গতকাল থেকে আমি খুবই বিষণ্ণতায় ভুগছি। জুয়েল ভাইকে কিছু বর্বর মানুষ পিটিয়ে হত্যা করার পরে তার লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে সেই ভিডিও দেখে আমার দু'চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছে। অন্তরাত্মা শুকিয়ে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি আমি।

আবু ইউনুছ মোঃ সহিদুন্নবী (জুয়েল) ভাই রংপুর জিলা স্কুলের ৮৬' ব্যাচের অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে গ্রন্থাগারিক পদে কর্মরত ছিলেন। একই কলেজের ছাত্র ছিলাম আমিও। তিনি আমার ছোটবোনেরও স্কুল শিক্ষক ছিলেন। কলেজ জীবনে আমরা লাইব্রেরীতে জুয়েল ভাইকে কত যে জ্বালিয়েছি! অথচ তিনি বিরক্ত হতেন না। আমাকে বলতেন- তুই দুষ্টামি ছাড়বিনা?

রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক জুয়েল ভাই

তিনি আমার পাশের পাড়াতেই থাকতেন। কখনো কেউ তার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে পারবেন না। তিনি অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। বেশ কিছুদিন আগে মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় চাকরী চলে যায় তার। ফেসবুকের একটি মন্তব্য থেকে জানলাম মানসিক ভারসাম্যহীনতায় তার বোনও আক্রান্ত ছিলো অর্থাৎ এটি হয়তো জেনিটিক্যালি পেয়েছেন তিনি। তারমানে নিশ্চিতভাবেই তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। তাহলে তার উপর এই বর্বরোচিত হামলা কেন?

অনলাইনে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে যা পেলাম - একটি লোক আসরের নামাজের পরে সেখানে আসরের নামাজ আদায় করা লোকদের মধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে দাবি করে, এখানে জেএমবির জঙ্গি আছে। হামলাকারীরা যেভাবে বর্ণনা করেছে সেই অনুযায়ী, লোক দুইটি আসরের নামাজের পরে মসজিদ উপস্থিত সকল মুসল্লির সামনে দাবি করে এখানে জেএমবির লোক আছে এবং মসজিদে বোমা আছে। এই কথা বলে তারা মসজিদের খাদেম এর নিকট কোরআন রাখা সেলফ চেক করার জন্য অনুরোধ করে। এক পর্যায়ে কোরআন নিচে রাখার অভিযোগ তুলে তাদের সাথে বাকবিতণ্ডা শুরু হয় এবং তাদের উপর হামলা করা হয়।

উগ্রবাদীদের অভিযোগ ছিল লোকটি কোরআনকে অবমাননা করার কারণে তাকে এই পরিণতি বরণ করতে হয়েছে। স্থানীয়দের কেউ কেউ দাবি করে, ২৯ অক্টোবর বিকেলে আসরের নামাজের পর ওই যুবক (জুয়েল ভাই) মোটরসাইকেলে এসে বুড়িমারী জামে মসজিদে ঢুকে পড়েন। তিনি সেখানে কোরআন অবমাননা করেন। তবে কীভাবে ওই যুবক কোরআন অবমাননা করেন আর কেনইবা তিনি সেখানে সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারেনি।

মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর বাইরে ছড়িয়ে পড়লে সেখানে আশপাশের লোকজন জড়ো হতে থাকে। উত্তেজিত জনতার হাত থেকে ওই ব্যক্তিকে বাঁচাতে এ সময় বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়। একপর্যায়ে ইউনিয়ন পরিষদে রাখা ওই যুবককে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে এনে পেটানো শুরু করে উত্তেজিত জনতা। বিজিবির চেকপোস্ট (বাঁশকল) এলাকায় ওই ব্যক্তির শরীরে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ সময় তার মোটরসাইকেলটিতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুন নাহার, পাটগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুমন কুমার মোহন্ত। তাঁরা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে তাঁরাও সেখানে আটকে পড়েন।

অনলাইন মাধ্যম থেকে আরো জানতে পারলাম জুয়েল ভাইয়ের সাথে নাকি সুলতান জোবায়ের আব্বাস নামে আরও একজন ব্যক্তি ছিলো যিনিও এই ঘটনায় জনতার রোষানলের শিকার হয়েছেন। কিন্তু আব্বাস নিজেকে দলিল লেখক দাবি করে হাসপাতালে গতরাতে গণমাধ্যমকে জানান, তিনি তাঁর এক মক্কেলের সঙ্গে দেখা করতে এসে বুড়িমারীতে উত্তেজিত জনতার মারধরের শিকার হন। তাঁর সঙ্গে নিহত ব্যক্তি (জুয়েলর) কোনো পরিচয় নেই। তবে কেন আব্বাসকে এসবের সাথে জড়ানো হয়েছে তাও কিন্তু রহস্যময়।

তাহলে আমার প্রশ্ন হচ্ছে এখানে কোরআনকে কিভাবে অবমাননা হলো? ধর্মানুভূতিতে আঘাতের নামে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কাউকে এভাবে বর্বর হামলার শিকার হতে হবে এটা এই সভ্য সমাজে মেনে নেয়া যায়না। আমরা কি আসলেই সভ্য? নাকি সভ্যতার আড়ালে জিইয়ে রেখেছি নিজেদের পশুত্বকে?

ইসলাম শান্তির ধর্ম। অরাজকতা, বর্বরতা, নৈরাজ্যবাদ এসবের কোন স্থান ইসলাম ধর্মে নেই। আল্লাহ্‌ পবিত্র কোরআনে বলেছেন- "বিদ্রুপকারীদের শাস্তির জন্য তিনি নিজেই যথেষ্ট।" 

“আগুনের রব ব্যতীত আগুন দিয়ে কিছুকে শাস্তি দেয়ার কারো অধিকার নেই।" [আবু দাউদ #২৬৭৫]

“আল্লাহ ছাড়া কেউ আগুন দিয়ে শাস্তি দিতে পারবে না।" [বুখারী #৩০১৬]

এটা লন্ডন বা ফ্রান্স নয়। বাংলাদেশে কোন নাস্তিকও কোরআন পুড়ানো বা ছিঁড়ে ফেলার সাহস করবেনা। আর মসজিদেতো নয়ই। জুয়েল কেমন মানুষ ছিলো তা তার কাছের মানুষদের অনলাইন স্ট্যাটাসগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন। [স্ট্যাটাসগুলো দেখতে এখানে ক্লিক করুন]

আসরের নামাজের পরে মসজিদে সেই এলাকায় বা মসজিদের আশেপাশে এমন কোনো আলোচনা কি হয়েছিল যার প্রেক্ষিতে লোক দুইজনের অনুধাবন হয় এখানে জেএমবি জঙ্গি আছে এবং জঙ্গিদের সাথে বোমাও আছে? সেই অনুযায়ী জুয়েল ভাই মসজিদের তল্লাশি করতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তুলে জেএমবিদের রক্ষা করা হয়। জুয়েলভাই বেঁচে থাকলে হয়তো জানা যেতো সবকিছুই। সুষ্ঠু তদন্তে সত্য ঘটনা সবাই জানতে পারবো আশা করি।

মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারনে যার চাকরী চলে যায় তাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কারা বা কেউ হত্যার চেষ্টা করেছে কিনা তাও কিন্তু ভাববার আছে। মানুষ হয়ে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা! এরা কোন ধর্মের মানুষ? যারা দাঁড়িয়ে দেখছিলো তাদেরকেও অবশ্যই আইনের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

জুয়েল ভাইয়ের কাছে আমি ঋণী রয়ে গেলাম। কলেজ লাইব্রেরীতে তার হাত থেকে নেয়া একটি বই তাকে ফিরিয়ে দিতে পারিনি, হারিয়ে ফেলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন- জরিমানা দিবি কিন্তু! যেদিন জরিমানার টাকা দিতে গিয়েছিলাম সেদিন বলেছিলেন- যাহ! বেশী পাকনামী করিসনা, তোর টাকা আমি দিয়ে দিয়েছি। তোদের জ্বালায় আমার চাকরীও থাকবেনা দেখছি!

যুগে যুগে ধর্মের নামে যারা ধর্মকে অবলম্বন করে নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য বর্বরতা চালায় তাদের বিচার অবশ্যই করতে হবে। না হলে "ধর্ম শান্তির জন্য" এই বাক্যটি শুধুমাত্র একটি কথার কথা হিসেবে আমাদের প্রজন্ম গ্রহণ করবে সেকথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

জুয়েল ভাইকে তারা হত্যা করেছে। এই বর্বরোচিত হত্যার বিচার চাই। আমাকে ক্ষমা করবেন জুয়েল ভাই। আমি সত্যিই আজ লজ্জিত।

শিশু সন্তানের সাথে জুয়েল ভাই

জুয়েল ভাইয়ের নিস্পাপ শিশু সন্তানের কাছে মুখ দেখাবো কি করে বলতে পারেন?

[ তথ্যসূত্র ও ছবি - অনলাইন নিউজ, ফেসবুক ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে ]

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ