পূজোর স্মৃতি রোমন্থন

সুপর্ণা ফাল্গুনী ৭ মে ২০২০, বৃহস্পতিবার, ১২:৫০:০২পূর্বাহ্ন স্মৃতিকথা ২৯ মন্তব্য

বাবার চাকরি সূত্রে শিশুকাল থেকেই শহরেই থাকা। বছরে হয়তো এক দুবার বাড়িতে যেতে হতো । তবে এখানেও যৌথপরিবারেই থেকেছি। বাবার বাড়ির লোকজন , মামা বাড়ির লোকজন ও এখানেই থাকতো । সবাই মিলে যখন লঞ্চে বাড়িতে যেতাম তখন এমনিতেই উৎসব উৎসব ভাব হয়ে যেত। এখানে বলে রাখা ভালো তখন লঞ্চ ছাড়া আমাদের বাড়িতে যাবার অন্য কোন উপায় ছিলো না। তখনকার সময়ে খুলনা বিভাগের পিরোজপুরে আমাদের বাড়ি ছিল এখন সেটা বরিশাল বিভাগে পড়েছে। তখন বড় কোনো অনুষ্ঠান হলে খুলনায় যেতে হতো বাজার করতে। তাও সেই লঞ্চে। একদিন লেগে যেতো পৌঁছাতে। আর ঢাকা আসতেও একদিন লেগে যেতো। আমরা যেহেতু ঢাকায় থাকি তাই দু'বাড়ির সব কেনাকাটা তো ছিলোই , সেই সাথে আত্নীয়-স্বজনদের সহ গ্রামের অন্যদের জন্য ও কিছু না কিছু কিনতে হতো। তো যখনি বাড়িতে যেতাম খুব বেশি লাগেজ হতো । একেক জনের হাতে কমপক্ষে দুই/তিনটা ভারী লাগেজ থাকতো। কোনো অনুষ্ঠান ছাড়াই এমন অবস্থা হতো যে সেই খরচ দিয়ে ঢাকায় দু'মাসের খরচ চলে যেতো। তাই পূজা-পার্বনে খুব কম যাওয়া হতো । সবার কাপড়-চোপড় দিয়ে দেয়া হতো কিন্তু বাড়িতে গেলে দু 'বাড়ির বাজারের খরচটাও আমার বাবাকে দিতে হতো।

ঢাকায় থাকতাম বলে সবার চাহিদা থাকতো আকাশচুম্বী কিন্তু বাবার ছিলো সীমিত আয়ের চাকরি। ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও আমাদের চলতে হতো খুব হিসাব করে। ঢাকার খরচ, দু ' বাড়ির খরচ মিলিয়ে খুব হিমশিম খেতে হতো আমার বাবা-মাকে। তখন তো কেনাকাটা হতো পূজো আর পহেলা বৈশাখে। আমার বাবা খুব সরল বলে আর কাউকে কিছু বলতে পারতোনা বলে সারাজীবন কলুর বলদ হয়েই খেটে গেছে। সবার আবদার পূরণ করতে গিয়ে আমাদের দুবোনের শখ আহ্লাদ তেমন মেটাতে পারেনি। অথচ বাবা-মা চাইলেই আমরা রাজকীয় হালে থাকতে পারতাম। ঢাকাতে পূজোর আনন্দ তেমন না হলেও চেষ্টা করতাম পাঁচদিনের প্রতিটা দিন পূজো মন্ডপে যাবার জন্য। দূর্গাপূজো, বৈশাখ, বইমেলা উপলক্ষে যে মেলা হতো সেগুলোই ছিল তখনকার সময়ে আমাদের তথা পুরো ঢাকার উৎসবের আমেজ। ঈদমেলা হলেও এই তিন মেলাতেই বেশী জমজমাট হতো। সেই মেলাগুলোকে আজো খুব মিস করি। মেলা থেকে মাটির তৈজসপত্র, খেলনা এগুলোই বেশী কেনা হতো। তখন ঢাকায় এতো শপিং মল ছিলোনা , সৌখিন জিনিস গুলো এসব মেলা থেকেই বেশী কেনা হতো। আর তখন প্লাস্টিকের পলিব্যাগ ছাড়া প্লাস্টিকের তেমন কিছুই ছিলোনা‌ । পূজোতে মেলা থেকে গজা, বাতাসা, মন্ডা আর হাওয়াই মিঠাই এগুলো ছাড়া পূজোর মজা যেন অসম্পূর্ণই থেকে যেতো। এইছিলো ঢাকায় পূজোর স্মৃতি।

আর এবার আসি বাড়ির পূজোর স্মৃতির মেলায়। বাড়ির দু' একটা পূজোর কথা খুব বেশী মনে পড়ে যেহেতু তেমন যাওয়া হতো না। তখন গ্রামের পূজোতে যাত্রাপালা, সার্কাস থাকতোই। যেহেতু আমাদের বাড়ির কাছেই স্কুল ছিলো , বাড়ির কাছে বলতে আমাদের জমির সাথেই তাই যাত্রা বা সার্কাস এর লোকজন দেখতে আমরা সবাই আগেই গিয়ে দেখে আসতাম। যাত্রার শিল্পীদের তখন আকাশের তারা মনে হতো। সার্কাসে আসা সিংহ, হাতি, বাঘ ও দেখতাম আগে ভাগেই। তবে সাপ দেখতে পারতাম না আমি। ছোটবেলা থেকেই সাপ, কেঁচো, বিছার ছবি দেখলেও ভয় পেতাম খুব এমনকি টিভিতে দেখানোর সময় ও চোখ বন্ধ করে রাখি- এখনও। উফ্ তখন তো এসব ই ছিলো বিশাল ব্যাপার। গ্রামের লোকজনের উৎসাহ উদ্দীপনা সব এসবকে ঘিরেই ছিলো।

তো একদিন দুপুরে খাওয়া দাওয়া করেই এসব তারাদের দেখতে গেলাম বাড়ির মেয়েরা, কাজিনদের সাথে নিয়ে। সেদিন আমি পড়েছিলাম লাল রঙের একটি ড্রেস। তো সার্কাসের প্যান্ডেল থেকে আমাদের বাড়িতে আসতে পাঁচ থেকে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগতো। তো সম্ভবত সার্কাস দলের সাথে আসা একটি কুকুর আমাদের পিছন নিলো। রাস্তার পাশেই একটি ছোট্ট ডোবার মতো ছিলো। কুকুরটি ডোবার ওপাশে চলে গেলো তাই ভাবলাম ও আর আমাদের ধরতে পারবে না। আমরা ছোটরা দৌড়াতে ছিলাম বলে এগিয়ে ছিলাম আর বড়রা গল্পে মশগুল হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে ছিলো। তবুও তারা ঐটুকু পথ সাবধানে নিয়েই আসতে ছিলো কারন আমরা দুবোন ঢাকার, আরো কয়েকজন ছিলো মফস্বলের তাই গ্রামের মেঠোপথের সাথে আমরা অভ্যস্ত নই। তার আগে কিছুটা বৃষ্টি ও হয়েছিল তাই রাস্তা অনেকটা পিচ্ছিল ছিলো। তো ভাবলাম কুকুর টা সেই কর্দমাক্ত রাস্তা পেরিয়ে আমাদের ধরতে পারবে না। কিন্তু কুকুর টা অবাক করে দিয়ে ঠিক আমার হাঁটুতেই এসে কামড় লাগালো । তবে বড়রা পিছনে ছিলো বলেই তাদের তাড়া খেয়ে কুকুর টা ভয়ে বেশী জোরে কামড় দিতে পারেনি। শুধু দাঁতের দাগ পড়েছিল। উফ্ সেইদিনের কথা মনে পড়লে আজো গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। তখন আমার বয়স ছিলো আট/দশ তবুও এখনো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে সে-ই দিনটা। এই ছিল আমার ভয়ের , মজার, আনন্দের পূজোর স্মৃতি রোমন্থন। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ