একসময় ছেঁড়া খাতা আর ভাঙা কলম দিয়ে পরীক্ষা দিয়ে টেনেটুনে পাস করে ফেললাম। অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হলাম। রোল নং আগে যেখানে ছিল ৮, সেখানে হয়েছে ১০। রোল নম্বর দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। বাংলা, অঙ্ক, সমাজ বিজ্ঞানে যা-ই ছিলাম, ইংরেজিতে ছিলাম কাঁচা। ইংরেজিতে আর পাকতে পারিনি সংসারের অভাবের কারণে। এর ফলস্বরূপ রোল নম্বর ১০ হয়ে গেল। তখনকার সময়ে জিপিএ প্লাস মাইনাস ছিল না। ছিল ডিভিশন। ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন। আর এখনকার ভিশন হলো, জিপিএ প্লাস, মাইনাস, স্টার মার্ক, গোল্ডেন মার্ক-সহ আরও অনেককিছু।

তো আমার রোল নম্বর পিছিয়ে যাবার আরও অনেক কারণ ছিল। সেই কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম কারণ হলো, দারিদ্রতা। স্কুলে যাবার তেমন কোনও ভালো জামা ছিল না। মাসের পর মাস স্কুলে যেতাম খালি পায়ে। পায়ের স্যান্ডেল ছিল না। বছর শুরুতে নতুন বই তো কপালে জুটতোই না। পরীক্ষায় পাস করে উপর ক্লাসে ওঠা এমন ছাত্রদের কাছ থেকে পুরাতন বই কিনে পড়া হতো। আমার সাথের অনেকেই ভালো মাস্টারের কাছে প্রাইভেট পড়তো। বর্তমানে যাকে বলে কোচিং। এই কোচিং বানিজ্য আগে ছিল না। কোচিঙের নামও কেউ শুনেনি। স্কুলে মাস্টার কর্তৃক ব্যাচ নামের শিক্ষাব্যবস্থাও ছিল না। সেসময় শিক্ষকরা এমন ব্যবসা করতোও না। তাঁরা শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়াতো। প্রাইভেট মানে, একজন শিক্ষকের কাছে বা শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে পড়ার নাম প্রাইভেট। আবার অনেক শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে এসে পড়াতো। কিন্তু আমার কপালে প্রাইভেট পড়া জুটেনি। অর্থভাবে প্রাইভেট পড়ার ইচ্ছেও তখন ছিল না।

তবে ইংরেজিতে খুবই কাঁচা ছিলাম বলে, বাসার পাশে থাকা এক ভদ্রলোককে মাঝে মাঝে বিরক্ত করতাম। সম্মানিত ভদ্রলোক তখনকার সময়ে বিএ পাস করা লোক। পুলিশে একটা চাকরি নেওয়ার জন্য বড় ভাইয়ের কাছে আসা। আসা মানে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকতো। বড় ভাইয়ের নাম, সুভাষ। ভদ্রলোকের নাম ছিল, শ্রীবাস। আমি ভদ্রলোককে শীবাস দাদা বলেই ডাকতাম। শ্রীবাস দাদার বড়ভাই থাকতো নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন আদর্শ কটন মিল অভ্যন্তরে। সেই সুবাদে তিনিও মিল অভ্যন্তরে বড় ভাইয়ের বাসায় থাকতো। আমরাও থাকতাম আমার বড় দাদার চাকরির সুবাদে, মিলের শ্রমিক কোয়ার্টারে। শ্রীবাস দাদা আমাকে সুন্দরভাবে ইংরেজি বুঝিয়ে দিতেন। তখনকার সময়ে এভাবেই চলছিল আমার লেখাপড়া।

তারপরও সপ্তম শ্রেণির বাৎসরিক পরীক্ষায় টেনেটুনে পাস করে ফেললাম। পাস করেও শুরু হলো আরেক জ্বালা। জ্বালা মানে অষ্টম শ্রেণির বই নেই। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর, একজনের কাছে কয়েকটা ছেঁড়া-ফাঁড়া বই পেলাম। কিন্তু অষ্টম শ্রেণীর পুরো সেট পাইনি। যা পেয়েছি তার সাথে দু’একটা মেইন বই আর ক’টা নোটবই হলেই আমার হয়ে যায়। কিন্তু মা-বাবা এবং বড়দা’র কাছে বই কেনার মত টাকা হচ্ছে না, যতক্ষণ পর্যন্ত মিলের বেতন না হচ্ছে। মিলের শ্রমিকদের বেতন হবার বাকি আরও ১০দিন। সেই অপেক্ষায় থেকেই যে কয়টা বই ছিল, তা নিয়েই স্কুলে আসা-যাওয়া শুরু করলাম।

তখন বছর বছর ভর্তির ঝামেলা ছিল না। একবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হলে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এক ভর্তিতেই হয়ে যেতো। পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারলেই, একেবারে দশম শ্রেণি পর্যন্ত চলতো। এরমধ্যে দিতে হতো শুধু মাসিক বেতন বাবদ সীমিত কিছু টাকা। আর এখনকার সময়ে সরকারি বেসরকারি যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বছর বছর ভর্তি দিতে দিতে ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের নাভিশ্বাস দীর্ঘশ্বাস উঠে যায়। তবুও অভিভাবকগণ নিরুপায় হয়ে যার যার সন্তানদের লেখাপড়া করাতে বাধ্য। যাক সে কথা। নিজের কথায় আসা যাক!

নিজের কথা হলো, বড় দাদার বেতন হবে। বাবার বেতন হবে। কিছু নতুন বই কেনা হবে। যদি সম্ভব হয় তো সাথে নতুন জামা-প্যান্টও হতে পারে। এসব আশা নিয়েই স্কুলে যেতাম, আসতাম। স্কুলে গেলে সাথের বন্ধুদের নতুন বইগুলো হাত বুলিয়ে দেখতাম। পড়তাম। কোত্থেকে, কোন লাইব্রেরি থেকে কেনা হয়েছে, জিজ্ঞেস করতাম। মনে মনে বলতাম, ‘দাদার বেতন হলে আমারও নতুন বই হবে’। এভাবে নিজের মনটাকে শান্তনা দিতে দিতে একসময় মিলে শ্রমিকদের বেতন হলো। বড়দা বেতন পেলেন। বাবা বেতন পেলেন। কিন্তু আমার বই কিনে দেওয়ার কোনও নামগন্ধ নেই! মাকে বলে-কয়ে ম্যানেজ করলাম। মা বড় দাদার কাছ থেকে দশ টাকা, আর বাবার কাছ থেকে নিলেন দশ টাকা। এই বিশ টাকাই ছিল আমাদের সংসারের বাড়তি একটা খরচ। তাও আমার লেখাপড়ার জন্যই বাড়তি ঝামেলাটা। তখনকার সময়ে বিশ টাকার অনেক মূল্য! অনেক দাম! তারপরও মায়ের চেষ্টার বিনিয়ে বিশ টাকা হাতে পেলাম। বই কিনতে হবে নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে।

সেসময় প্রতি রবিবার সপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল। কিন্তু মার্কেট বন্ধ থাকতো প্রতি শুক্রবার অর্ধেক বেলা। কোনও কোনও দোকানপাট শুক্রবারে সারা দিনই বন্ধ থাকতো। বিশেষ করে লাইব্রেরিগুলো বন্ধ থাকতো। তা আর আমার জানা ছিল না। আমি বিশ টাকা নিয়ে মনের আনন্দে শুক্রবার দুপুরের পরপর নারায়ণগঞ্জ শহরের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম, বই কেনার জন্য। নারায়ণগঞ্জ শহরে কালীর বাজার ঘুরে দেখলাম, সব লাইব্রেরি বন্ধ। গেলাম ডি.আই.টি মার্কেট। সেখানেও বইয়ের দোকান বন্ধ। গেলাম টানবাজার। সেখানেও কোনও লাইব্রেরি খোলা পেলাম না। পড়লাম বিপাকে। নিজেই নিজেকে বললাম, ‘এতো কষ্ট করে প্রায় সাড়ে তিন মাইল পথ হেঁটে শহরে এসেও খালি হাতে আমাকে বাসায় ফিরতে হচ্ছে! আবার হয়তো আমাকে আগামীকাল আসতে হচ্ছে।’ এই বলে নিজের মনটাকে শান্তনা দিয়ে খালি খালি হাঁটতে লাগলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে গিয়ে দেখি লোকে লোকারণ্য। সময়টা তখন মনে হয় ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় ছিল। তখন ছিল বাংলা চলচ্চিত্রের জয় জয়কার সময়। লোকের ভীড় সিনেমা হলের সামনে। সিনেমা হলের নাম, আশা আর মাশার। একসাথে দুটি সিনেমা হল। উপরে মাশার। নিচে আশা। আশা সিনেমা হলে চলছে, তখনকার সময়ে অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘দি রেইন’ ছায়াছবি। যেই ছায়াছবির সংলাপ রেডিওতে দিনরাত শুনতাম, সেই ছায়াছবি এখানে চলছে? ছায়াছবির পোস্টার দেখে অবাক হয়ে গেলাম। লোভেও পড়ে গেলাম। বই কেনার কথা মুহূর্তে ভুলে গেলাম। সিনেমা হলের ভেতরে পেলাম। কিন্তু টিকেট কাউন্টারের সামনে আর এগুতে পারলাম না। মনটা আনচান আনচান শুরু করে দিলো।

এই জীবনে আর কখনো একা একা সিনেমা হলে ছবি দেখিনি। অনেক আগে নিজেদের বাড়ি থাকতে আমার বড় মামার সহায়তায় মায়ের সাথে বসে সিনেমা হলে ছায়াছবি দেখেছিলাম। সেই দেখা ছিল নোয়াখালীর চৌমুহনী টাউনে দর্পণ সিনেমা হলে। ছায়াছবির নাম ছিল, ‘মানুষের মন’। আর এখন আমি এক সিনেমা হলের সামনে দাঁড়ানো। সাথে আছে বিশ টাকা। তাও বই কেনার টাকা। তা থাকুক! বই যখন পাইনি, তখন সিনেমা দেখেই বাসায় যাবো। এমন চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়েই ব্ল্যাকারদের কাছ থেকে সেকেন্ড ক্লাসের একটা টিকেট কিনে ফেললাম। টিকেটের দাম মাত্র পাঁচ টাকা। যদি টিকেট কাউন্টার থেকে কিনতে পারতাম, তাহলে আড়াই টাকা দিয়েই কিনতে পারতাম। কিন্তু অনেক লোকের সমাগমের কারণে তা আর হয়নি। শেষতক আড়াই টাকার টিকেট ব্ল্যাকে পাঁচ টাকা দিয়ে কিনতে হলো। কিনলামও। বইয়ের কথা ভুলে সিনেমা দেখলাম। বিরতির সময় সিনেমা হল থেকে বের হয়ে তিন চার টাকা খরচও করে ফেললাম। সিনেমা দেখে বাসায় ফিরলাম রাত ৮টায়।

এদিকে আমার ফিরতে দেরি হওয়ায় মা খুব টেনশন করছে। এমনকি কান্নাকাটিও হচ্ছে। আমাকে খোঁজার জন্য বড় দাদা নারায়ণগঞ্জ যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন সময় আমি বান্দা ভয়ে ভয়ে বাসার সামনে হাজির হলাম। সাথে বই নেই। অথচ টাকা আছে মাত্র দশ টাকা। মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় গিয়েছিলি?’ গিয়েছিলাম তো বই কেনার জন্যই। মায়ের প্রশ্ন,‘বই কোথায়?’ আজ তো শুক্রবার, তাই বইয়ের দোকান বন্ধ। কালকে আবার যেতে হবে, বললাম মাকে। ‘টাকা কোথায়?’ আমি চুপ করে আছি। বড় দাদা বুঝতে পেরেছে, ঘটনাটা কী ঘটেছে। ওমনি আমার পকেট তল্লাশি শুরু হয়ে গেল। পকেটে পেলো দশ টাকা। আনা হলো মোটা রশি, আর পেয়ারা গাছের শুকনো ডালা। এরপর তো শুরু হয়ে গেল রিমান্ড। যেই রিমান্ড আমাকে দেওয়া হয়েছিল, সেই কঠিন রিমান্ড মনে হয় পুলিশেরা গুরুতর অপরাধীকেও দেয় না। এরপরও ছিল সারা রাতের জন্য শাস্তি। আমার সজার সাথে আমার অভাগী মা-ও সারারাত জেগে সাজা ভোগ করেছিল। সারারাতের জন্য যেই শাস্তি আমাকে দেওয়া হয়েছিল, সেটা আর লেখায় প্রকাশ করলাম না। প্রিয় পাঠকবৃন্দ এমনিতেই বুঝে নিতে পারছে বলে মনে হয়।

সেই সাজা ভোগ করে যেমন শিক্ষা পেয়েছি, তারচেয়ে বেশি শিক্ষা জীবনে ধারণ করেছি। সেই শিক্ষা থেকে আর কখনো পড়ালেখার জন্য বড় দাদার টাকা নেইনি। বাবার টাকা দিয়ে সিনেমা দেখিনি। এমনকি মায়ের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েও কখনো বাজে কোন খরচ করিনি। যা করেছি, নিজের কামাই রোজগারের টাকা দিয়েই করেছি। লেখাপড়া করেছি নিজে কাজ করে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বিকেলের অবশিষ্ট সময়টুকু বাদাম বিক্রি করে শেষ করেছি। রবিবার স্কুল বন্ধের দিনে আদর্শ কটন মিলে রাজ যোগালি কাজ করেছি। দৈনিক মজুরি পেতাম মাত্র ৮টাকা। এছাড়াও যখন যা কাজ পেতাম, তা-ই করতাম। সপ্তাহে মজুরি যা পেয়েছি তা দিয়ে বই খাতা কলম-সহ স্কুলের মাসিক বেতনের খরচ জুগিয়েছি। তারপরও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের জাঁতায় বেশি অগ্রসর হতে পারিনি। এই অনম্য কপালের জন্য যতটুকু বরাদ্দ ছিল, ঠিক ততটুকুই করতে পেরেছি। তবে জীবন চলার মাঝে অতিরিক্ত লোভ করিনি। কোনও কাজে হতাশ না হয়ে, সফল হবার আশাই করেছি।

এভাবে চলতে চলতে আজ প্রায় বুড়ো হয়ে গেছি। মা, বাবা, বড় দাদা, বড় বোনদের স্বর্গে পাঠিয়েছি। আজ আমার গুরুজন বলতে দুই বড় বোন ছাড়া কেউ নেই। তাও তাঁরা পরের ঘরে। কিন্তু সেসব কথা আর স্মৃতি এখনো মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ