে বিজ্ঞানীরাও করছিলেননা।
বেগম রোকেয় তার সব লেখাতেই সমান সাহসী। তিনটি উদাহরণ দিই। স্ত্রী জাতির অবনতি নামে প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, “কোন ভগ্নী মস্তকোত্তলনের চেষ্টা করিয়াছেন, তখনই কর্মের দোহাই বা শাস্ত্রের বচন স্বরুপ অস্ত্রাঘাতে তাহার মস্তক চূর্ণ হইয়াছে। দাসত্বের নিদর্শন প্রবন্ধে লিখেছেন, কারাগারে বন্দীগণ লৌহনির্মিত বেড়ী পরে আমরা আদরের জিনিষ বলিয়া, স্বর্নরৌপ্যের বেড়ী অর্থ্যাৎ মল পরি। উহাদের হাতকড়ি লৌহনির্মিত আমাদের হাতকড়ি স্বর্ন বা রৌপ্যনির্মিত চুড়ি। বলা বাহুল্য, লোহার বারাও বাদ দেওয় হয়না। কুকুরের গলে গলাবদ্ধ দেখি, উহার অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্মিত হইয়াছে। অশ্ব, হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহশৃংখলে আবদ্ধ থাকে, সেইরুপে আমরা স্বর্ণশৃংখলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া মনে করি হার পরিয়াছি। গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয় নাকদড়ি পরায়,এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের নাকে নোলক পরাইয়াছেন। ...অতএব দেখিলেন ভগিনী। আপনাদের ঐ বহুমূল্য অলংকারগুলি দাসত্বের নির্দশন ব্যতীত আর কী হইতে পারে? আবার মজা দেখুন, যাহার শরীরে দাসত্বের নিদর্শন যত অথিক, তিনি সমাজের ততোধিক মান্যাগন্যা।” এ প্রবন্ধ ১৯০৫ সালে লেখা।

বেগম রোকেয়া নিশ্চয়ই টমাস মুরের লেখা পড়েননি। কিন্তু স্বর্ণ-রোপ্য সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অভিন্ন। রোকেয়ার এই কল্পকাহিনীটি অবশ্য যত প্রশ্নের জবাব দেয় তার চেয়ে বেশী প্রশ্ন উত্থাপন করে। মূল প্রশ্নগুলো সাধারণ। এই রাজ্য প্রতিষ্ঠা হবে কী করে? দ্বিতীয়ত, একে রক্ষা করা যাবে কোন উপায়ে? দেখা যাচ্ছে এখানে সেনাবাহিনী রয়েছে। তারা যদি হফাৎ একদিন ক্ষমতা দখল করে নেয়, এবং সামরিক আইন জারী করে বসে কিম্বা যদি তারা পার্শ্ববতী রাজার সঙ্গে যোগসাজস করে অন্তঘাতী তৎপরতা চালায়? সৈন্যদেরকে কি দমিয়ে রাখা হবে, এখন যেমন পুরুষদের আটকে রাখা হয়? তাহলে তো আবার সেই অসাম্য। পুরুষদের অবরুদ্ধ করে মেয়েদের শাসন তো আবার সেই অন্যায়েরই সৃষ্টি করবে যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেয়েরা এখন প্রতিবাদমুখর।

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ