বিরূপ বসন্ত (ধারাবাহিক উপন্যাস) পর্ব-১০

মাহবুবুল আলম ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯, মঙ্গলবার, ১০:৩৬:৩০পূর্বাহ্ন উপন্যাস ১৯ মন্তব্য

মৃদুলের এখন একটা সিগারেট টানার খুব ইচ্ছা হচ্ছে। সুনসান বাড়ি। সবাই যার যার মতো ঘুমিয়ে গেছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকছে। গাছের তলায় কয়েল করে শুয়ে আছে টাইগার। মাঝে মাঝে কোনো কিছুর সামান্য আওয়াজ হলেই কান খাড়া করে তাকাচ্ছে। অন্ধকারে তার চোখের মনি ঝলঝল করে ওঠছে। এমন নিবিচ্ছিন্ন একাকীত্বে কি আর করা। সিগারেটেরও তেষ্টা পেয়েছে। সিগারেট বের করার জন্য প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকায়। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার বের করে মৃদুল আগুন ধারায়। কেমন একটা কাগজ পোড়া, কাগজ পোড়া গন্ধ এসে লাগে নাকে তার। সিগারেটে আবার টান দিতে যেয়েই দেখে সিগারেটের তামাকের দিকে আগুন না লাগিয়ে ফিল্টারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সে। এই কান্ডে নিজে নিজেই বেশ বিরক্ত হয় মৃদুল। আস্তো সিগারেটটা ফেলে দেবে কি দেবেনা ভেবে ফিল্টারটা ছিড়ে ফেলে দিয়ে; আবার আগুন লাগায় সে। আগুন লাগিয়ে একটা টান দিতেই বড় মামার ডাক শুনে সিগারেটটা পায়ের তলায় পিষে ফেলে, চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ায় মৃদুল। তার এ অবস্থা দেখে ওয়াহিদ মোল্লা বলেন-

: কিরে! সিগরেটটা ফালাইয়া দিলি ক্যান। ধরা, ধরা আর একটা সিগরেট ধরা।

মামার কথায় মৃদুল কেমন থতমতিয়ে যায়।

: আরে ধরা, ধরা। সরম পাওয়ার কিছু নাই। আমি ত সেই কবে থাইক্যাই জানি তুই খুব সিগরেট খাছ। সংকোচের কিছু নাই। ধরা, ধরা। পাশের একটি খালী চেয়ারে বসেই বলেন-

: খাড়াইয়া রইলি ক্যান। বস। বইসা আরেকটা সিগাটে ধরা।

: মামার কথায় বসলেও মৃদুল সিগারেট ধরাতে পারে না।

: বুঝছি। তুই আমার সামনে সিগরেট ধরাবি না। ঠিক আছে, আমারে একটা সিগরেট ধরাইয়া দে আমি টানি। এতক্ষণে মৃদুলের মুখ থেকে কথা বেড়ুয়।

: মামা। আপনে তো সিগারেট খান না। কোন দিন তো আপনাকে সিগারেট খেতে দেখিনি। ছোট বেলা থেকেই তো আপনাকে শুধু জর্দা দিয়ে পান খেতে দেখেছি।

: কোনদিন সিগরেট খাইতে দেখস নাই বইল্যা যে, আর কোনু দিনঐ  তা খামু না তা ত না। আর যে জর্দা খাইতে পারে সে সিগরেটও খাইত পারে। বুঝলি।

মৃদুল আর কথা না বাড়িয়ে বড় মামাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দেয়। ওয়াহিদ মোল্লা সিগারেটে টান দিয়ে খুউকক করে কেশে ওঠে। কাশতে কাশতেই বলেন-

: এত রাইত হইছে এহনও ঘুমাস নাই ক্যান। মনডা কি বেশী খারাপ।

: মামার এ প্রশ্নটা কেমন জানি ইঙ্গিতপূর্ণ বলে মনে হয় তার কাছে। তবু স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয় মৃদুল-

: না মামা, মন খারাপ না। এমনিই খোলা আকাশের নিচে একা একা বসে আকাশের বিশালত্ব দেখতে ভাল লাগছে। তা ছাড়া সারা বাড়িতেই তো কেমন যেন মরা বাড়ির শোক।

: হঅ । তুই ঠিকঐ কইছত। আমারও কেমন জানি ভালা লাগেনা। কত চেষ্টা করলাম একটু ঘুমাইতে, কিন্তু একবারঅ দুইচোখ এক করতে পারলাম না। আর মানুষের ঘুম না আইলে পেচ্ছাবের চাপটাঅ বাইড়া যায়। পেচ্ছাব করতে বাড়াইয়া দেহি তুই একলা একলা বইসা সিগরেট টানতাছছ।

: আপনার খারাপ লাগবে কেন, বরং নাসিমাকে পাত্রস্থ করে তো একটা বড় দায়িত্ব শেষ করলেন।

আবার সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধূয়া ছাড়েন ওয়াহিদ মোল্লা। কাশির ধকলটা ইতিমধ্যেই সামলিয়ে নিয়েছেন। ধূয়া ছেড়ে আবার একটা দম নিয়ে, নিজেই নিজেই বলেন-

: তুই যে কি বোকার মত কথা কস। ঘরডা খালী কইরা মাইয়াডা গেলগা, ত খারাপ লাগব না। তাছাড়া নিজের ত কোনো ছেলে সন্তান নাই। তাই নাসিমারেই নিজের সন্তানের মত মানুষ করছি। মাইয়াটা চইলা যাওয়ার পরে বাড়িটা কেমন খাঁ খাঁ করতাছে। কিছুই ভালা লাগতাছেনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওয়াহিদ মোল্লা  আবার বলেন-

: মৃদুল তুই কী জানছ তরে আমরা সবাই খুব ভালবাসি।

: জ্বি জানি মামা।

: কি জানছ?

: না-না , আমতা আমতা করে মৃদুল আবার বলে- ঠিক জানিনা।

: তইলে হুন কই। তরে দেখলেই আমার ক্যান জানি নিজের ছেলে বইলাঐ মনে অয়। তুই জানছ কি-না জানিনা। যেইদিন তুই জন্মাইলি হের দুইদিন পরেঐ তর বড় মামীর কোলেও আমাগোও একটা ফুট ফুটে ছেলে সন্তান অইছিল। তরে আর বাবুরে এক সাথে শোয়াইলে মনে হইত তরা বুজি যমজ ভাই। তোগ দুইজনরে পাইয়া আমাদের বাড়িত কি যে আনন্দ হেই কথা তরে ভাষা দিয়া বুঝাইয়া কইতে পারুম না। কিন্তু এই আনন্দ বেশী দিন স্থায়ী অইল না। যেই দিন তার ষষ্টি কইরা আকিকা দিয়া নাম রাখমু হের আগের রাইত পাঁচ দিনের দিন, ঢনুষ্টংকার হইয়া আমাগো বাবুটা মইরা গেল। এর পর আমাগো আর কোনো সন্তানাদি অইল না। হের লাইগাই আমরা তরে নিজের ছেলের মতো মনে করি। তরে দেখলেই মনে অয় এই বুজি আমাগো বাবু। হের লাইগাঐ তরে দেখলেই তর মামী খালী কাঁন্দে। তুই এই বাড়িত আইলে হে তোর সামনে বেশী আইতে চায় না। লুকাইয়া লুকাইয়া থাহে।

মামার এমন আবেগ মথিত কথা শুনে মৃদুলের মনটা কেমন ভারি হয়ে ওঠে। মামাকে শান্তনা দেয়ার মতো কোন ভাষা সে জড়ো করতে পারে না। মামার দিকে নজর পড়তেই মৃদুল দেখে আবছা আলোয় মামার অশ্রুভরা চোখ কেমন চিক্ চিক্ করছে। মৃদুল ভাবে মামার কাছ থেকে সে তাঁর যে মর্মযাতনার কথা শুনলো সেটাও কি ওনার সব সময় রেগেমেগে থাকার কারণ হতে পারে? ভাবনার মাঝেই ওয়াহিদ মোল্লা আবার বলেন-

: তরে  এত ভালবাসি বইল্যাই মনে মনে ঠিক করছিলাম তরে আর নাসিমারে বিয়া দিয়া নিজেগ পোলা বাড়িতঐ রাইখ্যা দেই। কিন্তু তর বড়মামী ক্যান জানি রাজি অইল না। তরে বেশী বেশী  দেহে কইরাঐ নাকি কে জানে।

ঠিক আছে যা এখন ঘুমা গিয়া। এত রাইতে আসমান দেইখা কাম নাই। চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলেন-

: আমি গেলামরে মৃদুল।

কাল ভোরে যে সে চলে যাবে এ কথাটা বলার জন্য একবার মামাকে ডাকতে চায়। কিন্তু মুহুর্তেই আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে। মামাকে এখনই চলে যাবার কথাটা বললে হয়তো ওনার আর বাকি ঘুমই আসবে না।

ওয়াহিদ মোল্লা সিগারেট টানতে টানতে বড় ঘরের দিকে চলে যায়। মৃদুল অবাক হয়ে মামার চলে যাওয়া দেখে। সে কিছুতেই ভেবে পায়না হঠাৎ করেই বড় মামার এত পরিবর্তন হলো কি করে। তা হলে তাঁর মধ্যে কী কোন অনুশোচনা কাজ করছে। যেমন নাসিমার মতো এমন একটা সুন্দরী মেয়েকে এমন একটা কুৎসিত বরের কাছে বিয়ে দেবার অনুশোচনা। না হলে মামা হঠাৎ করেই এতটা পাল্টে যাবেন কেন। যে মামার শাসন আর ভয়ে ভয়ে এতদিন গেল, সেই মামার এ পরিবর্তন মৃদুলকে কেমন ভাবনায় ফেলে দেয়। তবে মৃদুল সব সময়ই একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, বড়মামা সবার সাথে রাগারাগি খেটমেট করলেও তার সাথে কখনো এমন কোনো আচরণ করেননি তিনি। না করলে কি হবে। কিন্তু মামাকে দেখলেই সে ভয়ে কেমন কাবু হয়ে যেত। এবার বড়মামা যেভাবে খোলস ভেঙ্গে বেড়িয়ে এলেন তা তার কাছে খুবই আর্শ্চয্য ঠেকছে।

রাতও বেশ জমে ওঠেছে। এরই মধ্যে বেশ ক’বার হাই ওঠেছে তার। চোখের পাতাও ভারী হয়ে ওঠেছে বেশ। সে ওঠে দাঁড়ায় শোবার জন্য। [চলবে…]

 

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ