“মামা আমায় কিছু অস্ত্র যোগাড় করে দিতে পারো? আমি পাকিস্তানি হায়েনাদের দেখিয়ে দিতে চাই সারাদেশের মতো ঢাকা শহরেও মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে ঢাকা শহরে অপারেশন চালাবো। এদেশকে আমরা সত্যি সত্যিই একদিন স্বাধীন করে ছাড়বো। নতুন আলোতে উদ্ভাসিত হবো আমরা...”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল বদির। কিন্তু এরই মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়াতে পরীক্ষাটা আর দেয়া হল না। ওদিকে বদির বন্ধুরাও সব যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। কিন্তু বাবা মায়ের কঠোর অনুশাসন ভেদ করে বদি তখনো যুদ্ধে যোগ দিতে পারছিলো না। ২৫ শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী যেভাবে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা করেছে, সেই দৃশ্যটা বদির বার বার মনে পড়ছে। দেশের এই পরিস্থিতিতে সে ঘরে বসে আছে- একথা কিছুতেই সে মানতে পারছে না।
বদিদের বাড়িতে দুটো পত্রিকা রাখা হতো; দৈনিক পাকিস্তান আর মর্নিং নিউজ।“ঢাকা শহর সম্পূর্ন শান্ত। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু গোলাগুলি চলছে।” ... দৈনিক পাকিস্তানের এই হেডিং দেখে বদির চোখদুটো স্থির হয়ে যায় । বদি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে যায় এবং সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, সে যুদ্ধে যাবে ! মায়ের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বদি কিশোরগঞ্জে তাঁর ছোটমামা এনামুল হকের কাছে চলে যায়। সেখান থেকে মামার যোগাড় করে দেয়া এস.এম.জি আর কিচু গ্রেনেড নিয়ে বদি ঢাকায় ফিরে আসে।
১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিকে বদি,রুমী,স্বপন,জুয়েল,জুয়েল,আজাদ,পুলু,আলম,চুন্নু,কাজী,সামাদ এবং আরো কয়েকজনের সমন্বয়ে গঠিত হয় একটি গেরিলা গ্রুপ; যার নাম “ক্র্যাক প্লাটুন”। ক্র্যাক প্লাটুনের প্রধান কাজ ছিল ঢাকা শহরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সেই সাথে পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দেয়া যে, ঢাকা আসলেই শান্ত নেই, এখানেই যুদ্ধ চলছে! ঢাকা শহরে ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের ভয়ে পাক সেনাদের পা রীতিমত কাঁপতে শুরু করলো। কোথা থেকে একটা গাড়িতে করে এক ঝাঁক গেরিলা এসে পাকিদের মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যায়, কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই ! প্রতিটা অপারেশনের পরেই বদি যখন বাড়ি ফেরে, তখন বদির মা ঠিক ধরে ফেলে, ছেলে নিশ্চয়ই বড় কোন অপারেশনে ছিল। মা শুধু বদিকে সাবধানে থাকতে বলেন, তাছাড়া আর কিছুই বলেন না।
বদির নিজ এলাকা ঢাকার মনিপুরী পাড়া, ফার্মেগেট, সিদ্ধিরগঞ্জ, ধানমণ্ডি, এলিফ্যান্ট রোড, গ্রীন রোড অপারেশনসহ একটার পর একটা সফল অপারেশন চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা হানাদার বাহিনীর ঘুম হারাম করে দিলো। ওদিকে পত্রিকায় এই বিচ্ছুবাহিনীর সদস্যদের ধরিয়ে দিতে দু’হাজার টাকাও ঘোষণা করা হল!
২৯ আগস্ট দুপুর ১২ টা; বদি কিছু জরুরী পরামর্শের জন্য বন্ধু ফরিদের বাসায় যায়, হঠাৎ দরজায় ঠক...ঠক...ঠক আওয়াজ। দরজা খুলতেই কিছু পাকি আর্মি ঘরে ঢুকে পরে। বদি কিছু বলবার আগেই এক পাকি আর্মি বলে উঠলো, “তুম মুক্তি হ্যায়। বহুত দিনকো বাদ হারামির বাচ্চাকো মিল গায়া।” কথাগুলো বলতে বলতে হানাদার বাহিনীর একজন বদির তলপেটে সজোরে লাথি মারলো। লাথি খেয়ে বদি কুকিয়ে উঠলো। বদির চোখ বেঁধে ওরা তাঁকে নিয়ে গেলো অজানা অন্ধকারে। সেদিনের পরে বদি আর ফিরে আসেনি। না, মনিপুরী পাড়ার বাড়িতে, না স্বাধীন বাংলার কোথাও ! হতো ত্রিশ লাখ শহিদের সাথে বদিও মিশে গেছে এই বাংলার মাটিতে...

 

বইটির পিডিএফ লিংকঃ http://www.liberationwarbangladesh.org/2015/09/blog-post_15.html

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ