পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে…
প্রায় আড়াই যুগ আগের কথা। তখন কক্সবাজারসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাস ছাড়ত নিউমার্কেট এলাকা থেকে। চট্টগ্রাম শহরের জলসা সিনেমার (সিনেমা হলটি বর্তমানে নেই) মোড় থেকে আমতল পর্যন্ত বাসের দীর্ঘ সারি থাকত। জলসা সিনেমার উত্তর পাশে বেড়ার তৈরী ছোট ছোট টুকরী দোকানসমূহ নিয়ে হকার মার্কেট ছিল।
বিড়াল যেমন ছা নাড়ে বার বার, আমাদের দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাস ষ্টেশনও চট্টগ্রাম শহরে বার বার নড়েছে । কখনও আন্দরকিল্লা সিটি কর্পোরেশন অফিসের সামনে কখনও প্যারেড মাঠের পূর্ব পাশে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোডে, কখনও খুরশিদ মহলের সামনে থেকে, কখনও বহদ্দারহাট মসজিদের পশ্চিমে রওশন বোর্ডিং বরাবর ছিল। বর্তমানে এই স্টেশন বহদ্দার হাট বাসটার্মিনাল এবং কর্ণফুলী হযরত শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন এলাকায়। যাই হোক বাস স্টেশন যখন জলসা সিনেমার সামনে ছিল সে সময়ের কথা বলছি।
একদিন সাতকানিয়া থেকে শহরে এসে কাজ শেষে বাসে করে ফিরে যাচ্ছিলাম গ্রামে। বাস নিউ মার্কেটের পাশে জলসা সিনেমার পাশ থেকে ছেড়ে জুবলী রোড হয়ে আলমাস সিনেমার সামনে দিয়ে ওয়াসার মোড়ে বের হত। আমাদের গাড়ি যখন কাজির দেওরি চার রাস্তার মোড় পার হচ্ছিল তখন রাস্তার বামে পশ্চিম পাশে যে অংশে সার্কিট হাউস আছে সেই অংশে কোণাকোণি বিশাল এক সাইন বোর্ড ছিল। দেখলাম সাইন বোর্ডের মধ্যখানে একটি ছবি, ছবির উপরে অথবা নীচে সুন্দর অক্ষরে লেখা ছিল ‘‘পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে’’!
ছবির সাথে সাইনবোর্ডে লিখিত কথার এতই অপূর্ব মিল ছিল যে ছবি দেখার পর লিখাটা পড়ে আমার কঁচি মনে চিৎকুর করে একটি কামড় দিয়ে বসল। আমি প্রচন্ড শক্ খেলাম!
সাইন বোর্ডের ছবিতে মধ্যখানে পৃথিবীর গোলাকার অবয়ব গ্লোব অংকিত ছিল। সেই অংকিত গ্লোবাল বিশ্বকে বেষ্টন করে ছিল একটি লম্বা বিশাল আকৃতির সাপ। সাপটি পৃথিবীকে চারিদিকে বেষ্টন করে নিজের হা করা মুখের ভিতর নিজের লেজটিকেই খেয়ে ফেলছিল।
দৃশ্যপটের ফলাফলটি এমন ছিল যে সাপটি লেজের অংশ থেকে যতই গ্রাস করছিল পৃথিবী যেন ততই ছোট হয়ে আসছে। এটা বুঝতে পেরেই আমার কলিজায় চিৎকুর করে কেউ যেন কামড় দিয়েছিল। আমার স্বার্থপর অবুঝ মনটা এই চিন্তায় অস্থির হচ্ছিল যে আমি বড় হয়ে পৃথিবীতে বসবাস করার জায়গা পাবো তো? আমি বড় হয়ে বিয়ে-শাদী করে সন্তানাদী নিয়ে কোথায় থাকবো যদি পৃথিবী এভাবে ছোট হয়ে যায়?
এর প্রায় দশ বছর পর অবশ্য পৃথিবী ছোট হবার রহস্য কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়েছিল।
মুরব্বীদের কাছে শুনেছি যোগাযোগের মাধ্যম গাড়ি যখন রাস্তায় নামেনি তখন পায়ে হেটে বা নদীতে নৌকায় চড়ে দুর পাল্লার পথ পাড়ি দিতে হত। চট্টগ্রাম শহরে যাবার জন্য সকালে কলাপাতার মোড়কে ভাতের মৌচা নিয়ে বের হয়ে সন্ধ্যা নাগাদ ৪০ মাইল দূরে শহরে গিয়ে পৌছত। গাড়ি বের হওয়ার পর যখন ঐ একই দূরত্ব ৩ ঘন্টা সাড়ে ৩ ঘন্টায় পৌছা যেত তখন বুঝতে পেরেছিলাম পৃথিবী ছোট হবার রহস্য।
আমাদের এলাকার একজন আলাউদ্দীন চাচা ছিলেন স্বচ্ছল কৃষক। সেবার বন্যার প্লাবনে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হওয়ায় দারিদ্রের কষাঘাতে দেশে টিকতে না পেরে হেটে হেটে সৌদিআরব যাওয়ার জন্য রওয়ানা হয়েছিলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সফলও হয়েছিলেন, তবে হেটে হেটে সৌদি আরব যেতে সময় লেগেছিল ৬ মাস। পরে ঐ আলাউদ্দীন হাজি পরিবারের সবাইকে সৌদিআরব নিয়ে গিয়েছিলেন। এখনও উনার ছেলেরা সৌদি আরব থাকেন।
সেই ৬ মাসের পথ সৌদিআরব এখন বিমানে ৬ ঘন্টায় যাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি পৃথিবী ছোট হচ্ছে না ? তখন দেখেছি বিদেশ থেকে একটি চিঠি আসতে ১৫ থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত সময় লেগেছে। আর এখন? চিঠির ডিজিটাল রূপ এসএমএস, এমএমএস আদান-প্রদান হচ্ছে চোখের পলকে। এসএমএস তো দূর ছাই, ভিডিও কল সব দূরত্বের পর্দা নিমিষে দূর করে দিয়েছে। উঠোনের মাটিতে ছোট ছোট মেয়েছেলেরা খেলা করলে মায়েরা ঘর থেকেই তাদেরকে নজরে রাখে। আর বর্তমানে সন্তান বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন সন্তানের সাথে সরাসরি চোখে চোখ রেখে কথা বলা যাচ্ছে। সিনেমা হল চলে এসেছে হাতের মুঠোর ভিতর। পৃথিবীর সেরা সেরা লাইব্রেরীর সমস্ত বই চলে এসেছে চোখের সামনে। পৃথিবী কতো ছোট হয়ে গেল!
আল্লাহর দেয়া বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান আমরা ব্যবহার করছি আল্লাহকে ভুলে যাওযার পন্থা হিসেবে। আমার আল্লাহ রহমানুর রহীম তাঁর সৃষ্ট পৃথিবীকে ছোট করে আমার বসবাসের স্থানকে সংকোচিত করেননি। বরঞ্চ পৃথিবীর স্বল্প সময়ের হায়াতে জীবনকে যেন পরিপূর্ণ রূপে উপভোগ করা যায় তার ব্যবস্থা করেছেন। মানুষের জীবন-যাত্রা উন্নয়নের ধাপগুলোকে সুপারনোভা গতিতে ডেভেলপ করে দিয়েছেন। আর আমরা মানুষেরা আল্লাহর না শোকরি তো করছিই শুধু নয়, আল্লাহর সিফাতের সাথে কাউন্টার হয়ে দাঁড়াবার সাহস দেখাচ্ছি!
আমাদের আত্বীয়-বন্ধু-পরিজনের পাঠানো এসএমএস সমূহ আমরা গুরুত্বের সহিত ঠিকই রিপ্লাই করি। কিন্তু আল্লাহপাকের পাঠানো হাজার হাজার এসএমএস (আসমানী মেসেজ) আমরা রিপ্লাই তো দুরের কথা বুঝে পড়াটাও কর্তব্য মনে করি না।
সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে পাঠানো সেই এসএমএস সমূহ কিছু কিছু লোক অনর্গল পাঠকরে গেলেও বুঝে পাঠ করার লোক খুবই নগন্য। এ অবস্থায় বুঝতে পারছি না পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে নাকি আমাদের মন-মানসিকতা ছোট হয়ে আসছে। নাকি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপলদ্ধি ছোট হয়ে আসছে?
মানুষ শব্দের অর্থ কি? যতদুর জেনেছি মানসম্মত হুস যার তিনিই মানুষ। তাই যদি হয় আমাদের হুস কি মানসম্মত আছে ?
মূল্যায়নের ভার আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।
২৫টি মন্তব্য
সুরাইয়া পারভিন
অদ্ভুত এক ধাক্কা এসে সজোরে আঘাত করলো হৃদয়ে। কাঁপিয়ে তুললো সমস্ত অস্তিত্ব। সত্যিই তো যাঁর করুনায় এতো সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি তাঁকে কি মনে রেখেছি? তাঁর প্রাপ্যটুকু কী দিচ্ছি?না ,,,সে সময় কো
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অথচ আপনি যদি কিছু আসমানি এসএমএস(মেসেজ) বুঝে পড়েন, এর ব্যাখ্যার জন্য কয়েকটি তাফসির ঘাটাঘাটি করেন আপনি অভিভূত হয়ে যাবেন।
এখান থেকে আহরণ করার অনেক কিছু আছে। কোরআনে আল্লাহর যে ভাষা শৈলি তা অসাধারণ!
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
সুরাইয়া পারভিন
সে সময় কোথায়,,, অকৃতজ্ঞ আমরা কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। দুর্ভাগ্য আমাদের।
চমৎকার উপস্থাপন করেছেন
চাটিগাঁ থেকে বাহার
দূর্ভাগ্যকে জয় করে ভাগ্যবানে পরিণত হতে হবে। প্রতিটি মূহুর্ত পজেটিভ সেন্সে সেন্ড করতে হবে।
হালিম নজরুল
পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে,মানুষ আরও ছোট হয়ে আসছে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
মানুষের মন ছোট হয়ে আসছে।
আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান, গরিমা, বুদ্ধি এতো দিয়েছেন যে পৃথিবীকে ছোট করে হাতের মুষ্টিতে আবদ্ধ করেছেন অথচ কিছু মানুষের মন দিনকে দিন সংকীর্ণ হয়ে হয়ে হিংসা আরও স্বার্থপরতায় কলুসিত হচ্ছে।
পড়ে মন্তব্য করার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
ছাইরাছ হেলাল
আসমানি মেসেজ না বুঝে না বাস্তবায়ন করে শুধু মুখে আওড়ালেই এপারে ওপারে
সব প্রাপ্তির নিশ্চয়তা! তখন আর এত্ত চিন্তার কী আছে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
“আসমানি মেসেজ না বুঝে না বাস্তবায়ন করে শুধু মুখে আওড়ালেই এপারে ওপারে
সব প্রাপ্তির নিশ্চয়তা!”
……………………
এ আপনি কী শুনাইলেন ছাইরাছ হেলাল ভাই!
এমন যাদুকরী কথা তো আরও শুনিনি ভাই!!
রাফি আরাফাত
আসলেই আসলেই আসলেই। আমরাও ছোট হয়ে আসছি। কাল্পনিক ছোট। ভালো লাগলো।
ধধন্যবাদ
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর মন্তব্যের জন্য প্লাবিত ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
শামীম চৌধুরী
The world is becoming smaller to us.
চাটিগাঁ থেকে বাহার
পৃথিবী আসতে আসতে আমাদের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে বাট আমরা হয়ে যাচ্ছি দিন দিন সংকীর্ণমনা!
মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। শুভ কামনা।
সাবিনা ইয়াসমিন
পৃথিবী ছোট হয়ে আসার তাহলে এই রহস্য ছিলো!
আসমানি মেসেজগুলো আমরা পড়ি ঠিকই, কিন্ত বুঝে-শুনে রিপ্লাই দেয়ার তৌফিক আসমান-জমিনের মালিক সবাইকে দেননি। আবার অকৃতজ্ঞ দের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তবুও দোয়া রাখি তিনি যেনো আমাদের হেদায়েত সহ কৃতজ্ঞদের সাথে কবুল করে নেন। আমিন।
শুভ কামনা বাহার ভাই। 🌹🌹
চাটিগাঁ থেকে বাহার
‘ বুঝে-শুনে রিপ্লাই দেয়ার তৌফিক আসমান-জমিনের মালিক সবাইকে দেননি। ‘
…….
আমার মনে হয়ে আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে চাইলে সবকিছু পাওয়া যায়।
আমরা সেভাবে চাইনা বলে পাইনা। আমরা দুনিয়ার প্রতি বড়ো বেশী লোভাতুর হয়ে পড়েছি।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।
শুভ কামনা।
এস.জেড বাবু
সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে পাঠানো সেই এসএমএস সমূহ কিছু কিছু লোক অনর্গল পাঠকরে গেলেও বুঝে পাঠ করার লোক খুবই নগন্য।
“বুঝে পাঠ করার লোক সত্যি নগন্য।”
সুন্দর উপস্থাপনা। সকলের সুমতি হউক।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সকলের সুমতি হউক!
আমিন!
ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
জ্ঞান, বুদ্ধি দিয়ে আমরা অনবরত জয় করেছি বিশ্ব পৃঘিবীতো ছোট হবেই।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
পৃথিবী ছোট হতে হতে এখন মানুষের হাতের মুটোই।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
আরজু মুক্তা
পৃথিবী
মনির হোসেন মমি
শুরুতেই গলদ তাই আমরাও গলদের ভিতরেই বেচে আছি মাত্র।এ যুগে যাদের হাতে আছে এ সব কিতাব তারাও মনে হয় না ঠিক মত বুঝেন ।। নতুবা আমরা এক আল্লাহর একই বাণী প্রচার বা পালন করতাম। সিয়া সুন্নী বলে কিছু থাকতো না। একদল(আইএসআই এর মত) আসমানী কিতাব পড়ে মনে করে মানুষ মারাই বুঝি ধর্ম আরেক দল(সাঃ হুজুর) মনে করেন চুপ থাকাটাই মনে হয় বেটার ধর্মে।
লেখা নিয়ে অনেক কিছুই বলা। অভারঅল লেখা খুব ভাল লাগল।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ভাইজান গলদের ভিতর থাকার কী দরকার!মাতৃভাষায় যেখানে সবকিছু বুঝে পড়া ও জানা যাচ্ছে সেখানে অমুক তমুকের হেল্প নেবার দরকার আছে কি?
শাহরিন
আমিও লেখার শিরোনাম দেখে ভয়ে ভয়ে পড়া শুরু করেছিলাম। আব্বা আগে চিঠি পাঠালে ১০/১২ দিন পরে পেতাম আর এখন দু তিন বার ভিডিও কলে কথা হয়। সবই আল্লাহ তালার দয়া। চট্রগ্রাম সম্বন্ধেও জানলাম আপনার মাধ্যমে। আপনারা লেখেন বলে এইসব জানার সুযোগ হয়। ধন্যবাদ।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর মন্তব্যের জন্যে আন্তরিক ধন্যবাদ।
উৎসাহিত হলাম।
শুভ কামনা।
মোহাম্মদ দিদার
সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে পাঠানো সেই এসএমএস সমূহ কিছু কিছু লোক অনর্গল পাঠকরে গেলেও বুঝে পাঠ করার লোক খুবই নগন্য। এ অবস্থায় বুঝতে পারছি না পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে নাকি আমাদের মন-মানসিকতা ছোট হয়ে আসছে। নাকি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপলদ্ধি ছোট হয়ে আসছে?
আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উপলব্দি ই দিনে দিনে ছোট হয়ে আসছে।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
শুভ কামনা।