শীতের পৌষ মাস শুরু হয়ে গেছে।এ বাড়ী ওবাড়ীতে কেবল পিঠা বানানোর ধুম।প্রত্যহ প্রাত্যুষে খেজুঁর রস বিক্রেতা রসের মাটির কলস নিয়ে ডাকছেন রস খাদকদের।এ দৃশ্য চিরচেনা;আমাদের বাঙ্গালী ঐতিহ্যর্যের রন্দ্রে রন্দ্রে মিশে আছে।যার নমুনা শহরগুলোতেও দেখা যায়।পিঠা তৈরীর মা চাচীদের এ উৎস যেন যুগ যুগান্তের স্বাক্ষী।কৃষি নির্ভর গ্রামগুলোতে সেই আগের মত আর তেমন পৌষের আমেজ নেই কেবল অবস্থাশীল গৃহস্থদের রান্না ঘরে হরেক রকম পিঠা তৈরীর আয়োজন এখনো দেখা যায়।
এ গ্রামেই বসবাস এক হতভাগ্যবতী সখিনার। বেশ কয় বছর আগেও স্বামী সংসার নিয়ে বেশ ভালই ছিলেন।আর্থিক দৈন্যতার এ পরিবারটির গত বছর ধান কাটা মৌসুম আগ পর্যন্ত আর্থিক ভাবে মোটামোটি ভালই ছিলেন।সে বছর ঘরে সঞ্চিত সব অর্থ এবং জমিদারের কাছে বাড়ী বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে ধান রোপণ করেন বগড়া চাষী হিসেবে।ধান ফলনও হয়েছিলো বেশ আশানুরূপ।সে বছর বাজারে ধানের ন্যায্য মুল্য পাননি কৃষকরা।ন্যায্য মুল্যতো দূরে থাক ঘরের চালান ঘরে আসার মতও দাম পাননি কেউ।অনেকে বাধ্য হয়ে মনের ক্ষোভে পাকা ধান ক্ষেতগুলোতে নিজেরাই আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেন।সেই সাথে কে কখন যে সখিনার পাকা ধান ক্ষেতেগুলোতেও আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো তা তারা নিজেরাও জানতেন না।জানলেন যখন তখন পুড়ে ছাড়খার হল তাদের স্বপ্নগুলো।
সখিনার দুইটি সন্তান।এক ছেলে এক মেয়ে।সংসারের টানপোড়ন সারতে তার স্বামী রজ্জব আলী গ্রামেই রিক্সা চালান এবং সখিনা পরের বাড়ীতে কামলা খেটে কোন মতে দৈন্যতার সংসারটি চালিয়ে যাচ্ছেন।ঘরে তাদের দুজন যক্ষের ধন এতিমের মত এ পাড়া ওপাড়ায় সারা দিন ঘুরে বেড়ায়।একদিন এক সন্ধ্যায় সখিনা তার দুসন্তানকে ঘরে না দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন।তারা কখনতো এমন সন্ধ্যা করে ঘরে ফিরে না!তাহলে গেল কোথায়? নাকি কোন বিপদ আপদ হল তাদের!।পেরিয়ে যায় সন্ধ্যারও একটি ঘন্টা।নাহ্ এখনো আসছে না।এ দিকে শীতের তীব্রতা আরো বাড়তে থাকল।এর মধ্যে স্বামী রজ্জবও কাজ শেষ করে বাড়ী ফিরে এলেন।স্বামীকে দেখে সখিনা দৌড়ে ঘরের আঙ্গিনায় স্বামীকে ধরে কান্না শুরু করে দিলেন।
-শীতল-বর্ষাকেতো পাচ্ছি না।
রজ্জব আলী।নিজেকে সারা দিনের পরিশ্রমি ক্লান্ত শরিরটাকে ফ্রেস করার জন্য চাপ কলের কাছে গিয়ে চেপে চেপে জল নাকে মুখে ছিটাচ্ছেন।সখিনার কথা যেন তার কানেই গেল না।
-কী !আপনেতো কিছু কইতেছেন না?কত রাইত হইয়া গেল পোলা মাইয়া দু’ডাই ঘরে নাই।কতদিন ধইরা--ওরা পিডা খাইবো পিডা বানাইতে কইতেছিল।মরার এমন কপাল ওগোতো পেটে ভাতইতো ঠিক মতন দিতে পারি না!পিডা বানাইয়া খাওয়ামু কেমনে।জমিদার বাড়ীর থেইকা আজ কিছু চাল আনছিলাম ওগোরে পিডা বানাইয়া খাওয়ামু।এহন দেহি ওরাই নাই..!1
-পাশের বাড়ী খোজঁ লইয়া দেখছনি?
-দেখছি,আশপাশ কোথাও নাইকা!।
-চলো দেহি খুজেঁ আহি…তুমি উত্তর পাড়ায় যাও আর আমি দক্ষিন পাড়ার দিকে যাইতেছি।
-আচ্ছা।
কোয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত।আজ শীতের তীব্রতাও অন্য যে কোন দিনের চেয়ে বেশ বেশী।মনে হয় শৈত্যপ্রবাহ চলছে। এমনি আবহাওয়ায় সখিনা আর রজ্জবের গায়ে শুধু পড়নের কাপড় ছাড়া গরমের কাপড় বলতেই নেই।শীতের কম্পন যেন তাদের শরিরে সন্তান হারানো ভয় কাবু করে রেখেছে।রজ্জব একটি টর্চ লাইট এবং সখিনার হাতে একটি হারিকেন নিয়ে সন্তানদের খুজঁতে যে যার মত বেড়িয়ে পড়লেন।
শৈতপ্রবাহের সাথে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে জনশুন্য পথ ঘাট।সখিনাদের গ্রাম ছেড়ে অন্যগ্রামে পরিচিত মোটামোটি এক অবস্থাশীল বাড়ীতে চলছে পিঠা উৎসব।উৎসবে সে বাড়ীতে আমন্ত্রীত হয়ে এসেছেন মেয়ে,নাত-নাতনীদের জামাই বউয়েরা।সেই বাড়ীর পিঠা বানানোর রান্না ঘরটি ছিলো বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট একটি খালের ধার ঘেষে।প্রায় সন্ধ্যায় যখন সখিনার আট দশ বছরের পিঠাপিঠি দুই ছেলে মেয়ে দিনের দূরন্তণার শেষে বাড়ী ফিরছিলো তখন তাদের পিঠালোভী নাকে পিঠার ঘ্রান আসতে থাকায় তারা দুজনেই থমকে দাড়ায়।
-…এই শীতল দাড়াত।কেমন জানি পিডা পিডা গন্ধ পাইতাছি!তুই গন্ধ পাছ না?
-হঅ আমারতো তাই মনে হয়।মনে হয় ঐযে ঐ বাড়ীতেই পিডা বানাইতেছে কারা যেন…ঐ যে আগুন দেখা যাইতেছি।
-চল তাইলে,যেয়ে দেহি পিডা খাওন যায়নি!আহা কতদিন এমন পিডার গন্ধ পাইনি।
-নারে..ওহানে যাওয়া যাবে না!ওবাড়ীতে এক বুড়ী আছে,খুব পাজি।আমাগো দেখলেই চেইত্তা যাইব।
-আরে ধূর! শয়তান বুড়ী না থাকলেতো ভিতরে রান্না ঘরে ঢুকমু।চল যাই…।
-চল।
খুব সাবধানে তারা এগুচ্ছে পিঠা উৎসবের রান্না ঘরের দিকে।মাঝে মাঝে শীতলের পিঠার ঘ্রান নাকে এলেই আহা! আহা! কী গন্ধরে,মনে হয় অনেক রহমের পিডা বানাইতাছে।হাটু জলের ছোট খাল পেরিয়ে খালের আইল বেয়ে উপরে উঠে পাটের শলা দিয়ে তৈরী রান্না ঘরের বেড়ার এক সাইটে দাড়িয়ে শলার বেড়ার ফাক দিয়ে উকি দিল তারা।নাহ্ বুড়ী নাই।রান্না ঘরে দেখা যাচ্ছে কেবল একজন!চুলাতো দেখছি অনেকগুলো।এখন ভেতরে যাওয়া যেতে পারে।মনস্থির করার সাথে সাথে সেই বজ্জাত বুড়ীটা হঠাৎ কোথায় হতে যে রান্না ঘরে এসে উদিত হল!তাতে তাদের কিশোর মনের আশাহত মন ভেঙ্গে যেন খান খান হয়ে গেল।ভেতরে যাওয়াটা থামিয়ে বেড়ার ফাকে উকিঁ দিয়ে দেখল, বুড়ী একটা পিড়ি টান দিয়ে রান্না ঘরেই বসে পড়লেন।
-কীগো তোমার হইল?ঐ দিকে জামাইরা বেবাকে গানের আসরে পিডার লাইগা বইসা আছে।
-এইতো হলো বলে…।ছোট বউরা যে গেল কই!সব আমারই করতে হয়।বড় বউ এক এক করে সব চুলোর পিঠা উঠাচ্ছে আবার কাচামাল চুলোয় দিচ্ছেন।এদিকে কিছুক্ষণ পর পর কাজের মেয়েটি এসে ভেতরে তৈরীকৃত কাচা পিঠাগুলো দিয়ে যাচ্ছেন আর নিয়ে যাচ্ছেন।
এ দিকে বুড়ী আরামছে একটি ভাপা পিঠা হাতের তালুতে নিয়ে পিঠায় ফু দিয়ে পিঠা খাওয়া শুরু করে দিলেন আর সেখানে অপেক্ষায় বসে রইলেন কখন পিঠা হবে তা গানের আসরে নিয়ে যাবেন।এ দিকে সখিনার সন্তানেরা মনের ক্ষোভে মরতাছে-শয়তান বুড়ী আহনের আর সময় পেল না।অনেক সময় পেরিয়ে গেল তবুও তারা বুড়ীর বিদায়ের কোন লক্ষণই দেখছে না।শীতের আক্রমন আর ঝিরঝির বৃষ্টির ফোটার জলে ওদের শরিরে কাপন ধরে গেল।ভাই বোনকে তাগাদা দিচ্ছে।
-চল,চলে যাই..আজ আর পিডা খাওয়া মনে অয় হল না।শয়তান বুড়ী মনে অয় আর যাইব না!
-আরে দাড়া আর একটু দেহি।
কিছুক্ষণ বেড়ার ফাক দিয়ে দুজনেই উকিঁ মেরে দেখল, কম করে হলেও আট দশ রকমের পিঠা বানানো হচ্ছে।চুলার সংখ্যা প্রায় পাচ সাতটি।কিছু পিঠা আছে যা তারা জীবনেও চোখে দেখেনি।লোভ যেন আরো বেড়ে গেল তাদের।কিছুক্ষণ জিম মেরে সেখানেই বসে রইল।
এদিকে সখিনা রজ্জব সারা গাঁ ঘুরে ঘুরে হয়রান।কোথাও তাদের খুজেঁ পাওয়া যাচ্ছে না।উত্তর দক্ষিণ খুজেঁ তারা এক হয় এক সময়।মাথায় হাত দিয়ে কদামাক্ত মেঠো পথেই বসে পড়লেন সখিনা।প্যাক কাদায় শরির তাদের ভুতুরে অবস্থা।পথি মধ্যে যাকেই পাচ্ছেন তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন।
-আমাগো শীতল বর্ষারে দেখছেননি আপনেরা?
কেউ দেখেননি।জনে জনে জিজ্ঞাসা নিরুৎসাহিত হলেন তারা।এর মধ্যে এক পথ যাত্রী বললেন ভিন্ন কথা।
-শুনছি,ঐ পাড়ার ঐ খালের ধারে নাকি কার লাশ পাওয়া গেছে!।
কথাটি শুনার পর সাথে সাথে ওদের আর হুস রইল না।দিলেন দৌড় পাগলের মতন উড়াধুরা সেই গন্তব্যের দিকে।কীসের হারিকেন কীসের টর্চলাইট সব ফেলে দিয়ে জানপ্রান দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন।
কিছুক্ষণপর বুড়ীকে রান্না ঘর থেকে সরে যেতে দেখে ওরা বেশ উৎফুল্ল হল।তারা এ সুযোগে রান্না ঘরের পিছনের ঝুপরি হতে বেরিয়ে শলার বেষ্টনি ধরে ধরে ধীরে ধীরে রান্না ঘরের ভেতরে ঢুকল।পিঠা বানাচ্ছেন যিনি তিনি হলেন দেওয়ান বাড়ীর বড় বউ।খুব ভাল মানুষ।সখিনার স্বামীর দুর সম্পর্কের বড় ভাইয়ের বউ।সখিনাকে খুব ভাল ভাবেই সে চেনে এবং জানেন।তার ছেলে মেয়েদেরকেও চিনতেন তবে তা ছিলো যখন তাদের বয়স যখন তিন চার বছর।এই পাচ ছয় বছরের যোগাযোগের গ্যাপের কারনে তাদের চেহারায় বেশ পরিবর্তন আসায় সে তাদের তেমন ভাবে চিনতে পারলেন না।তারপর তাদের রান্না ঘরের ভেতরে দেখতে পেরে প্রথমে মনে করছিলেন হয়তো কোন ফকির ফাকরা হবে।পরে আসো- বলে দেয়ার পরও যখন ওরা যাচ্ছিল না তখন সে আবারো তাদের দিকে ফিরে তাকালেন।দেখলেন দুটো ফুটফুটে কিশোর ভেজাঁ শরির।শীতে তাদের হাত পা অনবরত কাঁপছে।তার বেশ মায়া হল।সে চুলোয় বসা হতে উঠে তাদের কাছে গিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞাস করলেন।
-তোমরা কেগো?কোন পাড়ার? এতো রাইতে!এমন শীতে! এভাবে ভিজেঁ আছো।তোমাদের কী বাড়ী-ঘর, মা বাবা নাই।
শীতের কম্পনে বর্ষা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল।
-আমরা ঐতো পশ্চিম পাড়া-রসুলপুরের।
-রসুলপুর?
-হঅ
-কার মাইয়া? তোমাগো মা বাবা কেডা?
-বাবার নাম রজ্জব আলী,মায়ের নাম সখিনা।
পরিচয় পাওয়ার সাথে সাথে বড় বউ হাউমাউ করে চিৎকার দিয়ে ওদের জড়িয়ে বুকে নিল।
-আরে কছকী! আগে কইবিতো! তোগো এ অবস্থা কেন?ইস্ ভিজেঁতো একেবারে শেষ।এতো রাতে কেন আইছিলি এহানে?
-পিডা খাইতে।পৌষের পিডা।
আশ্চর্য হলেন একটি পিঠা খাইতে এতো কষ্ট ওরা করল!ওদেরতো এমন অভাব অনটন ছিল না।
-কেন?তোর মা তগো পিডা বানাইয়া খাওয়ায় নাই?
-না,আমরাতো গরিব তাই!ঘর বাড়ী কিছুই নাই।
-কছকীরে…!!।
ওদের সাথে কথা আর না বাড়ীয়ে ওদেরকে সাথে করে নিয়ে তার নিজের ঘরে ঢুকলেন।তোয়ালে দিয়ে ওদের সমস্থ শরির মুছে দিলেন।এরপর গরম কাপড় এনে দিলেন পড়তে।ওরা ভেজাঁ জামাগুলো খুলে গরম জামাকাপড়গুলো পড়ল।বড় বউয়ের রুমের খাটেই ওদের বসতে দিলেন।বড় বউয়ের দুবাচ্চা অন্য একটি খাটে ঘুমুচ্ছেন স্বামী আছেন গানের আসরে।
তার দেবরের ঘরের উঠোনে চলছিলো পিঠা উৎসব আর বয়াতী মারফতী গানের আসর।দেওয়ান বাড়ীর সবায়,পাড়ার কিছু প্রতিবেশীরা সেখানে পৌষের পিঠা উৎসবের আনন্দে মেতে আছেন।শীত মৌসুমে এমন গানের আয়োজন প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যেত।সভ্যতার ক্রমবর্ধমান উন্নয়ণ আর মানুষের মন মানষিকতার অতি উন্নয়ণে এ সব এখন অনেকের কাছে এখন ব্যাক ডেটেড-স্বপ্ন মাত্র।আমাদের এ যুগের ছেলে মেয়েরা কখনো খুজেঁ পাবে না পৌষের সেই আবেদনময় আমাদের সেই অতীত।ওরা কল্পনাও করতে পারবে না এমনি পৌষের হাড়ঁ কাপাঁনো শীতে চাদর গায়ে দিয়ে থর থর করে কাপতে কাপতে মাইলকে মাইল হেটে দূরে কোথাও ওয়াজ মাহফিল,যাত্রাপালা বা বাউল শরতি মারফতী গানের আসরে যেতাম।কল্পনাও করতে পারবেনা পৌষের পিঠা উৎসবের বাড়ী বাড়ীতে কীরকম ধুম পড়ে যেত।গ্রীষ্মে মামা বাড়ির আম কুড়াতে যেমন সুখ , শীতে মামা বাড়ির পিঠা খেতে ও তেমন সুখ।এখন তাদের এ ইচ্ছে গুলো কাটে বন্ধ ইট পাথরের চার দেয়ালে,বাড়ীর কোন ছাদে রঙ মাখানো কৃত্তিম কোন পাগলা ড্যান্সে আর পৌষের পিঠার সাধ মিটায় অর্ডারকৃত ভাসি পিঠা ক্রয়ে।তবুও এখনো গ্রামের কোথাও না কোথাও এর আয়োজন রয়ে গেছে তবে তা পরিমানে সামান্য।এ বাড়ীতে আজ তেমনি একটি পৌষের পিঠা উৎসবের রাত যা তাদের চৌদ্দ পুরুষরা যুগ যুগ ধরে করে আসছিলেন।
সখিনা রজ্জব পথচারীদের জাজ্ঞাসা করতে করতে পাগলের মত দৌড়ে গেলেন সেখানে-সেই খালটির ধারে।দেখলেন কিছুটা দূরে বেশ কিছু লোকজনের একটি জট।দ্রুত দৌড়ে সেখানেও চলে গেলেন সখিনা,রজ্জব পিছনে পড়ে গেলেন।সখিনা ভীড় করা উৎসুক লোকজন সরিয়ে লাশের দিকে তাকিয়ে খোজাঁর চেষ্টা করলেন তার সন্তানদের।দেহের গঠন দেখে মনে হল এ একজন বয়স্ক মানুষের লাশ।এর মধ্যে রজ্জব সখিনার কাছে চলে আসেন। সেও বুঝতে পারলেন এটা তাদের লাশ নয়।ভীড় ঠেলে ভীড় করা লোকজন হতে দুরে সরে এলেন তারা।
জান আর যেন চলছিল না।ক্লান্ত শোকার্ত দেহ মন যেন নেতিয়ে পড়ল জমিনে।রজ্জবের মনে হল এখানে তার এক দূর সম্পর্কের ভাইয়ের বাড়ীর কথা।সেখানে গিয়ে পয়পরিস্কার হয়ে নিজেদের একটু ফ্রেস হওয়া দরকার বলে মনে করলেন রজ্জব।নতুবা ভাবলেন,সখিনা কথা!শীতের যে প্রকোপ তাতে যে কোন সময় সে জ্ঞান হারাতে পারে।
-শুনছো? চল ঐ যে লাল নীল বাতি দেখা যাচ্ছে,ঐটাই হল গিয়া দেওয়ান বাড়ী।আমাগো মুকলেছ দেওয়ান এর বাড়ী।ওখানে গিয়ে খোজঁ নিয়ে আসি আর নিজেরাও একটু জিরাইয়ে নেই।
সখিনা মুখে কিছুই বলতে পারলেন না।অশ্রু ঝরা নয়নে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে স্বামী রজ্জবের সাথে হাটতে থাকলেন।যতই কাছে যাচ্ছে ততই যেন গানের আসর হতে বয়াতী গানের কন্ঠ স্পষ্ট হতে থাকল।
“বাউল আব্দুল করিম বলে
জীবন লীলা সাঙ্গ হলে
শুয়ে থাকবো মায়ের কোলে
তাপ-অনুতাপ ভুলে
মাকে ভুলে না মায়ের খাঁটি সন্তান হলে
মা বিনে আর কি আছে তার
সুখে-দুঃখে মা-মা বলে।
বাংলা মায়ের ছেলে,আমি বাংলা মায়ের ছেলে”।।
(আসরে করিম বাউল ফকিরে গানের কিছু অংশ)
মানুষের আনাগোনাও বাড়তে থাকল।বাড়ীর আশে পাশে গানের আসরের উপলক্ষ্যে কেউ চিনাবাদাম কেউ ঝালমুড়ি কেউ চটপটির আলগা দোকান সাজিঁয়ে মোটা সলতার বাতি জ্বালিয়ে বিক্রয়ে ব্যাস্ত।
দেওয়ান বাড়ীর বড় বউ যেমন বউদের মধ্যে বড় তেমনি বড় তার মন।সখিনার দুসন্তানের সামনে ছোট ছোট পাত্রে এক এক করে হরেক রকম পিঠা...
ভাঁপা পিঠা,ভেজিটেবল ঝাল পিঠা,ছাঁদ পিঠা,ছিটকা পিঠা,আসকে পিঠা,চুটকি পিঠা,চাপরি পিঠা,চাদ পাকন পিঠা,ছিট পিঠা,সুন্দরী পাকন,পুলি পিঠা,পাতা পিঠা,পাটি সাপটা,পাকান/তেল/পোয়া পিঠ,কালাই পুড়ি,সরল পিঠা,তেজপাতা পিঠা,গোলাপ পিঠা,পানতোয়া,পুডিং,নারকেল জেলাফি,নকশি পিঠা,রসফুল পিঠা,লবঙ্গ পিঠা,হাড়িঁপিঠা,সুর্যমুখী পিঠা,নারকেল পিঠা,নারকেলের ভাজা পুলি,নারকেল জেলাফি,ঝিনুক পিঠা,জামদানি পিঠা,ঝালপোয়া পিঠা,মালাই পিঠা,মেরা পিঠা,কলা পিঠা,কাটা পিঠা,খেজুর পিঠা,ক্ষীর পিঠা,ফুল পিঠা,সেমাই পিঠা,কাইনের মোয়া,নারকেল নাড়ু,ফুরঝরি পিঠা,সন্দেশ পিঠা,কুলশি পিঠা, ইত্যাদি সাজাঁইয়া খেতে দিলেন।
শীতল বর্ষার এ যেন স্বপ্ন দেখছে।চোখ বড় বড় করে পিঠাগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।
-নেও..খাও।আরো আছে।আজ সব খেয়ে যাবে তোমরা।তোমাদের মা বাবা কী জানে তোমরা এখানে?
(ওদের যেন এতক্ষণে হুস হল।সত্যিইতো মা বাবাকেতো বলা হয়নি!)
-না..হেই সকালে বেরুছিতো…!!
-বলো কী!তাহলেতো ওরা এতক্ষণে তোদের খুজঁতে খুজঁতে পাগল হইয়া গেছে।আচ্ছা ঠিক আছে চিন্তা করো না,আমি খবর পাঠাইতেছি।
ওদের শান্তনা দিয়ে বড় বউ ঘর হতে বাহির উঠোনে এসে এদিক সেদিন লোক খুজঁলেন।কাউকে পান কীনা।ঠিক সে সময়
দেওয়ান বাড়ীর ঘাট দিয়ে বাড়ীর বিশাল উঠোনে উঠে তারা খুব ক্লান্ত অনুভব করলেন।উঠোনে দাড়াতে চোখে পড়ল বড় বউয়ের।কাকে যেন সে ডাকছেন।দূর হতে প্রথমে ওদের শরির ভেজাঁ ও কাদামাটি লেপ্টে থাকা দেখে তাদের চিনতে পারলেন না।তাদের কাছে যেতেই সখিনা ভাবীগো বলে চিৎকার দিয়ে ভাবীকে জড়িয়ে ধরল।
-তোদের এ অবস্থা কেন?
-আমাগো জীবন শেষ।
বলে কান্না শুরু করলেন সখিনা।স্বামী রজ্জবের চোখেও জলের বন্যা।
-আরে কী হইছে বলবিতো?
সখিনা আর কিছু বলতে পারলনা।রজ্জবের মুখ হতে তাদের সন্তনদের হারানোর কথা শুনে বড় বউ মুচকি হাসলেন।বড় বউয়ের হাসি দেখে ওরা ভাবলেন এ আবার তারা কার কাছে কী বলছেন।মনে হয় ভাবীর সেই আগের জ্বীনে ধরা রোগটা রয়ে গেছে।অতপর বড় বউ বললেন।
-আয় আমার সাথে আয়।
বড় বউ তাদেরকে তার রুমে নিয়ে গেলেন।বিরাট এলাহী কান্ড! চারদিক বাশের চটির বিভিন্ন পাত্রে প্রায় দশ বারো রকমের পিঠা সাজাঁনো রয়েছে।পাশেই একটি খাটে তাদের দু’নয়নের মণি সন্তানেরা নতুন জামা পড়ে হাসিমুখে আরামে বিভিন্ন রকমের পিঠা খাচ্ছে।তা দেখা মাত্রই সখিনা দৌড়ে তার সন্তানদের জড়িয়ে ধরে নাকে মুখে চুমো দিতে দিতে আদর করতে লাগলেন।
---------------------------------------------
ছবিঃ অনলাইন এবং ফারুখ আহমেদ
wikibooks
৩২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
যাক, বড় বৌ এর কল্যানে শীতল বর্ষা এবং ওদের বাবা মা এর পিঠা খাওয়া হলো।
এত পিঠার নাম পড়ে তো জিবে পানি এসে গেলো।
মনির হোসেন মমি
জ্বি ভাইজান কিন্তু দুঃখের বিষয় আমিও অনেক পিঠা চোখেই দেখিনি। ধন্যবাদ ভাইজান।শীতের সতর্কতায় ভাল থাকবেন।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসাধারণ। এত এত পিঠার নাম জানলাম। সবই পেলাম কিন্তু শীতে মামা বাড়িতে আম কুড়ানোর সুখ কেমনে আসলো? শীতে কি আম পাওয়া যায়?
মনির হোসেন মমি
ওটা রূপক অর্থে…আপু।গল্পটি পড়ার জন্য- অসংখ্য ধন্যবাদ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
বিরাম চিহ্ন দিলে অর্থটা বুঝা যেত যে ওটা রুপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সরি তাই বুঝতে পারিনি। ধন্যবাদ ভাইয়া
মনির হোসেন মমি
আপু সরি বলার কিছুই বরং আমার জন্য উপকার হল-ভুলটা আমার ধরিয়ে দিলেন।সে জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।আমিও চাই আমার লেখায় সমালোচনা হউক,ভুলটি ধরিয়ে দিক ।লেখাটি ঠিক করে দিলাম। আবারো ধন্যবাদ।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ ভাইয়া। শীত এলেই ‘মামার বাড়ীর আম কুড়াতে সুখের মত’ মামার বাড়ী বেড়াতে যাবার পাগল থাকত মন। এটা কেমন হলো?
মনির হোসেন মমি
মাথায় আসছে না।বলে দেন একটু লাইনটা কী হতে পারে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
গ্রীষ্মে মামা বাড়ির আম কুড়াতে যেমন সুখ , শীতে মামা বাড়ির পিঠা খেতে ও তেমন সুখ। এটাও দিতে পারেন ভাইয়া। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এটা হলে ভালো হয়
মনির হোসেন মমি
হুম
চমৎকার ।ধন্যবাদ।
তৌহিদ
দারুণ দারুণ! কত কত পিঠার নাম জানলাম আপনার গল্পের সুবাদে! গরীব বড়লোক সবারই পিঠা খেতে ইচ্ছে করে। অথচ বড়লোক পিঠা খায় উৎসব করে আর গরীব চেয়ে দেখে নির্বাক নয়নে।
অনুভাবী গল্প ভালো লেগেছে ভাই।
মনির হোসেন মমি
ঠিক তাই ভাইয়া।তবে উৎসবের মনের তৃপ্তিটা বড় লোকদের চেয়ে গরীবের কুড়েঁর ঘরেই বেশী। ধন্যবাদ ভাই।
সাবিনা ইয়াসমিন
এত পিঠার নাম কেমন করে জানলেন মমি ভাই? পড়তে পড়তে আমার চোখ ভাপা পিঠার মতো হয়ে গেছে 😵
মনির হোসেন মমি
পৌষের পিঠা উৎসবে পিঠা থাকবেনা তাই কি হয়!তাই সোনেলায় ঢেলে দিলাম।যে যা পারেন খেয়ে নিন।পৌষে পিঠার দাওয়াত নিলাম আফা।
সাবিনা ইয়াসমিন
যত পিঠার নাম জানলাম, এত গুলো এখনো চোখেও দেখিনি। তবে আমার মনেহয় জেলা পর্যায়ে একই পিঠা একেক জায়গায় ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।
পোস্ট খুব ভালো হয়েছে মমিভাই।টুকটাক বানান গুলো ঠিক করে নিলে লেখাটি আরও উপভোগ্য হতো।
নিয়মিত হন প্লিজ।
শুভ কামনা 🌹🌹
মনির হোসেন মমি
হুম ঠিক তাই হবে অঞ্চলভেদে নামের ভিন্নতা। নিয়মিত আবার কবে হতে পারব জানি না তবে চোখ থাকবে সর্বোক্ষণ সোনেলায়।
সঞ্জয় মালাকার
অসাধারণ লেখা দাদা । এত এত পিঠার নাম জানলাম।
পৌষ সংক্রান্তির শুভেচ্ছা প্রীতি ও ভালোবাসা। শুভকামনা জানাবেন দাদা।
মনির হোসেন মমি
আপনার জন্যও শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা।প্রবাসে এমন পিঠা পাওয়া যায়?
সঞ্জয় মালাকার
পাওয়া যায় দাদা আমাদের বাংলাদেশের হোটেল গুলোতে ।
ইসিয়াক
অনেক সুন্দর । অনেক পিঠার নাম জানলাম ।
শুভেচ্ছা সহ শুভকামনা রইলো ভাইয়া ।
মনির হোসেন মমি
অনেক ধন্যবাদ প্রিয়।
নিতাই বাবু
পিঠার নাম দেখে তাজ্জব বনে গেছি। আমিওতো এতো পিঠার নাম জানি না। গল্প কিন্তু বেশ জমেছে। তবে এও ঠিক বলেছেন যে, আগের মতো গ্রাম শহরে রস-ওয়ালাদের দেখা যায় না, পাওয়াও যায় না। যা দেখেছি তা বহু আগে। আর আগের মতো নিজের ঘরেও এই পৌষসংক্রান্তি বা মকরসংক্রান্তি বা সাকরাইনের আমেজ উৎসব বলতে কিছুই নেই। সবার এখন নিজেদের কর্ম ব্যস্ততায় মগ্ন।
শুভকামনা থাকলো দাদা।
মনির হোসেন মমি
অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।আপনার পৌষসংক্রান্তি লেখাটিও চমৎকার হয়েছে।পড়েছিলাম মোবাইলে মন্তব্য করব।
ছাইরাছ হেলাল
আপন পিঠা দেখিয়ে তো টেনশনে ফেলে দিয়েছিলেন।
যাক বড় বৌদের উপর আমারা আস্থা রাখতেই পারি, পিঠে-পুলির ব্যাপারে।
মনির হোসেন মমি
টেনশন মানে! আমাদের খাওয়াবেন বলে?
ইকবাল কবীর
পিঠার প্রথম ছবি টা আমার এলাকায় ইদে করে থাকেন। আমরা বলি নকশী পিঠা, অনেকে আবার ফুল পিঠা ও বলে থাকেন। অনেক পিঠার নাম জানলাম। শুভ কামনা।
মনির হোসেন মমি
হুম ঠিক ভাইয়া শুধু ঈদে নয় বিশেষ বিশেষ উৎসব জামাইবাবুর দাওয়াতে এ পিঠা বেশ জনপ্রিয়।
নৃ মাসুদ রানা
ভাই, একদিন দাওয়াত দিতে পারেন..
মনির হোসেন মমি
চলে আসুন
নো চিন্তা ডু ফুর্তি।
ফয়জুল মহী
প্রবাসে থেকে দেখি না কতদিন বাংলা মায়ের রূপ । এই গল্প পড়ে জিব্বায় জল এলো। কল্পনায় আসলো বাংলার কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল।
মনির হোসেন মমি
আহারে! আমিও একদিন প্রবাসী ছিলাম।তখন এ যুগের মত এতো অনলাইন নির্ভর ছিলনা স্বদেশ।তাই প্রবাসের যন্ত্রণা আমিও বুঝি।প্রবাসে দেশের কিছু পেলেই হুমরি খেয়ে পড়তাম তা পেতে।
আপনারা কষ্ট করে দেশের রেমিটেন্স বাড়াতে সহযোগীতা করছেন।আপনেরা দেশের অহংকার। ধন্যবাদ ভাইয়া।ভাল থাকবেন।নিরাপদে থাকবেন।
এস.জেড বাবু
-আরে দাড়া আর একটু দেহি।
কিছুক্ষণ বেড়ার ফাক দিয়ে দুজনেই উকিঁ মেরে দেখল, কম করে হলেও আট দশ রকমের পিঠা বানানো হচ্ছে।চুলার সংখ্যা প্রায় পাচ সাতটি।কিছু পিঠা আছে যা তারা জীবনেও চোখে দেখেনি।লোভ যেন আরো বেড়ে গেল তাদের।কিছুক্ষণ জিম মেরে সেখানেই বসে রইল।
অসম্ভব একটা অবয়ব তুলে ধরেছেন- মুগ্ধতা
শুভেচ্ছা রইলো ভাইজান