আমি সবসময় ভাবি আমাদের মেয়েদের আসলে কতবার বিদায় হয়। কিংবা আমরা বাবা- মায়ের কাছে কতোবার ফিরে আসি। মনে হয় যতবার শশুরবাডি থেকে বাবার বাড়িতে আসা ততোবারই ফিরে আসা। আবার যতোবার চলে যাওয়া ততোবারই যেন কেঁদেকেঁটে বিদায় হওয়া। আর এতোগুলো বছর অন্যের ঘরে কাটে কিছুটা অজানায়, কিছুটা প্রেমে, কিছুটা সন্তানের টানে আর বাকিটা অভ্যাসে। মন কিন্তু সেই পুরোনো খেলাঘরেই পরে থাকে; বারবার ফিরে আসবার জন্য আকুপাকু করে তার চারপাশে।

আমার বড় বোন বয়সে আমার থেকে পনের/ ষোল বছরের বড়। বড় হলেও আমরা বন্ধুর মতোই। তার ছেলেমেয়েরা প্রায় আমার বয়সী। বুবুর বিয়ে হয় অল্প বয়সেই, পনের- ষোলোতে। সে সময় বোধহয় এটাই রীতি ছিলো। ভালো ছেলে দেখে টুপ করে বিয়ে দিতে পারলেই স্বস্তি। চাকুরীর সুবাদে অধিকাংশ সময়ই বুবু- ভাইয়া বাইরেই থেকেছেন এবং বহুবছর ধরে সিলেটেই আছেন। সেখানে ছেলেমেয়ের বিয়ে, বাড়ি সব করে ফেলেছেন।

অল্প বয়সে সংসার, বাচ্চা সবমিলিয়ে বুবু খুব একটা কুড়িগ্রামে আসেননি। মোটে সাত- আটবার এসেছেন।এমনকি  ভাইয়া অবসরে যাবার পরও তাদের আসবার কোন নামগন্ধ নেই। আমরা ধরেই নিয়েছি ওনারা ওখানেই থেকে যাবেন। বুবু একেবারেই আসবে এটা আমরা কেউই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না অন্যকারণেও। তাদের বড় মেয়ের খুবই মিষ্টি এক ছেলে আছে। তাকে ছেড়ে আসা সত্যিই কষ্টকর!

তবুও হঠাৎই ঘোষণা দিলেন, একেবারেই চলে আসবেন। ফিরে আসবার এমন টান সোচচার হবার অন্য কারন হলো করোনায় তারা অনেক মানুষকে আত্মীয়- স্বজন ছাড়া, জানাজা ছাড়া কবরে শায়িত হতে দেখেছেন। তাই তারা তাদের কবর দেখতে চান নিজের এলাকায়, নিজের ভিটেতে। মাটিটুকু যেন নিজের লোকরাই দেয়।

সব মায়া ত্যাগ করে লকডাউন ছাড়ার পরদিনই তারা সত্যি সত্যি রওয়ানা দিলেন। আমাদের তো রীতিমতো ঈদ আনন্দ। বিশেষ করে মামা তার অতি প্রিয় ভাগনীকে কাছে পাচ্ছেন বলে একটু বেশিই এক্সাইটেড। আমি সকল অসুস্থতা ভুলে সকাল থেকে নানাপদ রেঁধে দৌড় দিলাম ষ্ট্যান্ডে। মোটামুটি এগারোটা বস্তা/ লাগেজসহ তাদের নিয়ে বাসায় হাজির হলাম। ওল্ড জেনারেশান তখন দোতলায় অপেক্ষ্যমান। এতটুকু সময়ই যেন তাদের কাছে অনন্তকাল। করোনাকালে যে গোসল সেরেই মিলনপর্ব শুরু করতে হবে।

বুবুর একঘন্টার গোসল দুমিনিটেই শেষ। কদিন আগে মা কপাল/ মাথা ফাটিয়ে একাকার করে ফেলেছেন। এখনো চোখের নিচে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। তা দেখেই সে মাকে জডিয়ে ধরে ভেউভেউ করে কেঁদে দিলো। মাও কেঁদেকেঁদে আপাদমস্তক হাতবুলিয়ে দিচ্ছেন আর চুমু দিচ্ছেন। এতো বেশী চুমু বিনিময় চলছিলো যে করোনারানী তখন বিদায় নিতে বাধ্য। মা- মেয়ের ভালোবাসাবাসীর দৃশ্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর! বাকিরা যে অপেক্ষমাণ এটি যেনো কারোরই খেয়াল নেই।

খাবার টেবিলে তাদের পছন্দের খাবার এবং মা বুবুর প্রত্যেকটা পছন্দ মনে রেখেছেন এটি বেশ ভালো লাগলো। এ সময় মাকে যতই অস্থির হতে নিষেধ করা হচ্ছে তিনি তার চেয়ে বেশিই হচ্ছেন। বেশ সময় ধরে চললো এ খাদ্য অত্যাচার। আমাদের গেটপাশ না দেয়া ভদ্রলোক বুডো বয়সে শাশুড়ী আদরে আপ্লুত। খাওয়া শেষে ঢেঁকুর তুলে চাঁদার টাকা না দিয়েই ঘুমোতে গেলেন।

বুবুর জামাই ভদ্রলোক অত্যন্ত অমায়িক মানুষ, পিডিবির কর্মকর্তা ছিলেন। কথা কমই বলেন বলেই হয়তো মুচকি হাসিতে কথার জবাব দেন। শান্তি প্রিয় মানুষ ঘুমোতেই বেশি পছন্দ করেন। তা দেখেই এতোদিনে খুঁজে পেলাম কারেন্ট গেলে কেন দীর্ঘসময় আর আসে না। ঘুমারু লোকজন লাইন অফ করে ঘুমিয়ে যায় আর বোধহয় খেয়ালই থাকেনা যে লাইনটা দিতে হবে।

এতোবছর বাদে তিনি নিজ বাড়িতে ফিরেছেন।আমাদের এক্ট্রা ইনকাম ও আনন্দ বাড়াতে তার গৃহপ্রবেশে ফিতে কাটা বাবদ চাঁদার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিপটে ইন্জিনিয়ার কটা টাকা দেবার জন্য পকেটে হাত দিতেই টের পেলেন তার চশমা নেই। গাড়িতে ফেলে এসেছেন। এরপর আমাদের  টাকা বাকি রেখেই দৌড় লাগালেন। অবশেষে চশমা পেয়েছেন কিন্তু আমাদের চাঁদা যেটা বাকি রাখলেন! আর কোনদিন তা দেবেন বলে মনে হয় না।

মা- মেয়ের গল্প চলছে; সবাই খুব মজা পাচ্ছে বলেই মনে হলো। এরমধ্যে খালাম্মাও চলে এলেন। সবার উপস্থিতিতে মোটামুটি একটা গল্প- আসরে এসির বাতাসও যেন গরম হয়ে উঠলো।

আমার কাছে আজ একটা বিষয় পরিষ্কার হলো। একসাথে পুরুষ এবং মহিলা দুই ধরনের দায়িত্ব পালন করতে করতে আমি অনেকটা রোবটিক হয়ে গেছি। এসব গল্প- আসর আমায় কখনোই কেন যেন টানে না। কোথাও বসলে একটার পর একটা ফোন আসে তখন মনে হয় অযথা গল্প- আসরে না থেকে বরং কাজ করি। মেয়েলি যে ভাবটা সেটা বুবুর মাঝেই পুরোপুরি আর তাই হয়তোবা সবাই তাকেই বেশি পছন্দ করে। বিশেষ করে মাকে এতো খুশি কখনোই দেখা যায়নি। তিনি নিজেকে মেয়ের কাছে যেন খুলে বসেছেন। আমার সাথে এতটা ফ্রি কিংবা স্বাধীনভাবে কখনোই কথা বলেন না। আমি অনেকখানি স্বস্তিবোধ করলাম।

বোঝা গেলো মা আমার কাছে অনেকটা বাধ্য হয়ে থাকেন। আমি মায়ের প্রয়োজন আর বুবু তার মনের কাছাকাছি যেটাকে আমরা ভালোবাসা বলি। বহুবছর বুবু দুরে থেকেও মায়ের অনেক কাছে ছিলো আর আমি কাছে থেকেও মায়ের খুব কাছাকাছি ছিলাম না। কারণ ব্যস্ততার কারনে আমি কখনোই মাকে তার প্রয়োজন মাফিক সময় দিতে পারিনি। আমার মনেই নেই মা বা আমি আমরা কেউ কাউকে কখন এভাবে জডিয়ে চুমু দিয়েছি বা কেঁদেছি।

ভালোবাসাবাসিতে শারিরীক দুরত্ব বোধহয় কোন বিষয় নয়। ভালোবাসা/ ভাললাগাটা মনের ব্যপার। একবার ভালোবাসা হলে মন তার কাছেই পড়ে থাকে। যতদিন বাদেই ফিরুক না কেন তা যেন নতুনই থাকে।

করোনা এসে আমাদের অনেক কিছু শেখালো, দেখালো।সন্তান হয়তো বিদেশে এদিকে বাবা-মা মরে গেছে। তারা কোনদিনই জানবেই না বাবা- মায়ের বা কাছের কারো কবর কোথায় হয়েছিলো। আবার যাদের খুব কাছের বলে জানতাম তারা এ সময় বদলে গেলো। আবার যার সাথে কোন আত্নীয়তা নেই তাঁরাই বিপদে পাশে। বিশেষ করে মৃত্যুর পর মাটি দেবার জন্য যখন নিজের মানুষ খুঁজেই পাওয়া যায় না, তখন অনাত্নীয়রাই কাছের হয়ে কাঁধ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

ভাবছি ব্যস্ততা কমিয়ে দেব। এখন থেকে সবার সাথে আমিও অনেক গল্প করবো, শুনবো। কারন আমাদের কিছু সময় নিজের মানুষদের জন্য রাখা, দেয়া উচিত। মনকে টেনে নিয়ে আসা উচিত প্রিয় মানুষদের জন্য। তাদের পাশে থাকবার ব্যাকুলতা তৈরি করতে হবে কারন এটা খারাপ কিছু না।

ছবি- নেট থেকে।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ