আমার মেয়েবেলার পুরোটা স্মৃতিই আমার বাবাকে ঘিরে। কারন, আমার জন্মের তিন বছর পর আমার একটি ছোট বোন হয়। আর তখন থেকেই আমি যেন অনেকটাই পর হতে লাগলাম আমার মায়ের কাছে।

আমি যখনি ঐ অজানা ছোট্ট মেয়ে বাচ্চাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াতাম, তখনই আমার মা বলে উঠতো, “ধরো না, বাবু ব্যথা পাবে।” আর আমি মনে মনে বলতাম, “এই ছোট্ট বাবুটা আবার কোত্থেকে আসল! ও আমাদের বাসায় আসার পর থেকেই আমার মা কেমন যেন পর হয়ে যাচ্ছে। আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এই বাবুটার ধারে কাছেও আমার মা আমায় যেতে দেয়না।কোথা থেকে আসলো এই বাবুটা!”

আমার স্মরণশক্তি খুব ভাল হওয়ার দরুন। মেয়েবেলার সমস্ত স্মৃতিই আমার খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে। আমি ছোটবেলা থেকেই বড্ড অভিমানী ও সংবেদনশীল ছিলাম সেই সাথে ছিলাম প্রচন্ডরকমের আত্মমর্যাদাশীল। একবার মা না বলায় দ্বিতীয়বার আর কখনো বোনকে ছুঁতে যাইনি আমি। রাতে ঘুমাতাম বাবার গলায় ধরে, তবুও মন খুব খারাপ থাকতো মায়ের সাথে না ঘুমানোর কারণে। তবুও বাবা-মাকে আমি তখন বুঝতে দেইনি মাকে মিস করার কথা। কারণ বাবা আমাকে পুরোটা রাত বুকে নিয়ে ঘুমাবে বলে বাবার চোখে মুখে জড়িয়ে ছিল আনন্দের ঝিলিক। মা আমার ছোট বোনের সাথে ঘুমাতেন। আমায় নিজে থেকে কখনো ডাকতোনা বলে আমি মনে মনে অভিমান করে নিজে থেকেই বাবার সাথে ঘুমাতাম। বাবা রোজ রাতে আমাকে বাঘ, সিংহের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পারাতেন। আমার বাবার বলা আমার সবচেয়ে প্রিয় গল্প ছিল, “বাঘের সাত ছাও” নামের মজার একটা গল্প। গল্পটা ছিল ঠিক এই রকম-

“ এক গভীর জঙ্গলে বাস করতো এক আদর্শবান বদমেজাজী বাঘ। তার ছিল সাত ছাও মানে সাতটা বাচ্চা। বাবা বাঘ খুব রাগী হলেও তিনি তার বাচ্চাদের অসম্ভব রকম ভালোবাসতেন। ওদেরকে নিজের হাতে গোছল করাতেন, নিজের হাতে খাইয়ে দিতেন, রাতে বুকে নিয়ে ঘুম পারাতেন। এক মুহুর্তের জন্যেও ওদের চোখের আড়াল হতে দিতেন না। বাঘের বাচ্চারা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো। স্নেহশীল বাবা বাঘেরও দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকলো। আমার বাচ্চারা বড় হয়ে যাচ্ছে। ওদেরকে আচার- আচরণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা শেখাতে হবে। সেই সাথে ওদের উজ্বল ভবিষ্যতের জন্যে ওদের লেখাপড়া শেখাতে হবে। অনেক ভেবে চিন্তে বাঘ এবার সিদ্ধান্ত নিলেন ওদেরকে লেখাপড়া করাবেন। শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। যেই ভাবনা সেই কাজ। পরের দিন সকালে বাঘ শেয়াল পন্ডিতের সাথে বাচ্চাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত কথা বলে আসলেন। শর্ত হলো বাঘের বাচ্চাদের শেয়াল পন্ডিতের বাড়িতে থেকেই লেখাপড়া করতে হবে। প্রতিদিন বাড়িতে যেয়ে এসে লেখাপড়া করলে ওদের মনোযোগ নষ্ট হয়ে যাবে লেখাপড়ার প্রতি। যদিও বাচ্চাদের চোখের আড়াল করা বাবা বাঘের জন্য অনেকটা মৃত্যুতুল্য। তবুও সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাঘ শেয়ালের শর্তে রাজী হলো।

শেয়াল পন্ডিত বাস করতো এক পাহাড়ের গর্তে। বাঘ প্রতিদিন সকালে একবার করে বিভিন্নরকমের মজাদার খাবার নিয়ে দেখা করতে যেতেন তার বাচ্চাদের সাথে। বাঘ শেয়ালের গর্তের বাইরে অপেক্ষা করতেন বাচ্চাদের জন্যে। ধূর্ত শেয়াল গর্ত থেকে এক সাথে সব বাচ্চাদের না এনে একটি করে বাচ্চা এনে দেখাতে লাগলেন। একজনের সাথে বাঘের দেখা করানো শেষ হলে তাকে গর্তে রেখে এসে অপর আরেকজনকে নিয়ে আসতেন। একদিন লোভী শেয়াল বাঘের একটা বাচ্চা খেয়ে ফেলল। পরের দিন বাঘ যখন তার বাচ্চাদের দেখতে এলেন, তখন ধূর্ত শেয়াল এক বাচ্চাকেই ডাবল দেখিয়ে সাত বাচ্চা দেখানোর কাজ পূর্ণ করলেন। এমনি করে লোভী শেয়াল একে একে বাঘের সব বাচ্চাদের খেয়ে সাবাড় করলেন। পরের দিন সকালে বাঘ তার বাচ্চাদের দেখতে গিয়ে শেয়াল এবং বাচ্চাদেরকে গর্তের মধ্যে না পেয়ে এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন। ধূর্ত শেয়াল বাঘকে দেখা মাত্রই দৌড়ে পালাতে লাগলেন। শেয়ালের ভীতিকর চেহাড়া আর দৌড় দেখে বাঘের আর কিছু বুঝতে বাকী রইলো না। সন্তানদের হারানোর শোকে বাঘ পাগল প্রায়। বাঘ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিবেন শেয়ালের উপর। একদিন সুযোগ বুঝে বাঘ ধূর্ত শেয়ালের ঘাড় মটকে খেলেন।”

ঐ সময় আমার ধারণা ছিল মানুষের বাচ্চাদেরও বুঝি শেয়াল পন্ডিতের কাছে লেখাপড়া করতে যেতে হয়। আমি মনে মনে বুদ্ধি করলাম, “আমি শেয়ালের কাছে লেখাপড়া করতে যাব ঠিকই কিন্তু আমি শেয়ালের বাড়িতে রাতে থাকব না। আমি থাকব আমার আব্বুর সাথে। আমি আমাদের বাড়ি থেকেই এসে যেয়েই লেখাপড়া করব। বিপদ আসার আগেই বাঘের গল্প শুনে সতর্ক হতে পেরে আমি আমার বাবার প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হয়ে ছিলাম। আমার বাবাও বাঘের মত প্রচন্ড রাগী ছিলেন। আমার মা থেকে শুরু করে পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে বাঘের মত ভয় পায়। কিন্তু তিনি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। সেই থেকে আমি আমার বাবাকে বাঘ আর নিজেকে বাঘের বাচ্চা ভাবতে শুরু করলাম।

আমার বাবা যখন দাদার বাড়ি বেড়াতে যেতেন, তখন সঙ্গে করে আমিও যেতাম। বাবা নদীতে গোছল করতে ভীষণ পছন্দ করতেন। আর তার ইচ্ছে ছিল আমিও যেন তারই মতন হই। একরকম জোর করেই বাবা আমাকে মেঘনার জলে নামতে বাধ্য করতেন। আমি জলে নেমেই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিতাম। এই বলে,'' ও আব্বু গো আমার পা’দুটো নদীর বালুগুলো খেয়ে ফেলল।”

আমার বাবা আমার কথা শুনে খুব হাসতো। শেষপর্যন্ত আমি আমার বাবার দু'পায়ের উপর ভর দিয়ে আমার দু'পা রেখে বাবার দুই হাত খুব শক্ত করে ধরে জলে ডুব দিতাম। গুণে গুণে তিনটা ডুব দিতাম। তখন বাবা বলতো, “এই তো হয়ে গেছে নদীতে গোছল। এখন আর কোন ভয় নেই।”

সেদিন বাবার সীমানাই আমার সীমানা ছিল। আজ সময়ের ব্যবধানে প্রত্যেকটা সম্পর্কের সীমানা বদল হয়ে গেছে। সীমানায় সীমানায় দাড়ি, কমা, সেমিকোলন টানা হয়েছে। আর আমরা ছেলেমেয়েরা খুব বেশি বড় হয়ে গেছি। খুব আধুনিক আর চালাক হয়ে গেছি। কিছু হলেই আমরা হয়তো বলে উঠি,''বাবা যা বোঝো না, তা নিয়ে কথা বোলো না।” আসলে তারা আমাদের থেকে খুব ভালই বোঝেন। শুধু বুঝিনা আমরাই। আমাদের চোখে আধুনিকতার রঙিন চশমা লাগানো তাই আজ আর অনেক কিছুই আমরা চোখে দেখতে পাইনা আমাদের ছোটবেলার মত।

শুনেছি আজ নাকি বাবা দিবস। অনেকেই অনেকভাবে তাদের বাবাকে উইশ করেছে। শুধু আমি আলাদা করে উইশ করিনি। আমার কাছে বাবা দিবস মানেই আমার প্রতিটা দিনই বাবার হাসি-মুখ দেখতে পাওয়া। বাবার গায়ের পান্জাবীতে তার খাওয়া পান- সুপারীর ঘ্রাণ নেওয়া। আমার বাবা আমার বটগাছ। আমার ছায়া। আমার বেঁচে থাকার অক্সিজেন।

আমি আমার মেয়েবেলার সময়টাকে এখন খুব মিস করি। আজ শত চাইলেও বাবা বাইরে থেকে এলে, আব্বু বলে চিৎকার করে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে আর আগের মত জড়িয়ে ধরে বাবার দু’গালে চুমু খেতে পারিনা। আজ সম্পর্কগুলোর মাঝে শুধু রয়ে গেছে স্পেস আর স্পেস।

ভাল থাকুক আমার বাবা। ভাল থাকুক এই পৃথিবীর সব বাবারা তাদের সন্তানদের জীবনে। একটি বটগাছ হয়ে। অক্সিজেন হয়ে। ছায়া হয়ে।

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ