বাংলাদেশে করোনা সংক্রামণের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে ভয়াবহতা বিরাজ করছে তাতে সাধারণ নাগরিক হিসেবে সত্যিই আমরা অনেকেই শঙ্কিত। তবে অবস্থাপ্রেক্ষিতে এই মৃত্যুর শঙ্কা যে সবাইকে ছুঁয়েছে তাও কিন্ত নয়। অথচ আমাদের দেশের করোনায় মৃত্যুহার ভারতের চেয়েও বেশি। গত সাতদিনের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে-  বাংলাদেশে প্রতিদিন করোনায় গড় আক্রান্ত ১৩,২৬৪ জন এবং গড় মৃত্যু ২৩১ জন। (৩০/০৭/২১ পর্যন্ত)

গত ১৪ দিনের হিসেবে গড় আক্রান্ত ১১,১৫৬ জন এবং গড় মৃত্যু ২১৪ জন। (জুলাই ১৭-৩০)

এর কারন হিসেবে বিশ্লেষকদের কাছে যে বিষয়টি মুখ্য বলে বিবেচিত হচ্ছে তা হলো- জ্বর সর্দি হলে সেটাকে সাধারণ অবস্থা ভেবে অবহেলা করা। আমাদের দেশে অনেকেই টেস্ট করে পজেটিভ আসলে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়েই এন্টিবায়োটিক খাওয়া শুরু করেন। বাড়ীতে থাকা অবস্থায় শ্বাসকষ্টের প্রকট সমস্যা নিয়ে পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। যা প্রাথমিক অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক জটিলতাই কাটানো সম্ভব হতো। মূলত এই ২টি সমস্যার জন্য মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হচ্ছে না।

করোনা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ তার কিছু খবর যা আপনারা অনেক মাধ্যমে পড়ে থাকবেন। আমি সংক্ষেপে হৃদয়বিদারক কিছু উদাহরণ দিলাম-

★ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে করোনা টেস্ট করাতে এসে লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ইকবাল (৪৩) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে!

★ কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনার উপসর্গ নিয়ে নমুনা দিতে এসে গত বুধবার সকালে কামরুন্নাহার (৪০) নামের এক নারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

★ শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় করোনা আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে মুগদা হাসপাতালে গিয়ে সিট খালি না পেয়ে সেখান থেকে স্ত্রীকে এই মুমুর্ষ অবস্থায়ই মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিজের কোমরের সাথে কাপড় পেচিয়ে বিএসএমএমইউ'র দিকে ছুটছেন স্বামী।

★ বাবার মৃত্যুর পর দাফন-কাফনের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন খবর এলো চিকিৎসাধীন ছেলেও মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর ১২ ঘণ্টার মধ্যেই বিয়োগান্তক এ ঘটনা ঘটল। পিতাপুত্র দুজনই চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

★ শ্বাস নিতে পারছে না ছেলে। মুমূর্ষ অবস্থায় আইসিইউতে শুয়ে থাকা মায়ের কানে খবরটা যেতেই ছটফট শুরু করেন তিনি। লাইফ সাপোর্টের সরঞ্জাম খুলে ছেলেকে আইসিইউতে আনতে চিকিৎসকদের ইশারা করতে থাকেন। শত চেষ্টা করেও মাকে বোঝাতে পারেননি চিকিৎসকরা। বাধ্য হয়ে মাকে নামিয়ে আইসিইউ বেডে তোলা হয় ছেলেকে। সেই সন্তানটিও পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন। অন্যদিকে আইসিইউ থেকে নামার একঘণ্টার মাথায় পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে করোনার কাছে হার মেনেছেন মমতাময়ী সেই মা।

হাসপাতালে বেড ফাঁকা নেই, মানুষ গাছতলায় অপেক্ষমাণ কখন একটি বেড পাবে। একটি বেডের জন্য আইসিইউ এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে চল্লিশজন রোগীর স্বজনেরা। ভিতরে যার রোগী আছে তাকে জিজ্ঞেস করছে- ভাই আপনারজন কি বেঁচে আছেন? এরমানে সেই রোগী মারা গেলে তারজনের জন্য আইসিইউ বেডের সিরিয়াল আসবে (নিজের চোখে দেখা)।

করোনা এখনো যাদের পরিবারে হানা দেয় নাই তাঁরা আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করুন। করোনা আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারের আর্তনাদ হয়ত আপনি আমি অনুভব করতে পারব না। একবার শুধু করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ঢু মেরে দেখুন কতটা যন্ত্রণা নিয়ে চলে যাচ্ছে একেকজন রোগী।

আমাদের উদাসীনতার কারনগুলি

এই যে পুলিশের সাথে লুকোচুরি খেলছেন, অযথা বাহিরে ঘুরাঘুরি করছেন, বিশ্বাস করুন করোনা আক্রান্ত হলে হাসপাতালে কোন সিট পাবেন না। আর আইসিউ'ত এখন সোনার হরিণ যা লাখ লাখ টাকা দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের নিকট ভবিষ্যৎ কি ভয়াবহ, কতটা দুর্বিষহ হতে যাচ্ছে ভাবতেই ভয় হচ্ছে।

আমাদের করনীয় -

আমাদের করনীয় কি তা বলার আগে বিগত দিনগুলিতে কি কি করা উচিত হয়নি সেগুলো আগে ভাবি তাহলেই করনীয় কি তা নিজেরাই বুঝতে পারবেন।

এক.

আমাদের দেশের আর্থসামাজিক যে প্রেক্ষাপট তাতে করে লকডাউন খুব একটা কার্যকর পদ্ধতি নয়। কারন সাধারণ খেটেখাওয়া মানুষের আয় উপার্জন বন্ধ হলেও তা দেশের জন্য চরম সমস্যা। ইকোসিস্টেম বাধাগ্রস্ত হবে, মানুষ অনৈতিক কাজে লিপ্ত হবে। এরচেয়ে বরং এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যাতায়াত বন্ধ করে নিজ জেলায় তা উন্মুক্ত করা যেতে পারে।

দুই.

জনগণকে এমনি এমনি বলেকয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানানো সম্ভব নয়। আমাদের নির্দেশনা আছে কিন্তু পালন করিনা। তারচেয়ে আমরা নিজেরাই বরং কিছু প্যারামিটার স্থাপন করতে পারি যেমন- কোন যানবাহন চালক, হেল্পারের মুখে মাস্ক না থাকলে আমরা তাতে উঠবোনা। তেমনি যাত্রী স্বাস্থবিধি না মানলেও তাকে গাড়িতে উঠতে বাধা দেবো। (এটি রিক্সা, ভ্যান, বাস সকলক্ষেত্রে)

তিন.

স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কারোরেই অবহেলাপূর্ণ যাচ্ছেতাই অবস্থা দেখলে ৯৯৯ এ কল করে জানানো এবং বিধিমোতাবেক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া।

চার.

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় একজন সাধারণ জনগণ এবং ক্ষমতাবান জনগনের তারতম্যে পার্থক্য না করা। স্বাস্থ্য আইন সবার জন্য সমান। রাস্তায় কারো প্রাইভেট গাড়ি চলবে আর রিক্সা দেখলে বাজেয়াপ্ত করবেন তা হবেনা। এরফলে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি আইন মানতে উজ্জীবিত হবে আশা করা যায়।

পাঁচ.

যেকোন কাজে (ব্যাংক, অফিস-আদালত ইত্যাদি) এনআইডি'র মত টিকাকার্ড দেখানো বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। তাতে মানুষ এমনিতেই স্বাস্থবিধি মানবে সেইসাথে টিকাও নেবে।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য-

এই সময় দেশে ডেঙ্গু জ্বরের ব্যাপক প্রকোপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ডেঙ্গু এবং করোনাভাইরাস জ্বরের লক্ষণ আমাদের জানতে হবে। যদিও ডাক্তারগণ উভয় টেস্ট করতে জোর দিচ্ছেন এবং তা উচিতও। তবে খুব ছোট করে বললে ডেঙ্গুতে প্রবল জ্বর আসে যা ১০২-১০৩ ডিগ্রী পর্যন্ত হতে পারে। হাড়ের জয়েন্ট প্রচন্ড ব্যাথা করে এবং চামড়ায় র‍্যাশ দেখা যায়।

অন্যদিকে করোনাভাইরাস এ মৃদুমন্দ জ্বর থাকে ৯৯-১০০ ডিগ্রী। শরীর হালকা ব্যাথা করে। সর্দিও হতে পারে, নাক বন্ধ হয়ে নিঃশ্বাসের সমস্যাও দেখা যায়। যা সাধারণ জ্বরের লক্ষনের মত বলে আমরা দ্বিধান্বিত হয়ে পরি। তাই এসব লক্ষণ দেখলে সাথেসাথেই ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন।

কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন -

হাই ফ্লো অক্সিজেন ন্যাজালের সংকটকালে সরকারকে ধন্যবাদ জানাই "বুয়েটের হাই ফ্লো অক্সিজেন যন্ত্র 'অক্সিজেট' ব্যবহারের অনুমোদন দেবার জন্য।"

বুয়েট কর্তৃক আবিষ্কৃত 'অক্সিজেট'

জাতির দুঃসময়ে এই অতি প্রয়োজনীয় যুগান্তকারী যন্ত্র উদ্ভাবন করে বুয়েটের যারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তারা প্রকৃত বীর। তাদেরকে প্রতি রইলো আমাদের অপার কৃতজ্ঞতা।

বর্তমানে ২৫ বছর বয়সী সকলেই করোনা টিকা নিতে পারছেন। আগামী ৭ আগস্ট থেকে এই বয়সসীমা ১৮ করা হচ্ছে এবং যাদের এনআইডি নেই তারাও বিকল্প ব্যবস্থায় টিকার আওতাভুক্ত হবেন বলে সরকারিভাবে বলা হয়েছে।

করোনার টিকা দেওয়ার গতি বাড়াতে ৭ আগস্ট থেকে দেশে বিদ্যমান সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) কার্যকর করা হবে। গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্য অস্থায়ী টিকাদানকেন্দ্রগুলোও কাজে লাগানো হবে। দিনে সাড়ে ৮ লাখ করে প্রতি সপ্তাহে ৬০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।।

এরপরেও নানা মুনীর নানান মত থাকবেই। তবে দিনশেষে কথা একটাই, বাঁচতে চাইলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই হবে আমাদের জন্য উপযুক্ত এবং কার্যকরী সিদ্ধান্ত। একটি দেশের রাজনৈতিক সরকারকে সকলের মন রক্ষার জন্য অনেক সিদ্বান্ত নিতে হয় যা আপনার আমার জন্য বিভ্রান্তিকর হতেও পারে। কিন্তু আমরা যদি নিজেরাই সচেতন হই তাহলেও অনেক জটিলতা এড়ানো সম্ভব।

এখনো সচেতন নন? এরপরে আপনার আমার কার পালা কে জানে!

এমতাবস্থায় বর্তমান প্রেক্ষাপটে করোনার টিকা নিলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা আবশ্যক এবং এটাই বাস্তবতা।

* ছবি- নেট থেকে

* তথ্যসূত্র - সংযোজিত

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ