পোর্ট্রেট প্রেম

রোকসানা খন্দকার রুকু ১৭ এপ্রিল ২০২১, শনিবার, ০১:৩১:৪৭অপরাহ্ন গল্প ২২ মন্তব্য

পরিচিত কন্ঠস্বর! পেছন থেকে কেউ ডাকছে!

-ইশ্ কতক্ষন ধরে খেয়াল করছি। তোমার হাজবেন্ড ছিল বলে কথা বলিনি। কেমন আছো? কতবছর পর দেখা তাই না?

-এক নিমিষেই এতগুলি কথার উত্তর শুধু, হ্যাঁ ভালো আছি।

-তা তুমি কোথাও যাচ্ছো মনে হচ্ছে কিন্তু বাসে কেন?

-আমি তো তোমার মত বিত্তবান না যে গাড়িতে যাবো। সাধারন মাষ্টার তাই বাসেই যাই। আর হাজবেন্ড কোথায় পেলে?

-কেন? তোমার সাথে পাশের সিটে বসে ছিলেন তিনি। এখন মিষ্টি আনতে গেলেন বুঝি?

-ভীষন রাগ হল, পুরোনো রাগ। সবসময় দুই লাইন আগে আগে বল কেন? তাকে আমি চিনি না। সিট ফাঁকা ছিল তাই বসেছিলেন। আর সবাই তোমার মত ফেলে যায় না।

-ওকে, বাদ দাও ওসব। চল কোথাও বসি। চা- কফি খেতে খেতে গল্প করি। একেবারে হাত ধরে হিরহির করে টেনে নিয়ে গেল। এত অধিকার পায় কোথায়! বাঁধা দিতে মন চাইলো আবার ছাড়তেও ইচ্ছে করলো না। আমাকে না বলেই সিঙ্গারা ও রসমন্জুরীর অর্ডার দিল। সেই পুরোনো খাবার,আমি বহুকাল খাই না। সে খুব তারা দিল ভীষন মজা খাও,খাও।

-না, আমি শুধু চা নেব। আর জানতেও চাইল না। নিজে গপাগপ শেষ করতে লাগলো। পুরোনো রাক্ষস। শেষ না হতেই নিশ্চয়ই সিগারেট ধরাবে।

-তো বললে না এখানে কেন?

-এখানে ট্রান্সফার হয়েছে তাই জয়েন করতে। নীলফামারী সরকারী মহিলা কলেজ।

-ও তাই। গুড ভেরী গুড। কবে হল বিসিএস। তুমি তো প্রাইমারীতেই সেবার চান্স পেলে না।

-হুম। আমি তো তোমার মত ব্রিলিয়ান্ট না। তাই ঘসেমেজে পেয়েছি পেটের ভাত জোগাতে।

-আরে দুর! বাদ দাও। এখন তো সেটেল লাইফ। তা তোমার হাজব্যান্ড কি করেন।

-ব্যাংক এ, এডি।

-বাহ্ দারুন! তো দেখতে কেমন?

-কালো,লম্বা, হ্যাংলা, প্রচুর সিগারেট খায়, কথা কম বলে আর ভীষন অহংকারী।

-যাহ্! আমার সাথে মিলে যাচ্ছে দেখছি। তো কোন ব্যাংক।

-এটা না জানলেও চলবে তোমার।

আদনান জানালো বেড়াতে এসেছে। এখানে তার শশুরবাডি। মনে পড়ে গেল, শান্তাদের বাড়ি নীলফামারীতেই ছিল। সে অবশ্যই আমার বাসায় বেড়াতে আসবে। আমার হাজবেন্ডের সাথে পরিচিত হবে। এমন জানিয়ে বিদায় নিল।

আমার একটু আদিক্ষেতা মনে হল কারন আগে সে এত কথা বলত না। কিংবা যেচে কোথাও যাবার ব্যাপারটাও ছিল না। বয়সের সাথে সাথে হয়ত মানুষ কিছুটা বদলায়!

দশ বছর পর তার সাথে আমার দেখা। স্কুল, কলেজে আমরা একসাথেই ছিলাম। মেধাবী এবং অহংকারী ছেলেটি কলেজে উঠেই আমার প্রেমে হাবুডুবু খেল। আমি পারিবারিক জটিলতার জন্য তাকে কিছুই বলতে পারলাম না। কিন্তু আমাদের একে অপরের পছন্দের বিষয়টি স্পস্টই ছিল।

আমার ভার্সিটিতে হল না ন্যাশনাল ভার্সিটিতে হল। এ নিয়ে আদনানের আফসোস আর গজর গজর চলতেই থাকলো। আমি কখোনোই সিরিয়াসলি পড়াশুনা করি না কেন? তার বউ ভার্সিটি পড়ুয়া হবে না এটা হয়। এসবের পরে আসলে অন্য উদ্দেশ্যই মূখ্য ছিল। দুজনে চাকরী করব।তার অনেক টাকা, বাড়ি-গাড়ি দরকার।

সে চলে গেল চিটাগাং ভার্সিটি। ছুটির সময়গুলোতে দেখা করতে আসত। আমাদের পারিবারিক অভাব- অনটনের জন্য পড়ার খরচ যোগাতে আমাকে কয়েকটা টিউশনির ব্যবস্থা করতে হল। তাতে পডাশুনায় ব্যাপক ঘাটতি পরে গেল। আদনান সবসময় আমাকে নিয়ে হতাশ বোধ করত। আমি তাকে সব বিষয় বুঝিয়ে বলতেও পারতাম না কিংবা ইচ্ছেও করত না।

মাঝে মাঝেই টিউশনি থেকে ফিরে দেখতাম সে বসে আছে। অবশ্য একা না আমার ইয়ারমেট শান্তা তাকে সঙ্গ দিত। আমি কৃতজ্ঞ হতাম। স্বল্পভাষী মানুষটা সে সময় বেশ হাসিখুশিই থাকতো। আমাদের মাঝে হাবুডুবু ব্যাপারটা খুব কম ছিল। আমি জমিয়ে উঠতে পারতাম না। বারবার মনে হত আদনান আমার চোখে অন্য কাউকে খুঁজছে।

বাপ্পার মজুমদার তার পছন্দ। যখন আসতো আমার হাতে ক্যাসেট ধরিয়ে বিকেলে সিঙ্গারা-রসমন্জুরী খেয়ে সেই বসাতেই সিগারেট টানতো। কিসের টেনশান তার? পুকুর পাড়ে কিংবা সামান্য আড়ালে টপাটপ চুমুর বিষয়টিও সেরে ফেলত। কিন্তু তাতেও ভীষন তাড়া। আবেগের কমতি ছিল, আমি ভাবতাম তার তাড়া  কিসের?

শান্তা আমার ইয়ারমেট, সুন্দরী এবং মেধাবীও বটে। প্রায়ই টপাটপ উত্তর দিয়ে দিত সবকিছুর। আদনান ভীষন খুশি হয়ে হাততালি দিত। আমার এ নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা ছিল না। কে, কার জন্য কত খুশি তা নিয়ে মাথা ঘামাতে মন চাইত না।

পড়াশুনা শেষের দিকে আমি কিছুতেই চাকুরীতে সেটেল হতে পারছিলাম না। প্রাইমারী পরীক্ষাগুলোতেও হল না। আদনান আমায় কিছুটা এডিয়ে চলতে শুরু করল।

অপেক্ষা মধুর হলেও সবসময় হয় না। আমিও তাকে অপেক্ষা করতে বলিনি।

এদিকে শান্তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল। আদনান আমায় বলল সে সেটেল হতে চায়। বাঁধা দেবার কি আমি কেউ ছিলাম? আর আমি যদি তার মনমতো হতে না পারি তাহলে শুধু শুধু কেন অপেক্ষা? শান্তার জন্য তার টান ঢের আর শান্তাও অডিটরে জয়েন করেছে। আদনান তো অলরেডি ব্যাংক জয়েন করে ফেলেছে। তাই শুভ দিনে তারা বিয়ে করে ফেলল।

আমার মাথায় তখন কেবল চাকরীর চিন্তা। মাকে দেখতে হবে , বাবা অসুস্থ। বিয়ে জীবনের সব নয়!

এক বিকেলে আদনান এল আমার বাসায়। ঘুরে ঘুরে দেখছিল সব। আমার বাসায় দেখার মত তেমন কিছুই নেই এক লাইব্রেরী ছাড়া। সে একটু অবাক হল, আমার বই এর কালেকশান দেখে। বাহ্! তুমি তো বেশ পডুয়া হয়েছ? নাকি এমনি কিনে সাজিয়েছ?

আমাকে ছোট করার স্বভাব তার গেল না। বলতে মন চাইল- বড়লোকদের অভাব বুঝতে সময় লাগে। পড়ার শখ থাকলেও আমার মত সাধারন পরিবারের মানুষ মেধা, মনন, সৃজন কোনটারই বিকাশ করতে পারে না। পডুয়া ছিলাম না সময়ের অভাবে।

সব দেখেটেখে সে ব্যস্ত হল তার সাথে মিলে যাওয়া মানুষটির  সাথে পরিচিত হতে। কোথাও কোন চিন্হ কিংবা বিয়ের ছবি না দেখে সে একটু হতাশ।

-তুমি এখনও সেই আনরোমান্টিকই আছো। লাইফে তোমার তো কমতি নেই। নিজেকে ঢেলে সাজাবে। বাড়ি- ঘর সাজিয়ে জীবন এনজয় করবে। এসব কি সেকেলে। পুরো বাড়িতে তোমাদের কোন ছবি নেই। নাকি হাজবেন্ডের সাথে প্রেম নেই?

হাসি ছাড়া তাকে দেবার কিছু ছিল না। জীবনের অপূর্ণতার অর্থ সে বুঝবে কি? যার কাছে বৈষয়িক বিষয় অতি মূখ্য, বাহ্যিক স্ট্যাটাস যার সব কিছু তাকে বলেও লাভ নেই।

আমার হাজবেন্ডকে না পেয়ে সে কেমন সন্দিহান হয়ে উঠলো। আমিও আর না জ্বালিয়ে অবশেষে নিয়ে গেলাম আমার সেই ছোট্ট রুমটিতে, যেখানে অবসরে দীর্ঘ সময় কাটাই নিজের মত।দেয়ালে শোভিত বিরাট বড় পোর্টেট, তাতে আমি আর আমার হাজবেন্ড।

অনেকক্ষন আদনান ছবির দিকে তাকিয়ে। হিংসে হচ্ছে নাকি? হঠাৎ অঝোরে কেঁদে ফেলল। পুরুষ মানুষের কান্না খুব বিশ্রী হয়। আমি তবুও তাকে থামালাম না। মনের ভেতর কিছু জমে থাকলে কমে যাবে। হঠাৎ আমায় জডিয়ে ধরে আকুল হলো। পুরোনো গায়ের গন্ধ আর স্পর্শে আমিও অসহায় বোধ করলাম। সে কি অপরাধী হয়ে কাঁদছে? নাকি শান্তার চেয়ে আমার পজিশান ভালো তাই আফসোসে কাঁদছে। রাগে তাকে সরিয়ে দিলাম।

আমার কাছে সে অনেক ক্ষমা চাইল। দশ বছর আগে আমি যে মানুষটাকে ভালোবেসেছি আজও সেই-ই আমার স্বামী। সারাজীবন থাকবে। কোন এক বৈশাখে আমি আর আদনান সাদা শাড়ী লাল পান্জাবীতে ছবি তুলেছিলাম। আমার মাথায় ঘোমটা, পায়ে আলতা, হাসিমুখ শুধু তার দিকে। পরে আমি সেটিই আঁকিয়ে নিয়েছি। কতগুলো বছরের সংসার আমাদের। আমার ঠোঁটে এখনো তার সিগারেটের গন্ধ। পহেলা বৈশাখ আমার ম্যারেজ এনিভারসেরী। আজও সেই দিন। কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছে না। আমি তার সাথে একা একাই প্রেম প্রেম খেলব। এটা হয়ত সে যেন মেনে নিতে পারছে না। তাই হেরে গিয়ে এখন কাঁদছে।

অথচ আমি কোনদিন তাকে ওভাবে বলিনি তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি শান্তার মত রুপবতী মেধাবী না কিন্তু তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসব! ভালোবাসা বুঝতেই যদি না পারো তাহলে চোখে চোখ রাখো কেন?

আদনান চলে যাবার পর পুরোনো বুক ব্যাথাটা মাথা চাডা দিল। পরিচিত খোঁচায় বুকের বা পাশটায় চিনচিনে অনুভূত হল। প্রেম কি এটাই? বাপ্পার গান এখন আর ভালোলাগে না। আমার সেই ঘরে গান বাজতে থাকলো-

“ তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মনরে আমার

তাই জনম গেল শান্তি পেলি না রে মন মনরে আমার,,,,,”

ছবি- নেট

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ