শীত বুঝি জাঁকিয়েই এলো এবার! মধ্যদুপুর হতে না হতেই সূর্যদেবতা টুক করে চলে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে, আর সারা দিন দেখা নেই। আবার যদি তার ইচ্ছে হয় হয়তো পরেরদিন সকাল সকাল মিষ্টি রোদের সোনালি আলোকছটা নিয়ে আসবে এখানে- আমার ছোট্ট উঠোনটাতে। কি মিষ্টি তার আভা! সে পরশ গায়ে লাগলে কিরকম যেন ওম লাগে।

পৌষ সকালের সেই মিষ্টি রোদের কিরণ গায়ে মাখাচ্ছি আমি। আহ্ পরম শান্তি! হঠাৎ চোখ যায় শিশির মাখানো টুকটুকে লাল গোলাপটার উপর। আহা! কি রুপ-মাধুর্য তার। যেন একটি গোলাপ কলির উপর একটি শিশির বিন্দু...…!

আসলেইতো জীবনটা এমন! এই জগৎ ও জীবনের সৌন্দর্য-মাধুর্য-প্রেমে যেমন প্রকৃতিকে অনুভব করা যায়, আবার সৃষ্টির অসীমতা তার অনন্ত মহিমান্বিত জ্যোতিময় স্বরূপকেও অনুভব করা যায় প্রকৃতির এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। শুধু দেখার চোখ থাকতে হয়। আমার মত বৈরাগী হোমোসেপিয়েন্স এর পক্ষে প্রকৃতির রূপ মাধুর্য বর্ণনা করা অসম্ভব।

একাকীত্বতা যেন আমার নিত্যসঙ্গী। আমার এ একাকী যাতনার সুর মানবপ্রেমের বিরুদ্ধে নয়। একাকীত্বকে সঙ্গী করে দিনযাপনের মুহুর্মুহু বেদনায় আক্রান্ত আমার মনের এই আকুতি আসলে প্রকৃতি থেকে দূরে থাকার আক্ষেপ।

ঘর-সংসার, জগতের মোহ-মায়া এখন আমায় আর আকৃষ্ট করেনা। এই যে এখন গায়ে চাদর জড়িয়ে রোদ পোহাচ্ছি অথচ গিন্নী সেই কখন থেকে ডাকছে ঘরে কিন্তু আটা নেই, আটা নেই বলে। দোকান থেকে আটা কিনে আনার জন্য যেতে বলছে। না হলে আজ আর নাস্তা খাওয়া হবেনা। খেতে হবে সেই কটকটে টোস্ট আর গরম চা।

ধুর! ধুর! ভালো লাগেনা! এই সুন্দর পৌষ সকালের রোদ পোহানো ছেড়ে এখন দোকানে যেতে হবে। প্রকৃতিকে অবলোকন করার সময় কই? যায় দিন যাচ্ছে নিজের মতন। কখন হেমন্ত গিয়ে পৌষ এলো, আবার সামনে বসন্ত আসবে। অথচ আমি আমার মতন ছন্নছাড়া চলেছি। এ জীবনে প্রকৃতি-পৌষ-পার্বণ মুগ্ধতা বলে আর কিছু নেই।

পৌষের এই আগমনে প্রকৃতির বীণায় কত যে বিচিত্র সুরের আলাপন হচ্ছে! আমার মনোবীণার সুর শীতের তীব্র কুয়াশায় হারিয়ে গিয়েছে সেই কবেই। মাঝেমধ্যে মনে হয় সংসারের সমস্ত কাজ-কারবার, দেনা-পাওনা চুকিয়ে দিয়ে জগৎ ও জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য-মাধুর্যের মোহ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিজের বিক্ষিপ্ত চিত্তকে সংযত করি। কিন্তু তা আর হয় কই? জগৎসংসারের রোষানলের চাপে আমি যে দিশেহারা পথিক!

বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি হাঁটতে থাকি শিশির ভেজা দূর্বা ঘাসের নরম চাদরে খালি পায়ে। শিশিরজলের বিন্দু বিন্দু ধারা নেমে আসছে পা থেকে। মনে হয় আমি তলিয়ে যাচ্ছি হিমশীতল ঝরনার অতল গভীরে। দেহ-ভোগের কামলালসা সমস্ত বৃত্তাবরণ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে আমি অবগাহন করছি অলীক সৌন্দর্যের রূপ-লালসার তুলতুলে নরম দেহপ্লাবনে। আহ্! কি শান্তি! ভাগ্যিস পৌষ এসেছে, তা না হলে এই সামান্য শান্তিটুকু কোথায় পেতাম?

সামনেই কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্ত পানে উড়ে যায় একঝাক পানকৌড়ি। বাতাসে শীতের তীব্র ঝাঁঝালো স্পর্শ লাগে নাকের ডগায়। গা শিউরে ওঠে, তীব্র পানির পিপাসা পাচ্ছে হঠাৎ! কিন্তু মনে কোন অতৃপ্তি নেই আমার। প্রকৃতি-মানসের বিচিত্র রূপ রসের ফেনিল পাত্র হাতের নাগালেই, তবুও যেন পান করতে ইচ্ছা করছে না। আমি পৌষের এই সৌন্দর্য-মাধুর্যের আকর্ষণে ক্ষণিকের জন্য আত্মবিস্মৃত হয়ে যাই। আহ! পৌষ এসেছে!

হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ের কাছাকাছি চলে এসেছি। বেলা উঠেছে বেশ, একটু পরে অফিসে যাবার সময় ঘনিয়ে আসবে। আচ্ছা আজ অফিসে না গেলে হয়না? সারাদিনভর না হলেও দুপুর বেলা পর্যন্ত যদি বসে থাকি পুকুর ঘাটে? অপরপ্রান্তের তালগাছে অনেক পাখির আনাগোনা দেখতে পাচ্ছি। কেউ বাসা বাঁধছে, কেউ সঙ্গী জোটানোর আশায় বিচিত্র ভঙ্গিতে ডাকছে। পৌষতো তাদেরও সঙ্গমের ক্ষণিকালয় হিসেবে এসেছে। তবে তারা আমার মত ছন্নছাড়া বোহেমিয়ান নয়। নিয়ম মেনে সংসারধর্ম পালন করে। আজ তাদের সঙ্গেই না হয় কাটুক বেলা।

এসব চিন্তা-ভাবনার জড়তা নিয়ে বসে পড়ি পুকুরঘাটে। একজোড়া ধবধবে সাদা রাজহাঁস জলকেলী করছে পানিতে। অপার বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছি আমি। আহা! এই পৌষেইতো হাঁস কপোত-কপোতীর মিলন রচিত হবে। সে লীলাময় ক্ষণকে পাওয়ার জন্য তারাও নিশ্চয়ই অজানা শিহরনে আজ শিহরিত!

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে, আমি উঠে পড়ি পুকুর ঘাট থেকে। পৌষের হিমশীতল বাতাসে গা জুড়িয়ে এসেছিল আমার। ক্ষণিকের আবেশে চোখ বন্ধ করে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে নিজেরই আর মনে নেই। আচ্ছা বাসার কি অবস্থা? আটা কিনতে যাবার নাম করে বেড়িয়ে পড়েছিলাম যে! বাড়িতে গিন্নী নিশ্চিত চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। মোবাইলও সঙ্গে আনিনি ইচ্ছে করেই। আজ অফিসেও যাইনি। কি যে হলো কে জানে!

পৌষের অনিবার্য মায়া আমায় আজ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমার রক্তে লেগেছে আগুন। তাই ঘরের আকর্ষণ কিছুতেই আমাকে আর টানছেনা। নীড়ে প্রিয়জনের আহ্বান, সৌন্দর্য-মাধুর্যের উপভোগ্যতা, নিশ্চিন্ত সুখ-শান্তির আবাস এসবের কিছুই আমার এই ক্ষণিক পৌষ প্রকৃতির বিস্ময়কর রুপ অবলোকনে কোন বাধারই সৃষ্টি করতে পারেনি।

পৌষ-সৌন্দর্য আমাকে রুপান্তরিত করেছে একজন ছন্নছাড়া বোহেমিয়ানে। আমার আর দিনক্ষণের জন্য অপেক্ষা করার ধৈর্য নেই। আমিতো জন্ম হতেই বর্তমান। আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যৎ হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

হে পৌষ! আজ আমি দিগন্তবৃত্তে প্রসারিত করেছি এ হাত। আমায় আলিঙ্গন করো তোমার রিক্তহৃদয়ের উষ্ণতায়। পৌষ! আমি জ্বলে পুড়ে ভস্ম হতে চাই তোমার নিযুত প্রেমাসক্ততায়, অলীক মায়ামোহের অনলে।

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ