সেবার এক গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে  এসে অনেক দিন থেকেছিল মৃদুল। পুকুরে গোসল করতে যেয়ে নাসিমাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দিয়েছিল সে; এতে রেগে গিয়ে নাসিমা বলে ওঠে-

:তুমি পঁচা, তুমি একটা কুত্তা, অসভ্য, ইতর। এমন সব গালাগাল শোনে মৃদুলও নিজকে সামলাতে পারলোনা। একটা শক্ত মাটির ঢেলা হাতে নিয়ে ছুড়ে মারে নাসিমাকে। ঢেলাটা গিয়ে লাগে একেবারে তার কপালে। সাথে সাথে শুরু হলো কপাল ফেটে রক্ত পড়া। রক্ত দেখে ভড়কে যায় মৃদুল। তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ জেগে ওঠে। সে তো ঢিলটা মেরে ছিল এমনি এমনি, তা যে এক্কেবারে ঠিক ঠিক লেগে যাবে তা ভাবতেও পারেনি।  এখানে থাকা আর উচিৎ মনে করলো না মৃদুল। সেখান থেকেই ভেজা কাপড়েই দৌড়াতে লাগলো নিজেদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সে’তো আর কাছের পথ নয়। প্রায় তিন মাইলের পথ। যখন সে বাড়ি এসে পৌছে তখন সন্ধ্যার ঘন আঁধারে ঢেকে গেছে পথ-ঘাট। এই সব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে নিজে নিজেই মুখ চেপে হাসতে থাকে মৃদুল।

কখন যে  চুপিচুপি পিউ  এসে মৃদুলের পাশে দাড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি মৃদুল। পিউ দাড়িয়েই টিপ্পনী কেটে বলে-

: খুব যে একা একা বসে হাসা হচ্ছে, ব্যপার কী? কারো সাথে আবার ফিল্ডিং মারা হচ্ছে নাতো? বলেই এদিক ওদিক তাকায় পিউ। আশে পাশে কাউকে না দেখে সে আবার বলে-

: বাঁচা গেল। আমিতো ভাবছি আমার নাগর না জানি আবার দূরে বসে বসে কারো সাথে ফিল্ডিং মারছে। পিউর কথা শুনে হাসতে হাসতে মৃদুল  একটা খালী চেয়ার টেনে  পিউকে বলে-

: নাও বসো। চেয়াটায় বসতে বসতেÑপিউ বলে-

: কী ব্যাপার খুব যে কুটকুটিয়ে হাসছিলেন ? মনে আবার নুতন রঙ ধরলো নাতো।

: আরে না। এমনিই একটা কথা মনে পড়ছিলো। তাই হাসা।

: কী এমন হাসির কথা যে আমাকে কী বলা যায় না?

: না বলা যায় না । খুবই টপ সিক্রেট। মৃদুল বলে।

কী এমন টপ সিক্রেট কথা যে আমাকেও বলা যাবেনা ।

: বলা যাবেনা বলেই তো বলা যাবেনা।

পিউ হালকা অভিমানের মত করে বলে- : ঠিক আছে না বললে নেই।

পিউ চেয়ারে বসে গায়ে হলুদের মঞ্চের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে আছে। এতক্ষণ একটা ভেপসা গরম ছিল। গরমটা কেটে ফুরফুরে একটা বাতাস বইছে এখন। বাতাসে পিউর এক গোছা চুল বেশ বেপরোয়া ভাবে তার চোখেমুখে ঝাপটাচ্ছে। তার মুখে মেট মেকআপ সত্বেও আলোক সজ্জার রঙিন বাতির আলো এসে ঠিকরে পড়ছে।  এতে পিউর চেহারায় কেমন একটা মায়াময় ইন্দ্রজালের সৃষ্টি হয়েছে যেন। সেই ইন্দ্রজালে সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে থাকে মৃদুল।

পিউ নাসিমার বড় খালার মেয়ে। মৃদুলদের সাথে পিউদের আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেও দেখা-শুনা হয়েছে খুব কমই। কারণ পিউর বাবার চাকুরীর সুবাদে পিউরা থাকে চিটাগাং আর মৃদুল থেকেছে ঢাকা। তাই হয়তো বহুদিন পর কোনো পারিবারিক ওকেশনে ওদের মধ্যে দেখা সাক্ষাত হতো, বা কখনো হতো না। তবে শৈশবে পিউ তার মায়ের সাথে নাসিমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসলে সে ও সঙ্গী হতো মৃদূল ও নাসিমার। পিউ বয়সে ওদের থেকে কিছুটা ছোট ছিল বলে পিউকে দিয়ে নানা ফুট-ফরমাস খাটাতো। পিউর গায়ের রঙ ধবধবে শাদা ছিল বলে মৃদুল মাঝে মাঝে তাকে শাদা লাউ বলে ডাকতো। শাদা লাউ ডাকলে খুব রাগ করতো পিউ। হাতে পায়ে ধরে আবার মৃদুলই রাগ ভাঙ্গাতো।

এইবার ওদের সাথে দেখা হলো প্রায় সাত বছর পর। এ সাত বৎসরে কী যে বিস্ময়কর পরিবর্তন হয়েছে পিউর, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না। এ যাত্রায় আসার পর এক ফাঁকে প্রথম সাক্ষাতেই মৃদুল যেই বলেছে-

: সেই দিনের পুচকে মেয়ে দেখ কত্ত বড় হয়ে গেছে।

সে কথা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে পিউ বলেছে-

: বড় হবো না তো সারা জীবন পুচকেই থাকবো নাকি? নাকি পিগমি, বাটুল থাকাটাই আপনার পছন্দ ?

: না পুচকে থাকার কথা বলছি না, বলছি আরো সুন্দর আরো মনোলোভা হয়েছো এখন।

মৃদুলের কথার পিঠেই তাকে এক রকম চমকে দিয়েই পিউ বলে ওঠে-

: খুব লোভ হচ্ছে? এমন চাছা ছোলা কথা শুনে মৃদুল কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। এ কথার মোক্ষম কোন জবাবটা দেয়া যায়, তা নিয়ে সে কেমন ভাবনায় পড়ে যায়। একটু ভেবে নিয়ে একটা কিছু বলতে যাবে তখনই আবার পিউই বলে-

: বলতে সাহস হচ্ছেনা না?  বলুন, সাহস করে বলেই ফেলেন।

মৃদুল মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে-

: হচ্ছে। খুব লোভ হচ্ছে।

সে দিন এর বেশী আর তাদের কথা এগোয়নি। কেমন বেরসিকের মত বড় মামা হাজির হয়ে তাদের সামনের একটা ফাঁকা চেয়ারে বসতে বসতে বলেন-

: কিরে মুদুল তুই এখানে ব্ইসা বইসা কি করস?

পিউও ওঠে দাড়ায়। সেও বড় মোল্লাকে সালাম করে সরে যেতে চায়। কিন্তু বড় মোল্লা বলেন-

: না না চইলা যাওয়ার দরকার নাই। বস । বস। তোমাদের সাথে একটু আলাপ করি।

কিন্তু সেই সময় তাদের দু’জনের কারোই বড় মোল্লার সাথে আলাপে সামিল হ’তে ইচ্ছা করছিল ন না। দুজন তখন কেমন উসখুস করছিল। তবু ও মুরব্বির কথা তো আর অমান্য করা যায়না। বড় মামা ও আর ওঠে না। একেবারে নোঙর গেড়ে বসেন। তারপর সারাদিন গেছে দুজনের আর জুতসই সময় হয়ে ওঠেনি দু’দন্ড বসে কথা বলার।

ভাবনায় কেমন শান্ত পুকুরের মতো থিতু হয়েছিল মৃদুল। পিউ হঠাৎই সেই শান্ত পুকুরে ঢিল ছোড়ে। এতে সেই পুকুরে একটা মৃদু ঢেউ ওঠে-

: কি ব্যাপার, একেবারে টাসকী মেরে গেলেন যে।

: না টাসকী মারি নাই, একটু নষ্টালজিয়ায় পেয়ে বসেছিল।

: কোন নষ্টালজিয়া?

: ঐতো সেই মধুর শৈশবের। যখন ছোট বেলায় তোমরা আমরা এ বড়িতে বেড়াতে আসতাম, কি মজাই না হতো। তুমি আর নাসিমা আমার সাথে কি খুনসুটিটাই না করতে। রাতে এক সাথে জড়াজড়ি করে ঘুমাতাম। মাঝে মাত্র কয়েকটা বছর। এর মাঝেই কত পরিবর্তন হয়ে গেল। পিউ কথাটা এক রকম ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বলে-

: ভাবসাবে মনে হচ্ছে এখনো জড়াজড়ি করে ঘুমাতে মন চায়। মৃদুলও কম যায়না; সেও পিউকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে-

: মন চাইলেই কি আর সুযোগ আছে।

: সুযোগ তো নিজেই নষ্ট করলেন।

: কি ভাবে?

: কেনো খালাতো এক পায়েই খাড়াই ছিল আপনার হাতে নাসিমাকে তুলে দিতে। কিন্তু আপনিইতো হিজড়া পুরুষের মতো নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকলেন।

: তোমাকে এ কথা কে বলেছে?

: কেন, কে বলবে আর, নাসিমা আপুই বলেছে।

: ধুর। এসব বাজে কথা। তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছো।

: বিশ্বাস করুন, এই যে আমার মাথার দিব্যি। পিউ নিজের মাথায় হাত রাখে। পিউর শিশু সুলভ কান্ড দেখে মৃদুল হেসে বলে-

: যাও, বিশ্বাস করলাম। এখন বল, কি বলেছে ?

: ওরে বাবা। এখন দেখছি একেবারে তর সইছেনা।

: তর সইবেনা কেন, এমনিই জানতে চাচ্ছিলাম আর কি।

: ঠিক আছে। এতই যখন জানার শখ তবে বলি। পিউ খাকারী দিয়ে গলা ঝেড়ে বলে-

: লাস্ট সামারে আমরা ও নাসিমারা একটা ওকেশনে নানার বাড়ি গিয়েছিলাম। তখনই নাসিমার সাথে আপনাকে নিয়ে কথা হলো। আমি তার কাছে আপনার কথা জানতে চাইতেই, গলায় অনেকটা হতাশা আবার অনেকটা শ্লেষ ছড়িয়ে বলেছিল-

: কে রাখে কার খবর। সে যে ব্যস্ত মানুষ, যাকে বলে ভিজি ফর নাথিং আর কি। ওনি সবারই গোষ্ঠী উদ্ধার কইরা বেড়ান। এদিকে আসার কী আর তার মত ব্যস্ত মানুষের সুযোগ আছে। আসলে যদি কেউ আবার ঘার মটকায়, তাই হয়তো এদিকে আসেই না।

: আমি বলেছিলাম, তার জন্য কী তোর মন পোড়ে? আমার এ প্রশ্নের উত্তর সে সরাসরি না দিলেও আপনার জন্য তার যে ব্যকুলতার কোনো ঘাটতি নেই, তা সহজেই বুঝেছিলাম।

: কি ভাবে বুঝেছিলে তুমি, তুমি কি মনোবিশারদ।

: একজন মেয়ের কথা বুঝতে, কোনো মেয়েকেই মনবিশারদ হতে হয়না। একজন মেয়ে অন্য একজন মেয়ের মনের অবস্থা এমনিতেই পড়তে পারে, বুঝলেন বুদ্ধু। তবু সে বলেছিল, আমার মন পুড়লেই কি আর না পুড়লেই কি, তার ত হইল গিয়া ওসি, ডিসি, মন্ত্রী মিনিষ্টারদের সঙ্গে কারবার। আর আমি নিজে নিজে ত মন কলা খাইলেই হইব না, হে কি আমারে কিছু কইছে যে তার লাইগ্যা আমার মন পোড়াইতে হইব। এই কথাটা বলেই নাসিমা সেদিন বুক খালী করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিল।

কথা বন্ধ করে পিউ। হঠাৎই নিজের অজান্তেই যেন একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায় মৃদুলের বুক থেকেও। এ দীর্ঘশ্বাস মৃদুল গোপন করতে পারে না পিউর কাছে। পিউ ইয়ার্কী করে বলে-

: এতই যখন বুক ভরা দীর্ঘশ্বাস তা এত দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন কেন? শুধু মুখ খুলে বললেই তো হতো। খালা রাজি ছিল। রাজি ছিল নাসিমাও। আজ যে নাসিমার বিয়ে হয়ে অন্যের ঘরে চলে যাচ্ছে খুব কী খারাপ লাগছে?

মৃদুল ও কোনো ভনিতা না করে বলে-

: খারাপ তো কিছুটা লাগবেই। সেই কবেকার খেলার সাথী। কত না স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সাথে। চিরদিনের জন্যে চলে যাচ্ছে অন্যের ঘরে। শুধু ঘরে বললে ভুল হবে, চলে যাচ্ছে অন্যের অধিকারে।

: তাতো যাবেই। কেউতো কারো জন্য অন্ধকারে পথ চেয়ে থাকতে পারেনা। পিউ বলে।

: তুমি ঠিকই বলেছো। তবে তুমি আবার মনে করে বসনা আমাদের মধ্যে অন্য রকম কোনো সম্পর্ক বিল্ডাপ করেছিল।

: বিল্ডাপ না করলে এখন বুক ফুরে দীর্ঘশ্বাস বেড়–চ্ছে কেন? পিউর কথাটা মৃদুলের কানে কেমন যেন ঝাঁঝালো ঠেকে। তাই এ মুহর্তে আর এ বিষয়টা নিয়ে এগুতে চায়না মৃদুল। বিষয়টা এড়িয়ে যেতেই সে বলে-

: থাক, এসব কথা এখন বাদ দাও।

: কেন বাদ দেব কেন? আসলে পুরুষ জাতটাই খারাপ, তারা মেয়েদেরকে বুঝতে পারে না। একটা মেয়ে যদি মনে মনে কাউকে ভালোবেসে ফেলে, মুখ খুলে বলতে না পারলে সে কী মর্মজ্বালা তা’তো আপনারা বুঝবেন না।

কথাটা এক শ্বাসে বলেই কিছুটা সময় চুপ করে থাকে সে। কেমন নিঃপ্রাণ বসে থাকে মৃদুলও। এ অবস্থাটা ভেঙ্গে দেয় পিউ নিজেই। সে আবার বলে-

: জানেন, কাল সারা রাতই নাসিমা অনেক কেঁদেছে। আমি কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারিনি।

: কেন, ,এতো কাঁদবে কেন সে?

পিউ ঠোট উল্টিয়ে বলে-

: কি বোকার মত কথা, কেন কাঁদবে কেন সে? এতক্ষন আমি কি বললাম; আমি কি কথা বলেছি শোনেন নাই। নাকি বোকা সাজার ভান করছেন। কেঁদেছে এই কারণে, এক হলো আপনি, আর দুই নাম্বার হলো, তার বর পছন্দ হয়নি। বরের বয়স নাসিমা থেকে অনেক বেশী। পায়সা আছে ঠিকই। তবে কেমন ক্ষেত ক্ষেত ভুটকো টাইপের নাকি দেখতে।

: তা হলে তো বিয়েতে মত না দিলেই পরত সে। এই কথার পিঠেই পিউ বলে-

: সাথে সাথে অরো একটা রূঢ় কথা বলেছে।

: কি রূঢ় কথা।

: না আপনাকে এখন বলা যাবে না।

: কেন? বলা যাবেনা কেন?

: বলা যাবেনা এই কারণে, কথাটা আপনাকে নিয়েই।

: শুনি না কি কথা।

: না শোনার দরকার নেই। শুনলে আপনি কষ্ট পাবেন।

: কষ্ট পাব না। বল।

: সত্যি বলছেন কষ্ট পাবেন না।

: বললাম তো কষ্ট পাবনা। তুমি নিদ্বিধায় বলতে পার ।

কথাটা মৃদুলকে বলবে কি বলবে না এমনই একটা দ্বিধা দ্বন্দের মধ্যে পড়ে যায় পিউ। নিজে নিজে ভাবতে কিছুটা সময় নেয় সে। কথাটা শুনেই যদি মৃদুল বিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায়, তা হলে যে সব কিছুই মাটি হয়ে যাবে। কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা, এমনই একটা ভাবনায় পড়ে যায় পিউ। কথাটা শুনার জন্য মৃদলও বেশ উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। পিউর স্তব্দতা দেখে মৃদুল বলে-

: কেউ একটা কিছু বলবে বলে না বললে, আমার খুব রাগ হয়। তবে তোমার সাথে আমি রাগ করবো না। ইচ্ছা হ’লে বল, না বললে  নেই। কথাটা শুনতে অভিমানের মত মনে হয়। পিউ আর রহস্যের ঝাঁপি খুলে না দিয়ে পারে না। বলে-

: নাসিমা বলেছে, পিউ তুই মৃদুল ভাইয়াকে বলে দিস, আমার এ বাড়ি থেকে বিদায় হওয়ার আগে সে যেন আমার সামনে না আসে। কেননা, তাকে দেখলেই আমার কষ্ট আরো বেড়ে যাবে।

কথাটা বলে পিউ নিজেও আবেগে কেমন চুপসে যায়। মৃদুল ও চট্পট্ কিছু বলতে পারে না যেন। দুজনই কিছুক্ষণ স্তব্দ হয়ে বসে থাকে। বিয়ে বাড়ির এত হইচই ও হার্ডবিটের মিউজিক এর পরও কেমন একটা নৈঃশব্দতা এসে ভর করে দুজনের মাঝে। মৃদুলই নৈঃশব্দতা ভাঙ্গে-

: ওহ! তাহলে এই কথা। তাইতো বলি আমরা আসার পর থেকে আমাকে দেখলে নাসিমা কেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়।

: আমি আসার পর থেকেই বেশ ক’বার ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে আমাকে কোনো চান্স ই দিল না।

ঐ দিকে গায়ে হলুদের মঞ্চের কাছে মানুষের ভিড় অনেকটাই কমে গেছে।

দু’জনের কথার মাঝেই বাবু এসে হাজির, সে খুবই তাড়াহুরা করে বলে-

: মৃদুল ভাইয়া, নাসিমা আপু আপনাকে যেতে বলেছে। কথাটা পেড়েই আবার দৌড় দেয় বাবু। যেন ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে তার। এমনই ব্যস্ততা পরিলক্ষিত হলো তার দৌড় দেখে।

বাবুর কাছে কথাটা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না মৃদুল। সে কেমন উৎসুক দৃষ্টিতে পিউর মুখের দিকে তাকায়। পিউ ও অপ্রস্তুত হয়ে যায় কথাটা শুনে। সে নিজে নিজেই মৃদুলের সামনে একটা কৈফিয়ত দাড় করায়-

হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ প্রেমের আবেগের কাছে হেরে গিয়ে নাসিমা তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে হয়তো। একটু থামে পিউ। তারপর ঠোট কামড়িয়ে বলে-

: এখন তো দেখছি আমাকেই মিথ্যাবাদী বানিয়ে দিল। একটু থেমে পিউ আবার বলে-

: ঠিক আছে, সে যখন তার সকল আবেগকে সামলে নিয়ে আপনাকে যেতে বলেছে, এখন আপনার যাওয়া উচিত।

কিন্তু মৃদুল সহসাই উঠতে পারে না। তার  এখন মনে হচ্ছে কে যেন তাকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। কেমন অজানিত এক ধরনের আড়ষ্টতায় পেয়ে বসে তাকে। চুপচাপ বসে থাকে কিছুটা সময়।  পরিবেশটা স্বাভাবিক করার জন্য পিউ বলে-

: আমার চিঠিটা কী পড়েছেন?

: না এখনো পড়া হয়ে ওঠেনি। আর পড়ার সুযোগটাই বা পেলাম কোথায়। দেখলে না, বড় মামা কেমন একটা গেঞ্জাম বাঁধিয়ে দিলেন। পড়বো পড়বো, অবশ্যই পড়বো। অনুষ্ঠান শেষ হোক। তারপর একবার সময় করে পড়ে নেব।

মৃদুল ওঠেনা। কিছুটা সময় নেয়। এই সময়টায় সে আড় চোখে পিউর অবয়বের অভিব্যক্তিটা একটু পড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পিউর চেহারা দেখে তেমন কিছুই আচ্ করতে পারে না সে। কিন্তু হঠাৎ পিউই তাকে তাগাদা দেয়-

: কই যাচ্ছেন না যে। দেখেন না বেচারী এ দিকে কেমন  করে চেয়ে আছে।

: ঠিক আছে, চল। শুনি গিয়ে  কেন ডেকেছে।

: না আমি যাব কেন! আপনাকে যেতে বলেছে, আপনি যান।

: আমাকে ডেকেছে ঠিক, কিন্তু তুমি সাথে গেলে তো কোনো অসুবিধা নেই।

: অসুবিধা আছে, আপনার যাওয়া আপনি যান। পিউ বলে।

মৃদুলও কথা না বাড়িয়ে গায়ে হলুদের মঞ্চের দিকে হাটা দেয়। গায়ে হলুদের মঞ্চ তখন অনেকটা ফাঁকা। সবাইকে খাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছে। সবার মনযোগ এখন খাবার ঘরের দিকে। সে দিকেই দৌড়াচ্ছে সবাই। মানুষের পেট নামক অঙ্গটা একটা অদ্ভুত জিনিস। খাওয়ার নাম গন্ধ শুলেই কেমন খিচিয়ে ওঠে ওটা। খাওয়ার জন্য সবার দৌড় দেখে মনে হচ্ছে সবার মধ্যে খিচিয়ে ওঠার ব্যপারটা বেশ প্রবল হয়ে ওঠেছে। বিয়ে বাড়ির ব্যপার পরে গেলে আবার কোন খাবারের সর্ট পড়ে যায়, এ বিষয়টা যেন সবার মাথায়ই কাজ করছে।

নাসিমার কাছে এসে মৃদুল বলে-

: তুমি কী আমাকে ডেকেছো?

: হ, ডাকছি।

: বল কী করতে হবে?

: না, কিছু করতে হইব না।

: তা হলে ডেকেছো কেন?

: ভাবলাম সবাই হলুদ দিল, কিন্তু আপনেরে দেখলাম না।

: আমার তো আসার কথা নয়।

: ক্যান, আসার কথা নাই ক্যান।

: তুমিই নাকি আসতে বারণ করেছো।

: হ, করছিলাম । রাগে।

: এখন কী রাগ পড়েছে?

: হ, পড়ছে। পড়ছে বইলাই ত ডাকলাম।

: থাক। এখন আর হলুদ মেখে কাজ নেই।

: না। একটু মাখান। নাইলে অমঙ্গল হইব।

কথাটা বলার সাথে সাথেই নাসিমার চোখের কোণায় অশ্রুকণা ঝিলিক মারে। মৃদুল এখন সেই চোখের দিকে তাকাতে পারে না। এ অবস্থা কাটাবার জন্য সে হলুদের ডালা থেকে একটু হলুদ তুলে নেয় হাতে। মৃদুল যখন নাসিমার থুতনিতে হলুদের প্রলেপ দিচ্ছিল, ঠিক তখনই টপ টপ করে চোখের জল গড়িয়ে পড়লো মৃদুলের হাতে। সে আর হলুদ লাগাতে পারে না। আবেগে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। সে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।

এই সময়েই বড় ঘর থেকে নাসিমার মা ফরিদা ভানুর কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

এএএইইই্ মৃদুল। পিউউউ। তোমরা নাসিমাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি আইও।

খালার ডাক শুনে পিউ এগিয়ে আসে। দেখে নাসিমা কাঁদছে। পিউর চোখেও অশ্রু গড়ায়। আর মৃদুল তার বিষণ্ন ভারী মন নিয়ে তাকিয়ে থাকে আলোক ঝলমল বাতিগুলোর দিকে। তার বুকের ভেতর দলা পাকানো কষ্টগুলো ভীষণ বেপড়োয়া হয়ে ওঠে চোখের কোণে অশ্রুরা এসে ভির করতে থাকে। রঙিন বাতির ঝিলিক তার চোখে ঝাপসা ঠেকে। নাসিমা ও পিউ দু’জনের চেহারাই তখন কেমন অস্পষ্ট হয়ে ওঠে। [চলবে…]

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ