পৌরুষ প্রেম

দালান জাহান ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১, মঙ্গলবার, ০২:৫১:০৪পূর্বাহ্ন ছোটগল্প ৩ মন্তব্য

সুমন বিষ খেয়েছেন সংবাদটা আসার পর তিনি একদম নীরব হয়ে গেলেন। তার অতি চঞ্চল মুখখানা মুহূর্তেই বিষাদ হয়ে গেলো। হঠাৎ নীরব হওয়া মানুষের নীরবতা অনেকটা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার মতো।

আমাদের নিজস্ব কিছু মানুষ থাকে আত্মার ভেতরে ঘুপটি মেরে বসে থাকে সময়কে ধরে রাখে এবং একই সাথে সবার আনন্দের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বসে থাকে মাথায়। স্বরুপ তেমনই এক মানুষ। যার একদিনের অনুপস্থিতিতে বর্তমান ইন্টারনেট মিসিংয়ের মতো বলা যেতে পারে।

কবে গলির মোড়ে বসে কে কার সমালোচনা করেছেন, আর তার প্রতিক্রিয়াই কী? কে ঘরে বউ রেখেও বুড়ো বয়সে প্রেমজলে নেমে হাঁটু ভিজিয়েছ এক কথায় স্বরুপকে বলা যায় সবার খবর। এক কথায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক খবরের আঞ্চলিক বিবিসি গণ্য স্বরুপ। প্রতিদিন তার প্রথম কাজ হচ্ছে খবর পড়া। পত্রিকার শিরোনাম থেকে পাতার শেষ অক্ষর তিনি অন্তরে টাইপ করে নেন। তাই এলাকার লোকজন তার নাম দিয়েছেন খবর উদ্দিন।

ছোটখাটো শরীরের এই মানুষটার স্বরূপ দেখলে আপনি কোন রুপই পাবেন না।  তাকে প্রথমে আপনি কিছুই ভাববেন না। বড়জোর ভবঘুরে অথবা নিদান মানুষ ভাবতে পারেন। গায়ের কালো কুচকিচে রঙ আর মাথার কালো চুল এবং চোখের তীক্ষ্ণ কালো মনি তাকে দিয়েছে কালো কাজলের অসাধারণ মর্যাদা। কিন্তু তার কালো মুখে জড়িয়ে থাকে একধরনের আকর্ষিক মায়া যা সচরাচর থাকে না।

কিন্তু এই খবরটা আজ তাকে খুব বেশি মর্মাহত করেছে। ছেলেটি আত্মহত্যা করবে কেন? দুনিয়ায় সব খবর তার কাছে থাকলেও এই খবরটা তার অন্তরে নেই,  নেই কেন? অথচ এই সুমন ছেলেটা তার কেউ হয় না। ভালো করে জানে না তার পরিচয় ও সে। কিন্তু যেকোনোভাবে ছেলেটার এই কর্মকাণ্ডের দায় এখন তার কাঁধে।

গত দুই বছর আগে ছেলেটার সাথে তার সম্পর্কের সূত্রপাত হয় রঙ নাম্বারে একটি ফোন কলের মাধ্যমে। এই পর্যন্ত ছেলেটিকে সে দেখেওনি এমনকী দেখার প্রয়োজনও মনে করেনি। প্রথমদিকে ছেলেটা প্রতিদিন তাকে এক দুইবার ফোন করতেন।

প্রথমে স্বরূপ খুব বিরক্ত হতেন। কিন্তু ছেলেটি যখন বললো, "ভাইয়া আমার নাম সুমন, আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার বাবা নেই কিন্তু  আপনার সাথে কথা বললে, আমার খুব ভালো লাগে, আপনি কী দয়া করে প্রতিদিন অন্তত একবার আমার সাথে কথা বলবেন? "স্বরূপ কী বলবেন কিছু ভেবে পায় না। একটু ছোট্ট ছেলের আরতি আবার ফেলতেও পারে না। তবুও ছেলেটার আবেগজনিত কন্ঠস্বরকে অবাঞ্ছিত করতে পারে না স্বরুপ।

শুধুই তাকে সাময়িক খুশি করতে স্বরূপ বলেন "আচ্ছা ঠিক আছে কথা বলব তোমার সাথে। " চলতে থাকে তাদের কথার ট্রেন তারপর একদিন সুমন তার মায়ের সাথেও কথা বলিয়ে দেন স্বরুপকে , সুমনের মা ও সুমনের সাথে সুযোগ থাকলে কথা বলার অনুরোধ জানায়, তাতে না-কি তার লেখাপড়া ভালো হয়। স্বরূপ ও কথা দেন আচ্ছা আমি আপনার ছেলের সাথে কথা বলব।

একটা সময় পর স্বরূপ বুঝতে পারেন এটা শুধু কথা নয়, এ যেন জঘন্য ব্যথাও এক। প্রচণ্ড কাজের চাপের মধ্যে ও ঠুসঠাস ফোন করে বসে থাকে । আবার শুনতেও হয় বাধ্য হয়ে কবে কোন গেম ডাউনলোড করেছে। টম জেরি কার্টুনের গল্প।ফ্রি ফায়ারের পর্ব জ্ঞান! আরও কতো কী!

স্বরূপ পৃথিবীর সব বিরক্তি নিয়ে সুমনের কথাগুলো চুপ করে শোনে কিন্তু উত্তর দেয় না মাঝে মধ্যে হ্যা হু করে। এটাও আবার সুমন বলে, "আচ্ছা ভাইয়া, তুমি শুধু আমার কথা শোন কিন্তু তুমি কিছু বলো না কেন?" "বলব! আমি এখন অফিসে তো পড়ে বলব তোমায় কিছু।" তারপর ফোন কেটে একটা বিরক্তির দীর্ঘশ্বাস।

যতোদিন যায় ছেলেটার কথা তত বাড়তে থাকে, আজ কী দিয়ে খেয়েছো? তুমি কী বিয়ে করেছো ভাইয়া? আচ্ছা তোমার কতো বয়স?  তুমি বিয়ে করো না কেন? দিনে-দিনে সুমনের বিরক্ততা দ্বিগুণ হতেথাকে। সে এখন প্রতিদিন সাত/আটবার ফোন করে। একই কথা বার বার বলে, "তুমি ভালো আছো ভাইয়া, এখন কী করছো "?  

কথাটা একটা সময় বন্ধুমহল এবং অফিস স্টাফদের জানার বাকী থাকে না তারা মজা করে চোখ টিপে এবং পৌরুষ প্রেম! এজন্যই বিয়ে করে না শালা লেসবিয়ান সহ নানা কথা সহ হাসি ঠাট্টা করে। এই হাসির রঙ স্বরুপকে অতিমাত্রায় রঞ্জিত করে শব্দগুলো খুটখুট করে প্রবেশ করে তার কর্ণকুহরে।

বিষয়টি আর নিতে পারে না স্বরুপ কিন্তু ছেলেটাকে কিছু বলতেও পারে না । প্রতিরোধহীন এই যন্ত্রণায় মনে মনে খুব বিরক্ত হয় স্বরূপ আরেকদিন বিরক্ত হয়ে বলেই ফেলেন, " তুমি কী চাও ভাই, প্রতিদিন কেন এতো বিরক্ত করছো আমায়, তুমি আমাকে আর ফোন করবে না!"

সাথে সাথে ফোনের ও প্রান্তটা নীরব হয়ে যায় এবং লাইনটা কেটে যায়। তারপর তিনদিন অতিবাহিত হলেও , স্বরূপ প্রকৃত অর্থে তমনে কোন শান্তি পায় না। একটা অজানা বাতাস তার হৃদয়ে এসে অনন্ত জয়ের ধাক্কা দিয়ে যায়। সে ধাক্কা তার ভেতরে একধরনের অস্থিরতা তৈরি করে। একটা দ্বিধার দেয়াল তার সামনে বসে থাকে কুকুর হয়ে।

0 Shares

৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ