নিরাপদ আশ্রয়...
নিরাপদ আশ্রয়...

বাবা এই দুটো অক্ষর মিলে যে শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে, তার তুলনা আর কোনো শব্দের সাথেই করা যায়না। আমাদের জীবনে নিঃস্বার্থ স্নেহের একটিই স্থান, আর সে হলো আমাদের বাবা-মা। কথায় আছে মেয়েদের সাথে বাবাদের বেশী টান। আর মেয়েদের জীবনের একমাত্র নিরাপদ জায়গাও হলো বাবার বুক। ভালোবাসা আমরা বিভিন্নভাবে পেয়ে যাই। কিন্তু স্নেহের আশ্রয় একটাই। বাবা-মা আমাদের জীবনের বটবৃক্ষ। ঝড় এলে আশ্রয় দেয়, প্রচন্ড উত্তাপে ছায়া দেয়। কি আর বলবো বাবাদের নিয়ে!

আমার বাপি, যার আঙুল ধরে প্রথম স্কুলে যাওয়া। যার প্রচুর বকুনি, পিটুনি খাবার পরে নিশ্চিন্তে আবারও সেই বুকেই ঝাঁপিয়ে পড়া। আমার অল্প একটু মাথা ব্যথায় চুপ করে বসে থাকলে দৌঁড় ডাক্তারের কাছে। টনসিলে কথা বলা বন্ধ, খাওয়া একেবারেই না। শুধু জাউ ভাত খেয়ে তিনটি মাস, একা শুধু আমি না। সাথে বাপি-মামনি দুজনেই। বাপির সাইকেলে করে বাজারে যাওয়া। একবার মনে আছে বাপি মাছ বাজারে গেছে, আমি লাড়ু কাকুর দোকানে বসা। বাপি আর ফিরে আসছে না। বুকের ভেতর ব্যথা, কাঁদতেও পারছিনা। শুধু বললাম, কাকু বাপি আসছে না কেন? যখন বাপি এলো জলহীন কান্না। আমার শৈশব জুড়ে বাপির সাথে এমন অনেক সময়। কোথাও বেড়াতে গেলে ঘুমিয়ে পড়তাম বাসায় ফেরার সময়, বাপি কোলে করে নিয়ে আসতো। এতো বেশী নাদুস-নুদুস ছিলাম আমি, কেউ পারতো না কোলে নিতে। বড়ো হলাম বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, কতো মানুষ কতো কথা বলেছে। বাপি আমার উপর বিশ্বাস রেখেছিলো। আমার প্রতিটি সিদ্ধান্তকে আপন করে নিতো বাপি। কেন যে এতো বিশ্বাস আমি এখনও ভেবে পাইনা। আজও বন্ধুরা বলে আমার বাবার মতো বাবা খুব কমই আছে। বাবা-মেয়ে না, যেনো অসমবয়সী বন্ধু। ঢাকা থেকে বাপির জন্য রুমাল কিনে আনতাম, কি যে খুশী! এসেই বলতাম রুমাল দিলে ঝগড়া হয়, এক টাকা দাও। হেসে ফেলতো। কলকাতা গেলেই শপিং মল নয়, কলেজ স্ট্রীটে সবচেয়ে বেশী সময় কাটানো হতো। বাপি আমার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলতো, "বই কিনিস।" বাসায় ফিরে দেখতাম আমার জন্য শাড়ী-জামা কেনা হয়েছে। এমন একটি পরিবারের অংশ আমি, যেখানে আপন-পর কোনোদিন শেখানো হয়নি। রক্তের জনই যে শুধু আপন, তা নয়। যারা পাশে থেকে ছায়া দেয়, তারাই সবচেয়ে আপন। কতোগুলো উপদেশ আজও মেনে চলি,

১)কখনও কারো পেছনে সমালোচনা করিস না। সামনে বলার পর যদি না থাকে তাহলে বুঝবি তোর জীবনের জন্য সে ঠিক মানুষ না।
২)সবসময় সত্যি বলিস। মিথ্যে বলতে যাস না, সত্যিকারের ভালোবাসা হারিয়ে ফেলবি।

পৃথিবীতে সব বাবারাই তাঁদের নিজেদের সন্তানদের ভালোবাসেন। কিন্তু আমি জানিনা আমার বাপির মতো নাকি! মুখ খুলে না বলেও পেয়ে গেছি যা চাই। যার সাথে প্রচুর গল্প হতো একসময়। আজ কথা বললেও অর্ধেক কথাই বুঝতে পারিনা। তাই খুব অভিমান, আমি নাকি অবহেলা দেই শুধু। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফোন দিলাম। বললাম তোমার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান শোনো। গান ছাড়লাম। বললো, "অতো দু:খের গান কেনে?" তারপর ছাড়লাম "সুরের আকাশে" বাপির সবচেয়ে প্রিয় গান। ওদিকে শুনতে পাচ্ছিলাম বাপির গুনগুন। ছেলে তীর্থকে বললাম তাড়াতাড়ি রেকর্ড কর। সেটাই করলাম। যে বাপির গানের গলা অদ্ভূত সুন্দর ছিলো, সেই মানুষটি আজ কথা বলতে গেলে অস্পষ্ট শোনা যায়। স্মৃতির ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করতে এই উদ্যোগ। বাপির গল্প ফুরাবার নয়। ৪২ বছরের জীবন কি একটি পোষ্টে কুলোয়? নাহ! বাপি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। অনেক। বাপির কন্ঠে গানটি শুনুন এখানে।

আজ অনেক সন্তান আছে, যাদের পিতা নেই। আমি জানিনা বাবাহীন জীবন কেমন, কিন্তু অনুভব করি তাদের যন্ত্রণা। আমি এখনও ভাবতে পারিনা মামনি-বাপিকে ছাড়া। ঈশ্বরকে জিজ্ঞাসা করি যখন বাবা-মায়েদের প্রয়োজন তাদের সন্তানদের, তখন কেন সন্তানেরা পাশে থাকেনা? কেন পারিনা থাকতে? এই যে কতো আনন্দ করি, আমাদের ছেড়ে তারা কখনোও আনন্দ করেছে কি? উত্তর তার, 'না।' আমরা বেশীরভাগ সন্তানেরা বড়ো স্বার্থপর, তাঁদের প্রয়োজনটার চেয়ে নিজেদের চাওয়াটাকে আগে দেখি। পৃথিবীর সকল সন্তানদের অনুভূতি জাগ্রত হোক, বাবা দিবসে এটাই প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে। আর পৃথিবীর সকল বাবাদের জন্য শুভকামনা।

জন্মের রক্তঋণ

রক্ত প্রবহমান। এ সত্যের কাছে প্রজন্ম ঋণী।
যে সময়ের কাছে বন্দী নয় আমাদের জীবন,
যেখানে নেচে উঠতে পারে সমস্ত আবেগ
বয়সের বাধায় থেমে থাকেনা কিছুই।
আমাদের শিশুবেলা এবং কৈশোর থার্মোমিটারের পারদের মতো ওঠানামা করে
বাস্তব কাঠিন্যে।
তাবৎ পুরুষের বিষে যখন নারীত্বের অপমৃত্যু হয়,
বহু নারীদের ছলনায় যখন পুরুষের মধ্যে অবিশ্বাস জন্ম নেয়।
শুধু এক জায়গাতেই তো নারী-পুরুষ একাকার---
"ওঁ পিতা স্বর্গঃ, পিতা ধর্ম, পিতা হি পরমং তপঃ।।"
"জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী।।"
বিপন্ন জীবনের স্নেহাশ্রয় মায়ের জঠর, বাবার কোল।
পৃথিবীর বুকে একেকটি প্রজন্মের প্রথম পরিচয়;
এবং এখানেই নতজানু আমরা এই দুজন মানুষের কাছে।

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৮ জুন, ২০১৬ ইং।

সকল বাবাদের জন্য ফুলেল শুভকামনা...
সকল বাবাদের জন্য ফুলেল শুভকামনা...

11 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ

Thumbnails managed by ThumbPress