বিশ্বের বহু দেশের মতন আমাদের বাংলাদেশটিকেও যুদ্ধ করেই স্বাধীন করতে হয়েছিলো তবে স্বাধীন করার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন।স্বাধীন হওয়া বিশ্বের অন্য যে কোন দেশের চেয়ে ভয়ংকর,মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়।মাত্র নয় মাসেই ত্রিশ লক্ষ জনতাকে হত্যা,লক্ষ লক্ষ মায়ের সম্ভ্রম কেরে নেয়া,অসংখ্য ঘর বাড়ী জ্বালাও পোড়াও বিশ্ব অবাক হয়ে গিয়েছিল।যার কারনে সে সময় বহু ভিন দেশী জনদরদী মানবতা মানুষগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্ন দিক দিয়ে সহযোগিতা করেছিল।বিশেষ করে নাপাকি বাহিনীর নারীদের উপর নির্যাতন তারা বরাবর প্রতিবাদ করেছিলেন।
বর্বর নাপাকি বাহিনীর কাছে অস্তিমিত বাংলার স্বাধীনতা পরাধীনতার শিকল হতে মুক্ত হতে এ দেশের পুরুষদের পাশা পাশি নারীদেরকেও দিতে হয়েছে জান মান।তাদের এক জন তারামন বিবি।এই বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত মুক্তি যোদ্ধা তারামন বিবি মারা গেলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ শুক্রবার রাত ১টা ২৭ মিনিটে কুড়িগ্রামের রাজিব পুর উপজেলার কাচারী পাড়ার নিজ বাড়িতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলার কোদাল কাঠি ইউনিয়নের কাছারি পাড়ার শংকর মাধব পুর গ্রামে ১৯৫৭ সালে তারামন বিবির জন্ম।মুক্তি যুদ্ধে অবদানের জন্য ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার তারামন বিবিকে বীর প্রতীক খেতাব দেয়া হলেও কিন্তু এই মুক্তি যোদ্ধাকে খুঁজে বের করা সম্ভব হয় ১৯৯৫ সালে।তখনি ১৯ ডিসেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে তারামন বিবির হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়েছিল।
এমনি অসংখ্য তারামন বিবিরা স্বাধীনতাত্তোর স্বদেশের মানুষদের তিরস্কার অবহেলার কারনে নিজেদের আত্মগোপন করে কোন মতে দিন অতিবাহিত করতেন নতুবা এই বীরাঙ্গনাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু সেই কবেই দেয়া হয়ে গেল তারাও ঘর সংসার জগৎ ছাড়া হতেন না।অকৃজ্ঞ বাঙ্গালী নারীদের চিরকালই দাসী বান্দি আর ভোগ্যপন্য হিসাবে দেখে আসছে।ভুলেও ভাবেনি ওরাও আট দশ পুরুষের মতন কাজ করতে পারেন,পারেন মাঠে ময়দানে মার্তৃভুমির টানে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে।তেমনি একজন সশরিরে মুক্তিকামী নারী তারামন বিবি।
মৃত্যুর গত কয়দিন আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলগুলোতে সাক্ষাৎকারে তার অকুতোভয় যুদ্ধ কালীন ঘটনাগুলো বলেন তার কিছু অংশ এখানে তুলে ধরে তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

তারামনের গ্রাম কুড়ি গ্রাম জেলার শংকর মাধবপুর।সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ১১ নং সেক্টরের একটি ক্যাম্প ছিল।সেই ক্যাম্পের নেতৃত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের।মুহিব হাবিলদার যিনি তারামনদের গ্রামের পাশে সেই ক্যাম্পটির একটি দায়ীত্বে ছিলেন।সেই ক্যাম্পে রান্না-বান্নার কাজের জন্য একজন কাজের লোক খুজঁছিলেন।
তার ভাষ্যমতে…
তখন তার বয়স বারো কি তের একদিন সে নিজেদের রান্না করার জন্য পাশেই বয়ে যাওয়া একটি ছোট খাল হতে শুষ্ক কচুঁরিপানা তুলছিলেন।সেই সময় তার পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন মুহিব হাবিলদার নামক একজন মুক্তিযুদ্ধা।তাকে দেখে থামলেন।
-এই মেয়ে তুমি এখানে কি করছ?
-কস্তুরি তুলছি রান্না করব।
হাবিলদার মুহিবের মনে পড়ে যায় তাদের ক্যাম্পেও একজন রান্না বান্নার লোকের প্রয়োজন।
-তুমি জানো আমি কে?
-মাথা নাড়িয়ে বলল…না তবে আপনার সাথে বন্দুক দেইখা মনে হয় আপনি মুক্তিযোদ্ধা।
-ঠিক ধরেছ…তুমিও মুক্তিযোদ্ধা হতে পারো।হবে মুক্তিযোদ্ধা?
-আমিতো বন্দুক চালাইতে পারি না।
-শুধু বন্দুক চালাইলেই মুক্তিযোদ্ধা হয় না আরো অনেক উপায় আছে…এই মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করাটাও মুক্তিযোদ্ধা।তাই আমারা যারা বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করি তাদেরকে রা্ন্না করে দেয়ার জন্য তোমার মতন একজনকে খুজঁছি,শুনেছিলাম তুমি নাকি মানষের ঘরে ঘরে কাজ কর,তুমি যাবে আমাদের ক্যাম্পে?
-মা বকবে,
-চলো তোমার মায়ের কাছে।
সেই সন্ধ্যায়,আজিজ মাস্টার সহ মুহিফ হালদার তার মায়ের সাথে দেখা করেন।আজিজ মাস্টারের কথায় মা ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন! ‘ক্যাম্পে নিয়া যাবার চান, এই মেয়ের তো কোনো দিন বিয়া হইবে না? মেয়ে যদি মইরা যায় তাইলে তো যন্ত্রণাই শ্যাষ, যদি না মরে তাইলে...।
প্রথমে তারামনের মা কুলসুম বেওয়া এতে রাজি হননি৷বুদ্ধি খাটিয়ে আজিজ মাষ্টার তারামনকে যখন ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করেন তখন সে রাজি হন৷তারপর তারামনকে দশ ঘরিয়ায় মুক্তি যোদ্ধাদের শিবিরে রান্নার কাজে পাঠাতে রাজি হন৷

শুরু হয় তারামন বিবি সংগ্রামী জীবন।প্রথমে তিনি আহত যুদ্ধাদের সেবা ও রান্না ও মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া দাওয়ার কাজগুলো করতে থাকেন।সেই সাথে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতেন তা হল গুপ্তচর।তিনি একেক সময় একেক বেশ ধারণ করতেন কখনও কখনও তার সারা শরীরে কাদা মাটি,চক,কালি এমনকি মানুষের বিষ্ঠা পর্যন্ত লাগিয়ে পাগল সেজেঁছেন৷চুল এলোমেলো করে বোবা সেজেঁ নাপাকি সেনাদের সামনে দীর্ঘ হাসি কিংবা কান্নার অভিনয় করেছেন৷কখনও প্রতিবন্ধী কিংবা পঙ্গুর মতো করে চলা ফেরা করে শত্রু সেনাদের খোঁজ নিয়ে এসেছেন নদী সাঁতরে গিয়ে৷আবার কলা গাছের ভেলা নিয়ে কখনও কখনও পাড়ি দিয়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শাখা নদীও।এ ভাবেই জীবনের মায়া ত্যাগ করে মুক্তি বাহিনীদের নিকট এসে বলতেন নাপাকিদের ক্যাম্পের পজিসন ও তাদের অস্ত্র ভান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধা বধের তাদের প্লান কৌশলগুলো যা তিনি কানা বোবা পাগলী সেজেঁ জেনে এসেছিলেন।সেই অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময় নাপকিদের ক্যাম্প ও চলাচলের সময় হামলা চালিয়ে সফল ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতেন।
তার ভাষ্য....
আজিজ মাস্টার একদিন বললেন, নদী পাড়ি দিয়ে নাপাকিস্তনি ক্যাম্পের খবর আনতে হবে।কোনো পুরুষ যেতে পারবে না।যেতে হবে তোমাকে। তাও আবার নদী সাঁতরে, রাতের অন্ধকারে।কথাগুলো শুনেই কইলজাটা চিন চিন করে উঠল।ব্রহ্মপুত্রের আরেক ঘাট খাড় বাজ।তথ্য আনতে যেতে হবে সেখানে।রাজি হয়ে গেলাম,যা থাকে কপালে। বুকের নিচে একটা কলাগাছ দিয়ে পরনের কাপড় যতটুকু কমানো যায় কমিয়ে রাতের অন্ধকারে নেমে পড়লাম ব্রহ্মপুত্রে।সারারাত সাঁতরে ভোরে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতাম। তারপর নিজেকে পাগলির বেশ ভূষায় নোংরা ময়লা ছেঁড়া কাপড় পরে চলে যেতাম শত্রুদের ক্যাম্পে।কুত্তার বাচ্চারা আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত।উর্দু ভাষায় কথা বলাবার চেষ্টা করত।তবে আমি কথা বলতাম না।পাগলামির অংশটা আরেকটু বাড়িয়ে দিতাম।ওরা আমাকে নিয়ে খেলা করত,বিরক্ত করত,তবুও আমাকে কথা বলাতে পারেনি। ক্যাম্পে যখন আমার মতো মেয়েদের কান্নার শব্দ শুনতে পেতাম তখন মনে হতো চিৎকার করে ওদের গালি দেই।কিন্তু তা করতাম না,শুধু দ্যাশটার কথা ভাবতাম।চুপ চাপ বুকের কষ্ট বুকে চেপে ধরে অন্য পথে এগিয়ে যেতাম।ওদের এলএমজি, রাইফেল, বাহিনী, সব জেনে আবার নদ সাঁতরে চলে আসতাম আমাদের ক্যাম্পে।

এরপর সে আশা ব্যাক্ত করলেন সে অস্ত্র চালিয়ে নাপকিদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবেন।তার সাহসীকতা দেখে কমান্ডার রাজী হলেও বয়স অল্প হওয়াতে বন্দুকে ঝাকুনি সহ্য করতে পারবেন না ভেবে প্রথমে না করেন পরে বললেন তুমি স্ট্যান্ডগান চালিও তোমাকে আমরা শিখিয়ে দেব।সে তাতেও রাজী হলেন হাস্য মুখে।
এক দিনের এক ঘটনা।ঘটনাটা ছিলো ঠিক মধ্য দুপুরের৷ক্যাম্পের সবাই খেতে বসেছেন৷তারামনকে পাকিস্তানি সেনাদের কেউ আসছে কি না তা দেখার জন্য বলা হলে সে সুপারি গাছে উঠে দূরবীন দিয়ে চারি দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন৷হঠাৎ তিনি দেখলেন,নাপাকি বাহিনীর একটি গানবোট তাদের দিকেই আসছে৷দ্রুত গাছ থেকে নেমে খবর দেয়ার সাথে সাথে সবার খাওয়া বন্ধ৷তারা দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে অ্যাকশনের অপেক্ষা করতে লাগলেন৷তারামন তাঁর সহযোদ্ধাদের সাথে সেই যুদ্ধে অংশ নিলেন৷সেদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে৷সেদিন তারা শত্রুদের পরাস্ত করতে সক্ষম হলেন৷
তার মতে..সেই দিন বৃষ্টির মতো গুলি চলেছিল সন্ধ্যা পর্যন্ত ।আমি কখন যে স্টেনগান নিয়ে গুলি চালানো শুরু করেছি খেয়াল করিনি।আমার একটা গুলি যখন ওদের এক জনের গায়ে লাগল,সেই মুহূর্তে আমি সব চেয়ে খুশি হয়েছিলাম।কনুই আর পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে আলফা করে কত জায়গা যে পেরিয়ে গেছি।কনুই,পায়ের পাতা কেটে রক্ত বের হয়ে ঘা হয়ে গেছিল তাও থামি নাই।স্বপ্ন একটাই, আমরা স্বাধীন হব।তারপর হতেই তারামন অনেক যুদ্ধে পুরুষ মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে অংশ নিয়েছিলেন৷অনেক বার তাদের ক্যাম্প নাপাকি বাহিনী আক্রমণ করেছে,তবে ভাগ্যের জোরে তিনি প্রতিবার বেঁচে গিয়েছিলেন৷

সেই সময় মুক্তি যুদ্ধের দুই নারী বীর প্রতীক।এক জন ডাক্তার ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম,যিনি দুই নম্বর সেক্টরে অসামান্য অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন দুই নম্বর সেক্টরে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।সে বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দারের বোন ডা. সেতারা পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিবাসী হন।কিন্তু আরেক জন তারামন বিবি যাকে ২৪টি বছর খুঁজে পাওয়া যায়নি।কেউ তেমন একটা খোজঁ খবরও নেয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি।
অবশেষে ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে কুড়িগ্রামের সাংবাদিক পরিমল মজুমদার সর্ব প্রথম খুঁজে বের করেন তারামনকে।তিনি সে দিনকার ভোরের কাগজে এ ব্যাপারে একটি প্রতিবেদনও লিখেছিলেন।বিমল কান্তি দে,পরিমল মজুমদার এবং স্থানীয় কয়েক জন মুক্তি যোদ্ধার সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত তারামনকে খুঁজে বের করা হয়। ১৯৯৫ সালের শেষদিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে তাঁর হাতে বীর প্রতীক খেতাবটি তুলে দেয়া হয়।অবশ্য এ সব নিঃস্বার্থ ভাবে যুদ্ধাদের খোজেঁ বের করার প্রেক্ষাপটটা ছিলো ভিন্ন।সে সময় বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রভাব ছিল।তখন মুক্তি যোদ্ধাদের কেউ অনাহারে,কেউ অর্ধাহারে মারা যান। কেউবা ভিক্ষা করে করে দিন অতিবাহিত করতেন।তারামনের জীবনটাও কেটেছিলো তেমনি ভাবে।তাঁর শঙ্কর মাধবপুর গ্রামে পরনে ছেঁড়া কাপড়, জীর্ণশীর্ণ শরীর নিয়ে তিনি কোনোভাবে দিনযাপন করছেন।

মুক্তিযুদ্ধের এমন বহু তারামন বিবিরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করেছেন কেবল মাত্র একটি লাল সবুজের পতাকার জন্য,একটি স্বাধীন সার্বোভুমত্বে স্বাধীন সম্মেলিত ভাবে বসবাসে শুধু নিজের জন্য নয় সারে সাতকোটি বাঙ্গালীর জীবন উন্নয়নের জন্য।তারা কি ভুল করেছিলেন?নতুবা যুদ্ধের পর তারাই কেন হবেন লোক চক্ষুর আড়ালে,তারা কেন হবে সামাজিক ভাবে অবমুল্যায়ণ তিরস্কার আর স্বামী সংসার ভিটে-মাটিহীন।যে মা তার সম্ভ্রম দিয়ে দেশকে স্বাধীন করলেন সেই মা কেন বেছে নিয়েছিলেন আত্মহত্যার পথটি?
আসছে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনের ৪৮ বছরে প্রশ্ন রেখে গেলাম আপনার কাছে,প্রশ্ন রেখে যাচ্ছি নতুন প্রজন্মের নিকট।দেশকে ভালবাস সঠিক ইতিহাস জানো তার ভিত্তিতে দেশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে এগিয়ে নাও।জয় বাংলা।

 

তথ্য কৃতজ্ঞতায়ঃ
অনলাইন বিভিন্ন মাধ্যম

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ