করোনা নিয়ে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব, বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণও এর বাইরে নন। ভয়ংকর এক সময় অতিক্রান্ত করছি আমরা। রাস্তাঘাটে ভিড় নেই, অফিস আদালত থমথমে। হাসপাতালগুলোতে নেমে এসেছে গগনবিদারী কান্নার রোল। আর এসবের সুযোগে মুনাফালোভী কিছু মানুষ উঠেপড়ে লেগেছে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। অথচ হওয়া উচিত ছিলো উল্টোটা।

হুটকরে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি জনজীবনে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে। অনৈতিকভাবে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার জন্য পণ্যসামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। যদিও সরকারের তরফ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ভোক্তা অধীকার দপ্তর বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে তবে তা হাতে গোনা কয়েকটি জায়গায়। অনেকেরই জেল জরিমানা হয়েছে। তবে সব বাজার একসাথে মনিটর করার মত লোকবল আমাদের নেই। যার কারনে সবসময় এসব অভিযান সফলতা বয়ে আনছেনা।

আমাদের পর্যাপ্ত পণ্য মজুদ রয়েছে। আর এ মজুদ থাকে একটি পরিবারে মাসিক কতটুকু পরিমান পণ্য লাগতে পারে সে বিবেচনায়। তাই অনেকেই আমরা পণ্যসামগ্রী কেনার জন্য কোন বিধিনিষেধ না মেনেই ক্রয় করছি। আতঙ্কিত আর ভীতসন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ না বুঝেই প্রয়োজনের অধীক পন্য কিনছেন বলেই বাজারে কিছুটা সংকট তৈরী হয়েছে। তিনজনের পন্য একজন কিনলে এটা হবেই তা স্বাভাবিক। এই পণ্য মজুদ, ক্রয় ও বিপনন ব্যবস্থাপনায় সার্বিক সচেতনতার অভাবই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা শুনুন-

ঘটনা এক -
-------------
দু'দিন আগে সকালে দোকানদারকে পুলিশের ভয় দেখিয়ে ৩০০০ টাকার চালের বস্তা ২৬০০ টাকায় নিয়েছি যা সে বাড়তি নিচ্ছিলো।

আমি অপারগ ছিলাম, তাকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়েও বাড়তি দাম রাখা থেকে বিরত রাখতে পারিনি বলেই পুলিশের ভয় দেখিয়েছি।

ঘটনা দুই -
------------
নিত্যপ্রয়োজনীয় ঔষধের দাম বাড়তি নিচ্ছে অনেক ফার্মেসি। আমি আমার ঔষুধ নিয়ে এসেছি তবে ৯৯৯ এ কল দিয়ে কমপ্লেইন জানিয়েছি। জীবন রক্ষাকারী ঔষুধের কৃত্রিম সংকট তৈরী করা মোটেই উচিত নয়।

ফলাফল- অন্যমুখে শুনেছিলাম দোকানদার দোকান খোলা রেখেই পলাতক ছিলো।

ঘটনা তিন -
-------------
বাজারে একজনকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পন্য ক্রয় করায় তাকে বুঝালাম অতিরিক্ত পন্য ক্রয় মানেই অন্যজন বঞ্চিত হচ্ছেন। কারন এতে পন্য সংকট তৈরী হচ্ছে যার দ্বায়ভার তার উপরেই বর্তায়। আর এ কারনেই দোকানদাররা বাড়তি দাম নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন।

গন্ডমূর্খটা উলটো আমাকে বলেছে- সবকিছু বন্ধ হলে চাল, ডাল কি তার বাসায় আমি দিয়ে আসবো? পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবে তখন কি হবে?

আমি মাসিক বাজারের বাইরে অতিরিক্ত পন্য কেনার পক্ষে নই। তাই রাগের চোটে বলে বসেছি- আপনি এই এত এত খাবার কিনছেন তা সবকিছু হজম করতে পারবেনতো? ধরুন আল্লাহ না করুন কালই যদি আপনার মৃত্যু হয় তাহলে এসবের কি হবে? বাড়তি এই দুইবস্তা চাল কি আপনার চল্লিশায় মানুষজনকে খাওয়াবেন?

তার বিবেকে আগুন লাগানোর জন্য আরও বলেছি- তাহলে দুইসেট কাফনের কাপড়ও কিনে নিয়ে যান। বলা যায়না দাম বাড়তি হলে তখন আপনার পরিবার এসব কোথায় পাবে তাইনা?

উপরের ঘটনা তিনটি আজ আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছে। বাসায় এসে এসব ভেবে খারাপ লাগছে। মনের অজান্তেও কারো ক্ষতির কথা চিন্তা করাতো দূরের কথা কারও মৃত্যুর কথাও ভাবতেও চাইনা। উপরওয়ালা ক্ষমা করুন।

আমাদের বুঝ এতো কম কেন! আপদকালীন সময়ে বাড়তি মুনাফার চিন্তা করা অনৈতিক। তাই নিজে সতর্ক থাকুন, সমাজের এসব অনাচারের বিরোধীতা করুন।

ভাবতে অবাক লাগে, যে জাতি মুক্তিযুদ্ধের পরে সবচেয়ে বড় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নিজেরা ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ ভূলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সফল হয়েছিলো, যে জাতি রাজাকারের ফাঁসির দাবীতে একসঙ্গে সমবেত হয়ে আন্দোলন করেছিলো, যে জাতি কোটা সংস্কারের আন্দোলনে সহমর্মিতা জানিয়েছিল, যে জাতি বেপরোয়া চালকদেরকে ট্রাফিক আইন মানাতে নিজেরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছিলো সেই একই জাতি আজ এই দূর্যোগের মূহুর্তে ব্যক্তিস্বার্থের কথা ভাবছে!

পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। একা তিনিই বা কি করবেন? তাঁর আশেপাশের তেলবাজ আর চাটুকারে ভরা। তারা যখন বলে- সব ঠিক আছে তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে সেটাই মানতে হয় অনেক সময়। যদিও তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন মানুষ। আর এ কারনেই এখন পর্যন্ত তাঁর কাছ থেকে যুগোপযোগী অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত এসেছে।

পৃথিবীর শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের দু'জন বাংলাদেশে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গার্মেন্টস এর তিনটিই আমাদের দেশে। শান্তিতে নোবেল প্রাপ্ত ব্যক্তি আমাদের দেশেরই মানুষ। পৃথিবীর শীর্ষ ঔষধ তৈরীকারী প্রতিষ্ঠানের চারটিই আমাদের দেশে। এরকম আরো অনেক সামর্থবান ব্যক্তি এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে আমাদের।

কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠান কি তাদের কর্মীদের এই বিপদকালীন সময়ে ন্যূনতম সুবিধা দিয়েছে? কেউই কি বলেছেন মানুষের জন্য আমরা এটা করবো সেটা করবো? কেউ কি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কিছু করছেন? কই কোন খবরেইতো দেখলামনা! অথচ এক্ষুনি কোন সরকারি অনুষ্ঠান হোক দেখবেন এরাই আবার কোটি টাকা অনূদান দেবে। সব লোক দেখানো হাস্যকর কাজ। করোনার এই দূর্যোগে এদেশের মানুষের জন্য তাদের কারোরই অনূদান/ অবদান কি কেউ জানেন?

হ্যা,কিছু মানবিক গুনসম্পন্ন মানুষ এই সময় ব্যক্তিউদ্যোগে কিছু হলেও করছেন। যেমন- গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাহেব, আমাদের ক্রিকেটারগণ আর বৈশ্বিক মানবতায় অনুপ্রেরিত হওয়া কিছু তরুণ তরুণী এবং অলাভজনক দু'একটি সংগঠন যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাদের ধন্যবাদ দিলেও কম হয়ে যাবে।

সত্যি আমি লজ্জিত! কোন একদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো এসব জেনে আমাদের ক্ষমা নাও করতে পারে। সেদিন যেন আমাকে/আমাদের লজ্জিত হতে না হয়। এই কঠিন দূর্যোগের মূহুর্তে আমি সমাজের মুনাফালোভী মানুষদের এমন অনৈতিকতা আর অমানবিকতাকে ঘৃণা করেছি, এসবের বিরুদ্ধাচরণ করেছি এই লেখাতে তার সাক্ষ্য রেখে গেলাম।

প্রজন্মের আদালতের কাঠগড়ায় লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নয়, মাথা উঁচু করে আমি দাঁড়াতে চাই।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ