সুনীল আনন্দের হাসি চেপে রাখতে পারল না প্রদীপের নতুন বোর্ডিং এ উঠার বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে দেখে।প্রদীপকে ফেরার পথে এগিয়ে দিচ্ছিল সুনীল।প্রদীপের মনের কোনে পলকে সুনীল স্থায়ী আসন করে নিল।প্রদীপের জিজ্ঞাসু মনের অসংখ্য জিজ্ঞাসার প্রতিত্তোরে সুনীল বলছিল যে ছাত্র রাজনীতির হাতেখড়ি নিয়েছিল বিশিষ্ট কবি,ছোট গল্পকার কামরুজ্জামান ভাইয়ের নিকট থেকে।বেশ রসবোধ সম্পন্ন একজন মানুষ কামরুজ্জামান ভাই।উনার এক কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সুনীলকে দেখতে পেয়ে সুনীলকে কোন এক অদৃশ্য কারনে কাছে টেনে নেন।সেই টেনে নেয়া প্রসারিত হয়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম পর্যন্ত বিস্তৃত হল।তন্মধ্যে প্রদীপ তার বাসার নিকটে চলে আসল।সুনীল বন্ধুর সাথে করমর্দন করে চলে গেল ।প্রদীপ বাসায় ঢুকে কিছু ময়লা কাপড় চোপড় ধৌতক্রিয়া ও স্নান শেষ করে  দুপুরে ধোয়ায় কুন্ডলী উঠা গরম খাবার খেতে বসল।মাসি,মাসি ডেকে যাকে মধুরতায় অস্থির করে তুলত,উনাকে বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা বলতে বেশ ইতস্তত হয়ে পড়ল প্রদীপ।সেখানে উপ ভাড়াটিয়া হয়ে থাকা প্রদীপের দরিদ্র মাসি,অসুস্থ মেশু,ছোট দু-ভাইয়ের সাথে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল এরই মধ্যে।বিদায় বলতে গিয়ে সে অজান্তেই বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ল।বিষাদ কাটাতে মুঠোফোনে বাপি,মায়ের সাথে কথা বলে হালকা হয়ে নিল ক্ষানিকটা।ততক্ষনে আবছা অন্ধকারে চারপাশ ঢেকে গিয়ে রাত নেমে আসল।মাসিকে বাসা ছাড়ার কথা বলার পর মাসি নির্বাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন প্রদীপের দিকে।এ যেন নিজ গর্ভজাত পুত্রের বিদায় হতে চলল।আড়ালে দাঁড়িয়ে মলিন শাড়ির আচলে চোখের কোনে জমা হওয়া স্বচ্ছ জলও মুছে নিচ্ছিলেন মাসি।প্রদীপ নিজ বাড়ি থেকে ফেরার সময় বাপি,মা যেভাবে কান্না শুরু করে দিয়েছিলেন,সেভাবেই যেন এবারেও বিষয়টি এগিয়েছিল।রক্ত সম্পর্ক ছাড়াও যে এমন গভীর,নিশ্চিদ্র সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে কয়েক মাসের পথচলায়,সেটা নতুন করেই সে আবিষ্কার করল।পরদিন ঘুম থেকে উঠে কাপড় চোপড়,বইপত্র,কিছু আসবাবপত্র ভ্যানে তোলার জন্য জড়ো করে রেখেছিল।সুনীলের সাথে কথা মাফিক সময় বেধে প্রস্তুতি নিয়ে রাখল।ভালবাসার যে বাধন বেধেছিল প্রদীপ,সেটি ডিঙিয়ে আসতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তারও।নীলয় নূর মার্কেটের দোতালার নির্ধারিত কক্ষটি আগেই পরিষ্কার করে রেখেছিল।প্রদীপ,সুনীল দুজনেই মিলেমিশে সকল বইপত্র,কাপড়-চোপড়,টেবিল,চেয়ার কক্ষে এনে রাখল।সুনীল তার বাবা,মা,ভাই-বোনদের নিয়ে অনধিক ২ কিলোমিটার দূরে একটি ফ্ল্যাট বাসাতেই থাকত।তবে তার সূর্যালোকে ঘুম ভাঙার পরই ওই মার্কেটে যেতে মন উচাটন হয়ে থাকত।নূর মার্কেটের দোতালা আর তিন তালা মিলিয়ে প্রায় ২০টি কক্ষ রয়েছে।বিভিন্ন শ্রেণী,পেশা,ধর্মের মানুষ মিলেমিশেই থাকত সেখানে।তবে মাঝেমধ্যে চায়ের কাপে ঝড় বহে যেত বিভিন্ন চলমান বিষয়ে কথার রেশ ধরে।নীলয় রান্না-বান্না করতে জানত বিধায় ওখানেই রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিল।প্রদীপ চাইলে তার সাথেই ব্যবস্থা করে নিতে পারত তবে কিছুটা নিতান্ত ভদ্রতায় অন্য ব্যবস্থা করে রেখেছিল।মার্কেটের পাশেই এক দাদা বাসায় রান্না-বান্না করে স্থানীয় দোকান কর্মচারী,ছাত্র,চাকুরিজীবিদের খাওয়াতেন দুপুরে ও রাতে।প্রদীপ তার বোর্ডিং এর অন্য কয়েকজনের মত করে সেই ব্যবস্থাই করে নিয়েছিল।রাতে প্রদীপ বইপত্র ঘুছিয়ে পড়তে বসল।সুনীল,নীলয় কেউ আর তখন তার কক্ষে ছিল না।হঠাৎ করেই সেখানে এসে উপস্থিত হল তার সাথেরই সম্মান স্নাতক (১ম বছর) কোর্সে ভর্তি হওয়া এক সহপাঠী নূর।জানা গেল সিড়ি ভেঙে দোতালায় উঠে ডান মোড়ে ৩য় কক্ষটিই তার।আরো বেশ কয়েকজন নতুন মানুষকে (প্রদীপ) দেখতে কক্ষে ফাকে ফাকে ভীড় করছিল।প্রদীপের তখন মনে হচ্ছিল ওরা যেন নববধূ ভেবে দেখতে আসছে!খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাতে যখন প্রদীপ ঘুমাতে যাবে,নীলয়,সুনীল দুজনেই এসে তার খোজ নিচ্ছিল।রাত ১০ টা বাজতে না বাজতেই সেই দোতালায় হুলস্থুল শুরু হয়ে গেল।এ যেন বিভিন্ন বয়সের মানুষের এক মিলনমেলা।সারাদিনের বিভিন্ন ঘটনা একে একে সবাই বাক্যবিনিময়ের মধ্য দিয়ে জানান দিচ্ছিল।প্রদীপকে সবাই পেয়ে যেন আরো মজে মত্ত হতে লাগল।সুনীল মাঝে মাঝেই সেখানে থেকে যেত।তার দ্বিতীয় নিবাস যেন ওই মার্কেটেই।সে ছিল সবার মধ্যমণি।সুনীলকে সবাই সমীহও করত।জ্ঞান-বিজ্ঞান,ধর্ম,সংস্কৃতি,রাজনীতি,দেশ-বিদেশের সমাচার উপস্থাপনে ও অকাট্য যুক্তি দাড় করাতে সে ছিল সিদ্ধহস্ত।তাই মজার ছলে সবাই উৎসাহ,উদ্দীপনায় সেই নির্মল আনন্দে ভাগীদার হত।প্রদীপ বেচারা তাদের হাস্যরসের আলাপচারিতায় মানিয়ে নিতে পারছিল না।বইপড়া তবে বুঝি এবার লাটে গেল! সিদ্ধান্ত হল প্রদীপের আগমন উপলক্ষ্যে সে রাতেই খাওয়া-দাওয়ার একটা ঝটিকা আয়োজন হবে।সচরাচর যদিও এমন আয়োজনে সবাই জনে জনে চাদা দিয়ে ব্যবস্থা করে কিন্তু সুনীল সেদিন তার পকেট থেকে চকচকে এক হাজার টাকা বের করে দিয়ে বলল সে নিজেই সবাইকে খাওয়াতে চায়।প্রদীপকে পেয়ে যেন সে স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করল।তাইতো টিউশনের মাসিক সম্মানীর পুরোটাই সে নিমিষেই খরচাতে সানন্দে দিয়ে দিল।খাওয়া-দাওয়ার পর রাতভর চলতে থাকা গল্প,গান,কৌতুক,আড্ডার মধ্যেই প্রদীপের জোড়া চোখ কখন যে নিদ্রা দেবীর আশ্রয়ে নিদ্রাতে পাড়ি জমাল তার ইয়ত্তা ছিল না।

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ