বন্ধু কাইল্লা কামাল

রুমন আশরাফ ২৭ অক্টোবর ২০১৯, রবিবার, ০১:৪১:১১অপরাহ্ন গল্প ২৮ মন্তব্য

বছর পাঁচেক আগের কথা। সিলেটে বদলী হলাম। নতুন বাসা নিয়েছি। নিয়েছি মানে অফিস থেকেই দিয়েছে। ফ্ল্যাট বাসা। একাই উঠেছি বাসায়। আরও একজন কলিগ আর একজন বাবুর্চি কাম কেয়ার টেকার আসার কথা। তবে তখনও তারা আসেনি কেউ। আসতে আসতে আরও এক সপ্তাহ। সকালে অফিসে যাই। রাতে ফিরি। খাওয়ার পর্বটা তখন হোটেলেই সেরে নিচ্ছি।

সেদিন ছিল শুক্রবার। বাসাতেই আছি। সকালে ঘুম ভেঙে দেখি ঝুম বৃষ্টি। বাইরে যাবার উপায় নেই। সাথে ছাতাও নেই। ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে। বাসায় হালকা নাস্তা টাইপের কিছু নেই। শুধু চা আছে। আপাতত চায়ের পর্বটা সেরে নিলাম। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো আর চায়ে মিটবে না। বিছানায় শুয়ে শুয়েই নেট ঘাঁটছি। আশেপাশে কোনও রেস্টুরেন্ট আছে কিনা খোঁজ নিচ্ছি। হোম ডেলিভারি দেয় এমন রেস্টুরেন্ট খুঁজছি। ঘাঁটতে ঘাঁটতে পেয়ে গেলাম একটা রেস্টুরেন্ট। সঙ্গত কারণে রেস্টুরেন্ট এর নাম বলছি না। ওয়েব সাইটে গিয়ে ফোন নাম্বার পেয়ে গেলাম। ফোন দিলাম ঐ নাম্বারে।
-“আসসালামুয়ালাইকুম”।
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম। আপনাদের ওয়েব সাইট থেকে নাম্বারটি নিলাম। আপনাদের রেস্টুরেন্ট থেকে কি খাবার হোম ডেলিভারি দেয়া যাবে?”
-“জি স্যার যাবে। তবে শহরের মধ্যেই হতে হবে আপনার অবস্থান। আপনি কি খাবার অর্ডার করবেন এবং আপনার অবস্থান কাইন্ডলি মোবাইলে ম্যাসেজ করতে পারেন”।

আমি খাবার এর মেন্যু এবং ঠিকানা মেসেজ করলাম। ঘণ্টা খানিক সময় লাগবে হয়তো। হাতে তেমন কোনও কাজ নেই। ড্রইংরুমে বসে টিভি চালু করলাম। অনেকদিন হল টিভি দেখা হয় না। একটা সময় ছিল যখন চ্যানেল বলতে বিটিভিই ছিল। শুক্রবার সকাল থেকেই শুরু হতো বিভিন্ন প্রোগ্রাম। স্কুল ছুটি থাকতো বলে সকাল থেকেই বসে যেতাম টিভির সামনে। এখন তো টিভি দেখা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি। সোফায় বসে বসে চ্যানেল চেঞ্জ করছি আর দেখছি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলটা দেখা যায়। অনেকদিন হল ওয়াইল্ড বিস্ট কিছু দেখি না। চ্যানেল উল্টাতে উল্টাতে কাংখিত চ্যানেলের দেখা পেলাম। পাখিদের জীবন কাহিনী দেখাচ্ছে। খুব মন দিয়ে যে দেখছি তা নয়, ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে। ক্ষুধার্ত অবস্থায় বেশ অস্বস্তি লাগছে।

নতুন বাসা। আশেপাশে কোথায় কি কি আছে তাও ঠিকভাবে জানা হয়নি। গতকালের কেনা খবরের কাগজের দিকে চোখ বুলাচ্ছি। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ কানে আসলো। কলিং বেলটা তখনও লাগানো হয়নি। সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার পিপহোলের দিকে চোখ রাখলাম। দেখলাম খাবারের প্যাকেট হাতে একজন দাঁড়িয়ে আছে। আমি দরজা খুললাম।
-“আসসালামুয়ালাইকুম। খাবারের অর্ডার ছিল। আপনি কি আলম স্যার বলছেন?” আমি অবাক চোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছি। বয়সটা আমার মতই হবে। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে।
-“ওয়ালাইকুমুসসালাম। আসুন ভেতরে আসুন”। লোকটি আমার পেছন পেছন আসলো। খাবার এর প্যাকেটটি হাতে নিয়ে সোফায় বসতে বললাম।
-“স্যার এই নিন বিল। খাবারটা আশাকরি ভাল লাগবে আপনার”। আমি বিলটা হাতে নিলাম।
-“কিছু মনে করবেন না। আপনাকে বেশ পরিচিত লাগছে। আমার এক বন্ধুর মতো দেখতে আপনি। কি নাম আপনার?”
-“বন্ধুর মতো লাগার কিছু নেই। আমি আপনার বন্ধুই। আমার নাম কামাল। আপনারা যাকে কাইল্লা কামাল বলে ডাকতেন”। আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু চিৎকার দিলাম।
-“তুই কামাল! মানে আমাদের কাইল্লা কামাল! কি অবস্থা তোর? মাথার চুল তো নাই হয়ে গেছে রে। মোটাও হয়েছিস অনেক”।

কামাল আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। প্রায় পনের বছর পর দেখা আমাদের। বাবার চাকরির সুবাদে একসময় আমরা সিলেটে থাকতাম। কামাল ছিল স্থানীয় ছেলে। দুবছর আমরা একই স্কুলে পড়েছি। বাবার বদলীর কারণে নবম শ্রেণীতে উঠেই স্কুল পরিবর্তন করতে হয় আমাকে। এরপর হতে ওর সাথে আমার আর যোগাযোগ নেই।

-“বন্ধু রেস্টুরেন্টে অনেক কাজ পড়ে আছে। আমাকে যেতে হবে। একদিন আসিস। কথা হবে। পারলে আজ সন্ধায় আয়। জমিয়ে আড্ডা দেবো”।

কামালকে বিদায় দিয়ে খেতে বসলাম। বেশ সুস্বাদু খাবার। ভুনা খিচুড়ি আর মুরগীর মাংস। বৃষ্টির দিনে এর চেয়ে মজার খাবার আর কি হতে পারে! খেতে খেতে কামালের কথা মনে পড়লো। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ছাত্রাবস্থায় বেশ ভাল ছাত্র ছিল সে। অথচ আজ সে কাজ করছে এক রেস্টুরেন্টে। মনটাই কেমন যেন খারাপ হয়ে গেলো।

সন্ধায় বাসা থেকে বের হলাম। একটু এদিক সেদিক ঘুরে আসা যাক। কামালের ওখানে যাবো কিনা ভাবছি। রেস্টুরেন্টটা আমার বাসা থেকে খুব একটা দূরে নয়। হাঁটতে হাঁটতে রেস্টুরেন্টে গিয়ে পৌঁছলাম। ভেতরে ঢুকেই ক্যাশে বসে থাকা রেস্টুরেন্টের ম্যানেজারকে কামাল এর কথা জিজ্ঞাসা করলাম। আমাকে উনি বসতে বললেন। আমি রেস্টুরেন্টের এক কর্নারে এসে বসলাম। একজন ওয়েটার খাবারের অর্ডার নিতে আসলো।

-“স্যার কি লাগবে বলুন। মেন্যুতে মেনশন করা আছে”।
-“আপাতত কিছু লাগবে না। আমি কামাল এর সাথে দেখা করতে এসেছি”।
-“স্যার, কোন কামাল? যদিও আমাদের এখানে কামাল নামে একজনই আছেন। উনি এখন কিচেনে আছেন”।
-“আপনি তাকেই একটু ডেকে দিন। আমি অপেক্ষা করছি”।
-“ঠিক আছে স্যার। আপনি বসুন আমি ওনাকে ডেকে দিচ্ছি”।

আমি বসে আছি। রেস্টুরেন্টের ভেতরে আশেপাশে তাকিয়ে দেখছি। বেশ ভালই ইন্টেরিওর ডিজাইন। আধো আলো আধো অন্ধকারে ছেয়ে আছে পুরো রেস্টুরেন্ট। লাইটিং ইমেজটা বেশ সুন্দর।

-“কিরে কখন এলি? আমি একটু কিচেনে ছিলাম”। আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে কথাগুলো বলল কামাল।
-“এইতো হবে কিছুক্ষণ। রান্না করছিলি বুঝি?”
-“ঠিক রান্না না। শেফকে রান্না বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম। আর একটু খোঁজ খবর নিলাম কিচেনের”।
-“কতদিন হল এই রেস্টুরেন্টে আছিস? কেমন সুযোগ সুবিধা এখানে?”
-“আয় তোকে একটু ঘুরে দেখাই। তাহলেই বুঝবি”।

কথাগুলো বলেই কামাল উঠে দাঁড়ালো। আমিও ওর সাথে সাথে দাঁড়ালাম। কামাল আমাকে নিয়ে গোটা রেস্টুরেন্ট ঘুরে দেখালো। রেস্টুরেন্টের সিকিউরিটি সিস্টেম থেকে শুরু করে খাদ্যের মান সব দেখালো। খাবারের আইটেম কি কি আছে দেখালো। রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থাপনা আর পরিবেশ দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

-“দোস্ত তুই তো বেশ ভাল জায়গাতেই জব করছিস। তোর মালিক খুব সৌখিন মনে হচ্ছে”।
আমার কথা শুনে কামাল মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
-“আয় তোকে একটা স্পেশাল খাবার খাওয়াই। রফিক এদিকে এসো। স্যার এর জন্য আমাদের স্পেশাল খাবারটি দাও”।
-“কামাল আজ থাক। পরে অন্য একদিন খাবো। আজ বরং কফি খাই। কফি পাওয়া যায় তো?”
-“শুধু কফি! আচ্ছা ঠিক আছে। পরের বার এলে কিন্তু না করতে পারবি না”।

কফি শেষ করে হাত ইশারা করে ওয়েটারকে ডাকলাম।
-“আর কিছু লাগবে স্যার”।
-“না লাগবে না। আপনি বিলটা নিয়ে আসুন”।
ওয়েটার তাকিয়ে আছে কামাল এর দিকে। কামাল চোখের ইশারায় ওয়েটারকে চলে যেতে বলল। ওয়েটার চলে গেলো।
-“তুই আমার গেস্ট। বিল তুই দিবি কেন? আর আমার এখানে গেস্ট এলে আমি কখনোই বিল পরিশোধ করতে দেই না। তোর যখন ইচ্ছা আসবি, খেয়ে বিল পরিশোধ না করে চলে যাবি। কেউ তোকে কিছু বলবে না। তোর কথা আমি ম্যানেজারকে বলে রাখবো। এবার চল তোকে বিদায় দেই”।

আমরা আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালাম। কামাল এগিয়ে যাচ্ছে ক্যাশে বসে থাকা ম্যানেজার এর দিকে। আমি ওর পেছন পেছন যাচ্ছি। খানিকটা ইতস্তত বোধ হচ্ছে আমার। ম্যানেজার এর সামনে এসে দাঁড়াতেই ম্যানেজার উঠে দাঁড়ালো।

-“কি সব ঠিক আছে তো? জব কেমন লাগছে?”
-“জি স্যার ভাল”।
-“শোনো উনি হচ্ছেন আমার বন্ধু। বাল্যবন্ধু। উনি যখন ইচ্ছা আসবেন, যা ইচ্ছা খাবেন। ওনার কাছ থেকে খাবার এর দাম নেবে না”।
-“জি আচ্ছা স্যার”।

কামাল আর ম্যানেজার এর কথোপকথন শুনে আমি অবাক হই। কামালকে স্যার স্যার করছে। আবার আমাদের দেখা মাত্র চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ঢুকছে না।

-“বুঝলি খুব যত্ন নিয়ে কষ্ট করে রেস্টুরেন্টটি বানিয়েছি। ইংল্যান্ড থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে এম.এস শেষ করে দেশে এসে রেস্টুরেন্টটি দিলাম। নিজের জমানো কিছু টাকা আর বাবার পেনশনের কিছু টাকা মিলিয়ে শুরু করলাম ব্যাবসা। এখানকার প্রতিটি স্টাফদের প্রতি আমার বিশেষ নজর থাকে। কাউকেই আমি ছোট করে দেখি না। আমি নিজেই নিজেকে রেস্টুরেন্টের স্টাফ মনে করি। মাঝেমাঝে নিজেই যাই কিচেনে। হোম ডেলিভারি থাকলেও মাঝেমাঝে আমি নিজেই যাই খাবার পৌঁছে দিতে। খুব ভাল লাগে কাজগুলো”।

কামাল এর শেষের কথাগুলো শুনে আমি রীতিমত অবাক হলাম। ও যে এই রেস্টুরেন্টের মালিক তা এতক্ষণ পর বুঝলাম। নিজেই যেন নিজের কাছে লজ্জা পেলাম। তবে বুঝতে দিলাম না যে আমি এতক্ষণ ওকে এই রেস্টুরেন্টের স্টাফ ভেবেছি।

কামাল এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। কামাল এর ব্যক্তিত্ব, অতিথিপরায়নতা এবং কাজের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি বিমোহিত। জীবনে বহু বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত বন্ধু কামাল। অফুরন্ত ভালবাসা তাঁর জন্য।

... Rumon Ashraf

0 Shares

২৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ