কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরসহ টেকনাফ, মহেশখালী ও উখিয়ায় ১৩ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বুধবার (২৮ জুলাই’২১) ভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড় ধস, পানিতে ভেসে গিয়ে, ডুবে ও দেয়াল চাপায় এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। গত দুদিনে পৃথক ঘটনায় ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে টেকনাফে ৫ জন, মহেশখালীতে ১ জন, বালুখালীতে ১ জন ও উখিয়ায় ৩ নিহত হয়েছেন। এছাড়াও নবগঠিত কক্সবাজারের নতুন উপজেলা ঈদগাঁওয়ে ঢলের পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে একই পরিবারের দুই সহোদরসহ ৩ কিশোর নিখোঁজ হয়। পরে দমকল বাহিনী ও স্থানীয়দের সহায়তায় তিনজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ( সূত্রঃ দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৯ জুলাই’২১)। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, টানা ভারী বর্ষণে কক্সবাজার জেলার ৯টি উপজেলার অন্তত শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। লঘুচাপের কারণে সাগরে জোয়ারের পানি ৩ থেকে ৪ সেন্টিমিটার উচ্চতায় প্রবাহিত হচ্ছে। গেল ২৪ ঘণ্টায় ১১৭ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। পাশাপাশি “একটানা ভারী বৃষ্টির ফলে পৃথক পাহাড় ধসে কক্সবাজার জেলার উখিয়া, টেকনাফ ও মহেশখালীতে ৫ রোহিঙ্গাসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে মঙ্গলবার (২৭ জুলাই) সকাল ১০টার দিকে উখিয়ার কুতুপালং ইউনিয়নের পানবাজারের এফডিএমএন ক্যাম্প-১০ এর পাহাড় ধসে দুই পরিবারের ৩ শিশুসহ ৫ জন মারা যায়। মৃতরা হলেন এফডিএমএন ক্যাম্প-১০ এর ব্লক- জি/৩৮ এর ইউসুফের স্ত্রী দিল বাহার (২৫) তার আড়াই বছরের ছেলে আবদুর রহমা, ১ বছরের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা। এছাড়া এফডিএমএন ক্যাম্প-১০ এর ব্লক- জি/৩৭ এর শাহা আলমের স্ত্রী দিল বাহার (৪২) ও তার ছেলে শফিউল আলম (৯) পাহাড় ধসে মারা গেছে। ওই পরিবারের আহতরা হলেন শাহালমের মেয়ে নুর ফাতেমা (১৪) ও জানে আলম (৮)। এ বিষয়ে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ান (এপিবিএন) ৮ এর অধিনায়ক শিহাব খান বলেন, হতাহতদের উদ্ধার করা হয়েছে। (সূত্রঃ দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, ২৮  জুলাই’২১)। পাশাপাশি টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যংয়ের মনিরঘোনায় রকিম আলী (৫৫) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। গত ২৭ জুলাই’২১ সকাল ১১টার দিকে বাড়ির উঠোনে বসে গল্প করার সময় পাহাড় ধসে তার মৃত্যু হয়।  অন্যদিকে পাহাড় ধসে মহেশখালীতে মোরশেদা বেগম (১৭) নামের এক তরুণীর মৃত্যু হয়েছে। ২৭ জুলাই’২১ ভোর রাতে উপজেলার ছোট মহেশখালীর ইউনিয়নের উত্তর সিপাহি পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। এর আগে গত ১৮ জুন’২১ শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। টানা বৃষ্টিতে নগরীর অনেক এলাকায় পানি জমে যায়। রাতভর টানা বৃষ্টিতে সকাল সাড়ে ৯টায় নগরীর আকবরশাহ থানার ইস্পাহানি ১ নম্বর গেট এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

অতি বৃষ্টি, টানা বৃষ্টি এবং ভারী বর্ষণ মানেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাহাড় ধস। ফলে এতে প্রাণ যাচ্ছে বহু গরীব দুঃখী অসহায় এবং নিম্ন আয়ের মানুষের। এতদসত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় কাটা। বন্ধ হচ্ছে না পাহাড় দখল এবং দুঃখজনকভাবে পাহাড় পাদদেশে অস্থায়ী এবং অবৈধ বসবাস। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের চোখের সামনেই উজাড় হচ্ছে পাহাড় পর্বত। অবৈধ দখলের মাধ্যমে বা অন্যায়ভাবে গড়ে উঠছে বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প। পাহাড় কাটা এবং দখলে ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি পরিবেশ প্রতিবেশ। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দেশের বিরল জীব-বৈচিত্র্য। প্রায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আসার আগে থেকে বা আসার সময় পাহড় পাদদেশে অবৈধ দখলদার মুক্ত করার কাজ শুরু হয়ে থাকে। যেমন গত ০৬ জুন’২১ বর্ষা শুরু হওয়ার আগে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় পাদদেশে অবস্থানরত অবৈধ বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয় হয়।  জানা যায়, প্রায় দশ লাখ মানুষ চট্টগ্রামের ৩০ টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পাদদেশে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। চট্টগ্রামে ২০০৭ সালে মর্মান্তিক মর্মদুদ পাহাড় ধ্বসের ঘটনা ঘটে যেখানে একদিনে ১২৭ জনসহ সর্বমোট ১৩০ জন জনের প্রাণহানী ঘটে। তারপর থেকেই প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় পাদদেশে বসবাসরতদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় স্থানীয় প্রশাসন কিন্ত অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় কয়েক ঘণ্টার বা কয়েক দিনের ব্যবধানে বসবাসকারীরা আবার যথাস্থানে ফেরত আসে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অসহায় ছিন্নমূল ও নদী ভাঙ্গনে বাস্তুহারা মানুষ জীবনের ঝুঁকি সত্বেও পাহাড় পাদদেশে বসবাস করতে চলে আসে।  মূলত অবৈধ দখলবাজরা এসব গরীব অসহায় মানুষদের কাছে ভাড়া দিয়ে থাকে। কম ভাড়া হওয়ায় এসব মানুষ জীবনের মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এসব মৃত্যুকুপে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে। অবৈধ দখলকারীরা রাজনৈতিক, প্রশাসন, বাহুবল, প্রভাব প্রতিপত্তিশালীদের ছত্রছায়ায় এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড করে থাকে। পাশাপাশি  বিদ্যুৎ পানিসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে অসৎ এবং অনৈতিক সুযোগ সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনার অব্যবহিত পরেই আবার সংযোগ লাগিয়ে নেয়। চট্টগ্রামের ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো হলো- রেলওয়ের লেকসিটি আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, পূর্ব ফিরোজ শাহ এক নম্বর ঝিল সংলগ্ন পাহাড়, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মালিনাকানাধীন কৈবল্যধাম বিশ্ব কলোনি পাহাড়, পরিবেশ অধিদপ্তর সংলগ্ন সিটি করপোরেশন পাহাড়, রেলওয়ে, সওজ, গণপূর্ত অধিদপ্তর ও ওয়াসার মালিকানাধীন মতিঝর্ণা ও বাটালি হিল পাহাড়, ব্যক্তিমালিকানাধীন একে খান পাহাড়, হারুন খানের পাহাড়, পলিটেকনিক কলেজ সংলগ্ন পাহাড়, মধুশাহ পাহাড়, ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট সংলগ্ন পাহাড়, মিয়ার পাহাড়, আকবরশাহ আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড়, আমিন কলোনি সংলগ্ন ট্যাংকির পাহাড়, লালখান বাজার জামেয়াতুল উলুম মাদ্রাসা সংলগ্ন পাহাড়, ভেড়া ফকিরের পাহাড়, ফয়’স লেক আবাসিক এলাকা সংলগ্ন পাহাড় এবং এমআর সিদ্দিকী পাহাড়।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারণে কক্সবাজার জেলার প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য বলতে গেলে ধ্বংস হতে চলেছে। এরইমধ্যে মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া এ জনগোষ্ঠী জেলার বিভিন্ন বনাঞ্চলের ৮ হাজার ১ দশমিক ২ একর বন উজাড় করে বসতি স্থাপন করেছে, ব্যবহার করেছে জ্বালানি হিসেবেও। টাকার অংকে ক্ষতির পরিমাণ দুই হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকারও বেশি। সামগ্রিক ক্ষতির পরিমাণে মোট ধ্বংসপ্রাপ্ত বনের পরিমাণ ৮০০১ দশমিক ০২ একর এবং সর্বমোট বনজদ্রব্য ও জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষতির পরিমাণ ২ হাজার ৪২০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। বনবিভাগের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ৮ম সভায় উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আসতে থাকে। এখন ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন নিবন্ধিত রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফ অঞ্চলের বনভূমিতে বসতি স্থাপন করেছে। পুরনো দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্প এবং নতুন অনিবন্ধিত ৩২টি ক্যাম্পসহ রোহিঙ্গাদের মোট ক্যাম্প ৩৪টি। ৬ হাজার ১৬৪ দশমিক ০২ একর বনভূমি দখল করে এসব ক্যাম্প গড়ে উঠেছে। ফলশ্রুতিতে নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, ভূমিরূপ পরিবর্তন, জীববৈচিত্র্যের অবক্ষয় এবং মানুষ-বন্যপ্রাণী সংঘাত বেড়েছে। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে এসব এলাকায় পানির স্তর দ্রুত কমে যাচ্ছে। “জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটি গাছ তার শেকড়ের সঙ্গে পানি ধরে রাখে। এর কারণে ভূ-পৃষ্ঠের পানির স্তুর উপরের দিকে থাকে। যখন গাছটি মরে যায় বা যেখানে গাছ থাকে না সেখানে পানির স্তরে নিচে নেমে যায়। কক্সবাজারে অতিরিক্ত টিউবওয়েলের কারণে যেমন পানির স্তর নিচে নামছে, বন উজাড়ের কারণেও স্তর নেমে যাচ্ছে। এটা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে। ( বাংলা ট্রিবিউন, ১৮ ডিসেম্বর’২০)। পাশাপাশি “বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলেন, কক্সবাজার জেলার পাহাড়গুলো প্রধানত নরম ও দোআঁশ মাটির হওয়ায় মাটির কাঠিন্য বা দৃঢ়তা কম।  ফলে টানা কয়েক দিন বৃষ্টি হলে পাহাড়ধসের আশঙ্কা বেড়ে যায়। বিগত বিভিন্ন বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ধসে অনেক ক্ষতি হয়েছে। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড় ও বনভূমি কেটে অপরিকল্পিত রোহিঙ্গা বসতি গড়ে তোলায় বর্ষায় পাহাড়ধসের আশঙ্কা রয়েছে”। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের রান্নার জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।  জ্বালানি জোগাড় করতে রোহিঙ্গারা বনের গাছ কাটছে । বনের গাছ কাটার পাশাপাশি শিকড়ও তুলে ফেলছে। ফলশ্রুতিতে রোহিঙ্গাদের নির্দয়ভাবে গাছ কাটার ফলে উখিয়া-টেকনাফের বন প্রায় উজাড় হয়ে যাওয়ার পথে। গাছের সঙ্গে সঙ্গে গাছের শেকড়ও তুলে ফেলায় পাহড়গুলো ক্রমশ ন্যাড়া হয়ে যাচ্ছে এবং পাহাড় বা ভুমিধসের অন্যতম কারণ হয়ে উঠছে।  অন্যদিকে জীবনের ক্ষয়-অথচ ধস রোধ ও দখলদার উচ্ছেদে স্থায়ী ও টেকসই ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি কখনো। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গৃহহীন, ভিটেবাড়িহারা এসব মানুষের আবাসনের সরকার এবং রাষ্ট্রকে কার্যকরী এবং বাস্তবমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা অতিদ্রুত বাস্তবায়নে উদ্যোগ ও কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করে এদের স্থায়ী আবাসনের বা বসবাসের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকৃত এবং কার্যকরী উদ্যোগ নিয়ে বিদ্যমান বাঁধাগুলো করতে হবে। কেননা সাময়িক উদ্যোগে এর সমাধান নাই বলে মনে করেন পরিবেশবিদ এবং সংশ্লিষ্টরা।  অতএব পাহাড় ধসে মৃত্যু বন্ধে পাহাড় পাদদেশে বসবাস বন্ধ করে বসবাসকারীদের জন্য আবাসন গড়ে তোলার বা পুনর্বাসনের কোনো বিকল্প নেই।   

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ