বধূ বরণ

নীরা সাদীয়া ১১ জুলাই ২০২০, শনিবার, ১১:০৭:৩১অপরাহ্ন সমসাময়িক ২৪ মন্তব্য

আমি যা কিছু লিখি, অনেকেই ধরে নেন, এটা আমার সাথেই ঘটেছে। আসলে তা নয়। আমি আমার চোখে দেখা প্রতিটি ঘটনাকেই একটু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তারপর লিখি। উদ্দেশ্য থাকে সমাজের মানুষকে সচেতন করা।

 

কয়েক বছর আগে আমাদের এলাকায় একটি বিয়ে হলো। আমাদের পরিবারের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় আমরা আদ্যোপান্ত ঐ বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম। আমরা ছিলাম ছেলে পক্ষ। বর যাত্রী থেকে শুরু করে বৌভাত পর্যন্ত আমি হাজির! বিয়ে পড়িয়ে বৌকে নিয়ে আসা হলো, ফুল দিয়ে খাট সাজালাম আমি। বৌ নতুন জায়গায় এসে একটু হিমশিম খাচ্ছিল। চুলের জট খুলে মাথায় তেল দিয়ে দিলাম যেন একটু আরাম পায়। পরদিন ভোর হলো। তার শাশুড়ি আমাকে বললো,

:নতুন বৌকে ডেকে বলো, ভোর হয়েছে। নতুন বৌ এত বেলা করে ঘুমোতে নেই।

 

অগত্যা তাকে ডেকে তুললাম। বৌ হাতমুখ ধুবে, পায়ের কাছে জুতো এনে দিলাম। আমি ভেবেছি, এতটুকু করলে সে হয়ত একটু ভরসা পাবে,কিন্তু আমি ছোট হয়ে যাব না।

 

এবার নাশতা খেতে বসলো, আমি পরিবেশনের দায়িত্ব পেলাম। গরম ভাত, বেগুন, আলু দিয়ে ছোট মাছের ঝোল ছিলো নাশতায়। খাবার পরিবেশন করতে গেলাম, বৌ বললো বেগুনে এলার্জি, তাই বেগুন খেতে পারবে না। আমি রান্নাঘরে গিয়ে তার শাশুড়িকে বললাম,

 

: বৌ বেগুন খায় না।, এলার্জি আছে।

: না খাইলে নাই! (কন্ঠে রাগ মেশানো, যেন বৌ মস্ত অন্যায় করে ফেলেছে!)

 

আমি হতবাক হয়ে ফিরে এলাম। অগত্যা বেগুনের টুকরোগুলো বেছে আলাদা করে তারপর তাকে বাকিটুকু খেতে দিলাম। তার শাশুড়ি কিন্তু পারতো ঝটপট একটা ডিম ভেজে দিতে। নিজে না পারলেও অন্য কাওকে দিয়ে করাতে পারত।যাই হোক, বৌ এর খাওয়া যখন মাঝ পর্যায়ে, তখন এলো তার ননদ। এসে বলতে লাগলো,

 

:আজ বৌ ভাত। কই, তোমার বাবা তো এখনও কিছু পাঠালো না। বৌ ভাতের সমস্ত আয়োজনতো বৌয়ের বাড়ি থেকে দেয়া হয়, তোমার বাবা কি কিছুই জানে না? (আরও চার পাঁচটা খোটা দিল বৌয়ের বাবার বাড়ি নিয়ে)

 

মেয়েটি খাওয়া বন্ধ করে চুপচাপ চেয়ে রইলো সবার মুখের দিকে! কী অসহায় তার অবস্থা। আর তার বীরপুরুষ বর, সে তো বৌ পেয়ে মহাখুশি, তার কি এসব দিকে কোন খেয়াল আছে? এখন যে যাই বলুক, বিয়ে তো হয়েই গেছে, মেয়েটা তো আর তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। সুতরাং মজা নেয়াই এখন উত্তম!

 

কিছুক্ষণ পর বৌয়ের বাবা চাল, ডাল, মসলা, খাশি, আরও অনেক কিছু এমনকি রান্নার লাকড়ি সমেত পাঠিয়ে দিল। এসব পাবার পর তারা বৌকে কিন্তু কোন কৃতজ্ঞতা জানালো না। কোন লজ্জাও বোধ করলো না, বরং মহানন্দে সেগুলো ভোগের জন্য উঠে পরে লেগে গেলো।

 

বেলা হয়ে এলো। মধ্য দুপুরে সূর্য মাথার ওপর, বৌয়ের মাথার ওপর কটুক্তিপূর্ণ একটি নতুন বাড়ি। এবার এলেন ফুপু শাশুড়ি। তিনি এসে বললেন,

 

: বৌয়ের বাবা বোধহয় ফার্নিচার, টিভি, ফ্রীজ এসব পাঠাতে ভুলে গেছে। আজকের মধ্যেই বোধহয় পাঠাবে, তাই না?

 

বর মুচকি মুচকি হাসে। আড়ালে বোনদেরকে ডেকে শিখিয়ে দেয় কি কি বলে বৌকে খোঁচা দিতে হবে!

 

আমি তেমন কেউ না হলেও ছেলে পক্ষের আমন্ত্রিত হওয়ায় ছেলে পক্ষই ধরা চলে। এসময় লজ্জায় মাথা নত হচ্ছিল আমার। আমাদের এলাকায় এসে সে মেয়েটি জানলো, বাংলাদেশে এখনও এমন মধ্যযুগীয় বর্বর পরিবার রয়ে গেছে! অথচ এদের কি নেই? খাট, সোফা, টিভি,ফ্রীজ কোনকিছুরই অভাব নেই। তাহলে কেন নতুন বৌটাকে এভাবে বিব্রত করা? এইতো গতকাল মেয়েটা তার চিরচেনা ঘর,বাড়ি, বাবা,মা সবাইকে ছেড়ে  এসেছে। আর আজই তাকে এভাবে হেয় করা হচ্ছে!

 

এক বছর পর...

এই বৌ তার বরসহ ঢাকা শহরে থাকে। শশুড় বাড়িতে বেড়াতে আসে বছরে একবার। কারও জন্য তার কোন টান নেই। যতটুকু দায়িত্ব শুধু ততটুকুই পালন করে, ঈদে সবাইকে জামা কাপড় দেয়। এক্ষেত্রে আমরা কিন্তু বৌটাকেই দোষ দিব, পারলে ধুয়ে দিব। কিন্তু যদি তার প্রতি আচরণগুলো এমন না হতো, যদি শশুড় বাড়ির লোকেরা তার প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শন করতো, তবে বৌয়ের দিক থেকেও একটা সুন্দর বোঝাপড়ার নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হতে পারত।

 

বৌ কোন রোবট নয়, বরং আর সবার মতই রক্ত, মাংসের একটা মানুষ। তাকে তার মা বাবার কাছ থেকে এনে একটু সম্মান, একটু যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে দেখুন, ঠকবেন না। বরং বৃদ্ধ বয়সে তাকেই হয়ত কখনো লাঠি, কখনো ছাতা আবার কখনো ছায়া হিসেবে পাবেন। বৌকে আশ্রিতা না ভেবে নিজ পরিবারের সদস্য ভাবলে আপনাদের গর্বিত ছেলে পক্ষের সম্মান কমবে না, বরং পরিবারে তৈরি হবে একজন নির্ভরযোগ্য সদস্য।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ