ছোটবেলার স্মৃতি, তাও আবার রোজার স্মৃতি, লিখতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। তবুও যদি না লিখি, জানবে কেমন করে সবাই? ছোটবেলার স্মৃতি জানানোতে যে ভালোলাগা কাজ করে, জানাতে গিয়ে মাঝে মাঝেই আবেগে ঝাপসা হয়ে যায় চোখ, সে স্মৃতি কেমন করে না লিখে থাকি? জানবো জানাবো, ভাগ নেবো আবেগের, তবেই না আমাদের রুদ্ধ আবেগ পেয়ে যাবে প্রজাপতির মতো রঙ বেরঙের পাখা। ভেসে যাবো আমরা রংধনুময় আকাশে। আসুন কিছু সময় ভেসে থাকি.......

আব্বার চাকরিসূত্রে আমাদের ছোটবেলাটা কেটেছে দেশের নানান জেলায়। বছরে একবার কি দু'বার ছুটিতে গাঁয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া হতো। আমার আগের কোনও এক পোস্টে বোধহয় তার কিছুটা আভাসও দিয়েছি। যদি সেই বেড়াতে যাওয়াগুলো হতো রমজান মাসে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তার আনন্দ কয়েকগুণ বেড়ে যেতো। কারণ ঈদ। একই গাঁয়ের এ-বাড়ি আর ও-বাড়ি নানী আর দাদীর বাড়ি। বেড়ানো তো নয়, যেন আনন্দের সাগরে নিরন্তর ভেসে চলা! তেমনই এক রমজানে আমার প্রথম রোজা রাখা। নানীর বাড়িতে আমরা দুইবোনই ছিলাম দুইমাত্র নাতনী তখন, কিন্তু দাদীর বাড়িতে? ওখানে আমার চাচাতো ফুপাতো ভাই-বোনের সংখ্যা ছিল বেশ কয়েকজন আর তারা প্রায় বেশির ভাগই আমার সমবয়সী (এখানে আমার আব্বার চাচাতো ভাইদের ছেলেমেয়েরাও অন্তর্ভুক্ত)।
আমরা যেহেতু বাইরে থেকে আসতাম, একটু আলাদা কদর ছিল সবার কাছেই। মোটকথা ওই দুরন্ত কচিকাঁচাদের দলটির অলিখিত দলনেতা হিসেবে স্বীকৃতিও পেয়ে গেছিলাম কিভাবে যেন। আর আমি তো ছিলাম দুষ্টুর শিরোমণি! যা বলতাম, ওরা বিনাবাক্যব্যয়ে মেনে নিতো তা। একসাথে চষে ফেলতাম মাঠ-ঘাট-বিল। রোজাও ধরেছিলাম সবাই একসাথে। দাদীর বিছানায় গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা আমরা ভোররাতে উঠে পড়তাম রোজই। ভোররাতে লণ্ঠনের আলোয় ঢুলুঢুলু চোখে চুলার পাশে বসে দাদীসহ মা চাচীদের কর্মতৎপরতা দেখতে দেখতে একসময় রান্না শেষ হতো। বড়দের সাথে আমরাও খেয়ে টেয়ে শুয়ে পড়তাম। রোজা করার জন্য নয়, খেতে হবে তাই খাওয়া। কিন্তু আবার ঘুম আসতে না আসতেই ফুটে উঠতো ভোরের আলো, শুরু হয়ে যেতো আমাদের টইটই। বাড়ির পিছনের পুকুরে বিলে সাঁতরে, এ-পাড়া ও-পাড়া বেড়িয়ে একসময় ক্লান্ত হলে বাড়ি ফিরে দাদীর পিছে ঘুরঘুর। দাদীও যেন তৈরিই থাকতেন। সেই ভোররাতের ভাত লবণ, সরষের তেল, আচার আর পোড়ানো শুকনো মরিচে মেখে খেতে দিতেন আমাদের। আমরাও চেটেপুটে খেয়ে নিতাম সেই ভীষণ স্বাদের মাখানো ভাত, যার সুবাস যেন আজও লেগে আছে হাতে। কিন্তু আমরা কি শুধু খেয়েই যাবো? ভোররাতে তো সেহরি খায়-ই, রোজা রাখলে দোষ কী! সবাই মিলে ঠিক করলাম, কাল থেকে আমরাও রোজা করবো। ব্যস, সবাই আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ! ভোররাতে খেয়েটেয়ে বড়দেরকে জানিয়েও দিলাম, আজ আমরা সবাই রোজা।

না না, ভাববেন না, প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা ধরে রাখতে পারিনি শেষ পর্যন্ত। সেদিনই আমাদেরকে পাঠানো হয়েছিল আমাদের জমিতে পাটশাক তুলতে। অতদূরের জমিতে গিয়ে পাটশাক তুলে আনা কি মুখের কথা? মোটেও না। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ। ফেরার পথে গাঁয়ের স্কুলের পাশে যে ফাঁকু মিয়া দাদার বাড়ি, তার সামনে টিউবওয়েলটি থেকে কত মানুষ পানি নিয়ে যাচ্ছে! প্রতিচাপেই কী স্বচ্ছ, কী হিমশীতল পানি বেরিয়ে আসছে বিপুল বেগে! শুকিয়ে কাঠ আমাদের গলা আর জিহ্বা সেই হিমশীতল পানির স্পর্শ পেতে যে ভীষনই মরিয়া হয়ে উঠলো! আমাদের তৃষ্ণার্ত চোখ যেন সরতেই চাইছিল না ওই টিউবওয়েলটি থেকে। গুটিগুটি পায়ে আমরা এগিয়ে গেলাম টিউবওয়েলের দিকে। একে একে খেয়ে নিলাম সেই স্বচ্ছ শীতল পানি! কিন্তু...... এরমাঝেও এক আশ্চর্য বিশ্বাসঘাতকের সন্ধান পেলাম আমরা। সে আর কেউ নয়, আমাদের সঙ্গী, আমাদেরই চাচাতো বোন রেবেকা। সে পাপের ভয়ে কুঁকড়ে গিয়ে অবস্থান করছে কিছুটা তফাতে। অন্যদের অভয়বাণী যেন তার কানেই পৌঁছাচ্ছে না! রোজা সে ভাঙবে না। ভাঙলোই না শেষ পর্যন্ত। দলের মধ্যে এমন এক বিশ্বাসঘাতকের অস্তিত্ব টের পেয়ে যারপরনাই শিহরিত হলাম। মনের গভীরে কোথাও যেন খচখচ করতে লাগলো। সত্যিই তো, সেহরি খেয়ে দাদীর কাছে শুনে শুনে রোজার নিয়ত তো আমরা সবাই করেছিলাম, ভেঙে দিয়ে কঠিন পাপ করে ফেললাম না তো! দুই একজন এই ভাবনায় একটু আধটু কান্নাকাটিও শুরু করে দিলো। দাদী জানলে কত মন খারাপ করবে! না না, বাড়ি ফিরে দাদীর মুখোমুখি হওয়ার আগেই আম্মার কাছে খোলাসা করে নিতে হবে ব্যাপারখানা!
আসরের নামাজ পড়ে আম্মা জায়নামাজে। আমরা সবাই চুপিচুপি সেখানে। নিজেদের অপরাধের কথাটা ভয়ে ভয়ে বলেও ফেললাম। কিছুক্ষণ গম্ভীর থেকে হাসতে হাসতে আম্মা বললেন, কিছু হবে না, ছোটদের কোনও পাপ নেই।
কিন্তু কেন?
ছোটরা তো আল্লাহর ফেরেশতা, তাই। শুকনো মুখে হাসি ফুটলো আমাদের। বুকের ওপর থেকে নেমে গেল যেন বিশাল এক পাথর। হুকুম এল কিছু খেয়ে নেয়ার। দোকান থেকে চানাচুর আর টিকটিকির ডিম কিনে খেয়েও নিলাম। কিন্তু ঘটনা তো এখানেই শেষ নয়! বড়রা সবাই জেনে গেল সেই খবর। ইফতারিতে বসে সবাই বললো, কী, আজ তাহলে তিনটা রোজা হল তোদের, তাই না? কী লজ্জা... কী লজ্জা!!

এখানেই কিন্তু গল্পের শেষ নয়। চাঁদ দেখার তেলেসমাতি তো এখনও বলিইনি। ওটা না বললে তো লেখাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে!

২৯ রোজা। আমাদের ছোটদের মাঝে বিপুল উদ্দীপনা। আজ যদি শেষ রোজা হয়, কালই ঈদ। সেই মোতাবেক মেহেদী গাছ ন্যাড়া করে হাতও রাঙানো শেষ আমাদের। অকারণেই হেসে হেসে উঠি। বড়দের মাঝেও চাপা উত্তেজনা। টিভির টিকিটিও তখন ছিল না। রেডিও যদিও ছিল, তবু ইফতারির পর দল বেঁধে আমবাগানের শেষ মাথায় যে মাঠ, ওখানে গিয়ে চাঁদ দেখার চেষ্টা করাটাই অধিক লাভজনক বিবেচনা করতো সবাই। সেই মোতাবেক পিঁপড়ের সারির মতো সবাই হাজির ওই মাঠে। পশ্চিম আকাশের লালিমা কিছুটা যেন আছে তখনও! আকাশে চোখ পেতে সবাই। একটু হুড়োহুড়িও হয়। সামনের জনগণের পিছনে যারা, তাদের দেখতে সুবিধে হচ্ছে না ঠিক। তবুও হাসাহাসি। তবু্ও জায়গা ছেড়ে দেয়া একে অপরের জন্যে। এরমাঝেই আঁধার হয়ে আসা আকাশে কখন যেন একফালি চাঁদ উঁকি দিয়েছে! কেউ কেউ দেখেছে। যারা সেই সৌভাগ্যের অধিকারী তাদের মধ্যে আমার ছোট মামা একজন। সমানে লাফাচ্ছে সে, ওই যে..... ওই যে! আমরা ছোটরাও তার দেখাদেখি ওই যে... ওই যে রব! সেজোমামাও চিৎকার দিয়ে উঠলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এতক্ষণে আমিও দেখেছি! ওই তো, ওই..... !
ইমাম সাহেব মসজিদে ঘোষণা দেয়ার জন্য মসজিদের পথ ধরলেন। ধীরে ধীরে পাতলা হল ভীড়। হঠাৎ সেজোমামা ছোটমামার কানের কাছে মুখ নিয়ে চুপিচুপি বললেন, চাঁদটা ঠিক কোথায় রে সালেহ্, আমাকে একটু দেখা তো!
কিন্তু.... কিন্তু..... আমরা যে স্পষ্ট দেখলাম, সেজোমামাকেও লাফাতে, ওই তো চাঁদ, ওই যে....!
তবে কি.....????

0 Shares

২৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ