পিউ’র মনটা এ মুহুর্তে খুব খারাপ। বরের বাড়িতে নাসিমাকে নিয়ে বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। মৃদুলের সাথে কথা শেষ করার পরই ঘটনাটা ঘটেছে। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই নাসিমার মনটা বিষণ্নতায় কেমন ঢেকে আছে । কতক্ষণ পরপরই সে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে তার চোখ দুটি বেশ ফুলে ওঠেছে। এমন সুন্দরী বউ পেয়ে বর পক্ষের সবাই খুব খুশি। কিন্তু কিছু আগে নাসিমা তাকে ডেকে নিয়ে যে কথা বলেছে এবং সে কথা ও সিদ্ধান্ত নিয়ে যে দৃশ্যপটের সৃষ্টি হয়েছে তা এমন-

: পিউ। তুই আইজ রাইতে আমার লগে এই ঘরে ঘুমাইবি।

নাসিমা রসিকতা করছে মনে করে পিউ বলে-

: এ ঘরে ঘুমাবো মানে?

: ঘুমাবি মানে ঘুমাবি। আমি কি ইংরাজি বলতাছি।

: না তুমি ইংরেজি বলছো না বুঝেছি। তবে আমি এ ঘরে ঘুমালে তোমার জামাই ঘুমাবে কোথায়?

: আমি কি জানি।

: তুমি কি জান মানে? তুমি কি আমার সাথে মজা করছো।

: না মজা করছি না। আমি সত্য কথাঐ কইতাছি।

: ওর সাথে না ঘুমালে বিয়ে করেছো কেন?

: মুরব্বীদের মান রক্ষার লাইগা বিয়ে করতে হইব বইলাঐ বিয়া করছি। এখন তুই আমার লগে এই ঘরে শুইবি কি না বল।

: না। বাসর রাতে আমি এ ঘরে থাকতে যাব কোন দু:খে।

: না থাকলে তর যাওয়া তুই যা। আমার শরীলডা খুব খারাপ। কাপড় চোপর বদলাইয়া আমি ঘুমাইমু।

: ঠিক আছে আমি যাচ্ছি। তোমার বরকে পাঠিয়ে দিচ্ছি এক্ষণি।

সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে এভাবে যে নাসিমা ঘরের ভেতর থেকে দরজা আটকিয়ে বসে থাকবে, তা কখনো ভাবেনি পিউ। সে ভেবেছে, নাসিমা আপু হয়তো তার সাথে রসিকতা করছে। কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে ততই নাসিমাকে নিয়ে সমালোচনার মাত্রাটা বেড়েই চলেছে। সে এখন বসে আছে নাসিমার বাসর ঘরের ঠিক ওল্টোদিকের একটি ঘরের বারান্দায়। এই বাড়িতে অনেকগুলো টিনের কাঠ কেওয়ারী ও সেমিপাকা ঘর। সারা বাড়িতেই মেহমানে গিজগিজ করছে। পীরের বাড়ি বলে কোনো আলোক সজ্জা করা হয়নি। পিউ যে ঘরের বারান্দায় বসে আছে সেই ঘরের মহিলাদের নানা ধরণের অশালীন কথাবার্তার আওয়াজ এ মুহুর্তে তীরের মতো পিউর কানে এসে বিধ্ছে। কে একজন বলছে-

: এত বড় দামড়া মাইয়ার ঢং দেইখা বাঁচি না। দেখ! নিজের গেরামে আবার কোনু নাগর রাইখ্যা আইছে কি না। নাইলে মাইয়া এমন করব ক্যান। আবার

ভাষা শুনে মনে হচ্ছে ঢাকা থেকে এসেছে এমন একজন মহিলা বেশ উঁচু গলায়ই বলছে-

: দেখ। ছেমরী আবার সতী স্বাধ্বী সাজবার ভান করতাছে কি না।

আরেক জনের কথাটা আরো বিশ্রী, সে বলছে-

: বউ মসির লগে এক ঘরে ঘুমাইতে না চাইলে, বইয়ের বইনটারে পাশের ঘরে মসির সাথে ঢুকাইয়া হের লগেঐ মসি বাসর রাইত করুক। মহিলার এ কথায় সারা ঘর যেন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। এসব কথাবার্তা পিউ’র কাছে অসহ্য লাগছে। তাকে আবার ঐসব অসহ্য মহিলারা যে ঘরটিতে নাসিমাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলছে, সে ঘরটিতেই পিউর থাকার ব্যবস্থা করেছে। পিউ একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে সারা রাত না ঘুমিয়ে থাকলেও ঐ মহিলাদের সাথে একই ঘরে কিছুতেই সে শুতে যাবে না।

পিউ বেশ কিছুক্ষণ যাবতই লক্ষ্য করছে, নাসিমার বর বেচারা, মাঝে মাঝেই তাদের বাসর ঘরের দরজায় গিয়ে আস্তে আস্তে টোকাচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে নাসিমা দরজা খুলছে না। বেচারার জন্য বেশ খারাপ লাগে পিউ’র। হঠাৎই অন্ধকার ঠেলে  দৈত্বের ,মতো একটা লোক পিউর সামনে এসে হাজির হয়। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করার আগেই নাসিমার দেবর রবিন বলে-

: কিগো সুন্দরী বেয়াইন। এই গহীন রাত্রে এখানে একা বসে বসে কি করছেন। আপনার বোন তো আমার ভাইটাকে বাইরে রেখে মজা করছে। আর এখানে বসে বসে আপনি কি তাদের পাহাড়া দিচ্ছেন নাকি। আমার ভাই সোজা সরল মানুষ বলে ভাবী এ কাজটা করতে পেরেছে। আমি হলে...

: আপনি হলে কি করতেন।

: আমি হলে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ঢুকে হলেও আমার অধিকার আদায় করে নিতাম। সারা শরীর দুলিয়ে হেঃ হেঃ হেঃ হেসে পিউর পাশেই একবারে তার গা ঘেসে একটা খালী মোড়ায় ধপাস করে বসে পড়ে রবিন। পিউ’ ভয়ে শিহরে ওঠে। সে তার চেয়ারটাকে সরিয়ে নেয়। এমন একটা ভীতিকর সময়েই পিউ দেখে নামিার বর মসি উঠোনের অনতিদূরে পায়চারী করছে। সে ভয়ার্ত কন্ঠে ডাকে-

: দুলাভাই!

: এখানে আবার ভাইয়াকে ডাকার কি দরকার। ভাবলাম বেয়াইন একা একা বসে আছে তাকে একটু সঙ্গ দিই। একটু ইয়ার্কী মশকরা করি। নাহ, কেবল বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের মতো দুলাভাই, দুলাভাই বলে ডাকাডাকি।

বিরক্ত হয়ে রবিন চলে যায়। লোকটাকে মোটেই পছন্দ করে না পিউ। তার ওপর গায়েপড়া ভাব। এ বাড়িতে আসার পর থেকেই কোনো না কোনো উছিলায় পিউর সাথে ভাব জমাতে চাইছে । কিন্তু সে মোটেই পাত্তা দিচ্ছেনা রবিনকে। তা ছাড়া লোকটার চরিত্রে সমস্যা আছে বলে মনে হয়েছে পিউর কাছে। তার চাহনিও কেমন ইঙ্গিতপূর্ণ। তাই সে রবিনকে এড়িয়ে চলছে অনেকটা সতর্কভাবেই।

মৃদুলের প্রতিও ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সে নিজেই নিজেই বলে- সে নিজকে কি মনে করে। আরে পিউ কি এমনই ফেলনা যে তাকে যখন তখনই অপমান করতে হবে। না হয় আমি যেচে আগে আগে আমার মনের কথাটা বলে ফেলেছি। তাই বলে কি লাই পেয়ে যাবে। বান্দর কোথাকার।

: কা’কে বান্দর ডাকছো, রবিনকে ? মসি জিজ্ঞেস করে।

: না, দুলাভাই

: তবে কা’কে?

: আছে একজন।

: কে সে?

: না, আপনাকে বলা যাবেনা।

: কথাটা এড়াবার জন্য পিউ বলে-

: কি মশাই! এখনো বাসর ঘরে ঢুকার চান্স পেলেন না বুঝি।

: কীভাবে চান্স পাব। তোমার আপু তো কিছুতেই ঘরের ভেতর ঢকতে দিচ্ছে না। একটু থেমে আবার বলে-

: আমার মনে হয়... কথা শেষ করতে পারে না মসি।

: কি মনে হয়।

: মনে হয় আমাকে তার পছন্দ হয়নি। তার অমতে হয়তো আমার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। আবার কথা কাড়ে পিউ-

: আরে সাহেব এতে ঘাবরাবার কিছু নেই। এক সময় দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।

: না। আমার মনে হয় ঠিক হবে না।

: কি করে বুঝলেন।

: প্রথম দিনই যার এ অবস্থা। পরে কপালে আরো কোন দুঃখ আছে কে জানে।

মসির  কথায় ম্লান হেসে পিউ বলে-

: কপালে কোনো খারাবী নেই। সময় মতো দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।

: ঠিক হলেই হয়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে মসি।

: দুলাভাই, রাত তো প্রায় শেষের পথো আমার তো একটু ঘুমানোর দরকার নাকি।

: তাতো ঘুমাবেই। এই ঘরেই তো তোমার বিছানাপত্র সব রেডি।

: না আমি এ ঘরে এতো মানুষের সাথে গাদাগাদি করে ঘুমাতে পারবো না। আর আমি বুঝ হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কারো সাথে বেড শেয়ার করে শুতে পারি না। আলাদা বিছানা না হলে বরং এখানেই আমি বসে বসে রাত পার করে দেবো।

: না, তা করবে কেন। তোমাকে পাশের ঘরেরই একটা খালী বিছানা আছে, সেখানে গিয়েই তুমি আরাম করে ঘুমাও গিয়ে। চলো ওই ঘরে তোমাকে দিয়ে আসি। চলেন তা হলে।  [চলবে…]

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ