পারাপার

নাজিয়া তাসনিম ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, সোমবার, ১০:৫৯:৪৪অপরাহ্ন ছোটগল্প ৩৪ মন্তব্য

ভাদ্র মাস। মাথার উপরে তপ্ত লাল সূর্য। সূর্যের তেজ ক্ষণে ক্ষণে যেন বাড়ছে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছে মাজেদ মিয়া। ঘাড়ের উপর দু'জায়গায় ছেড়া এক জীর্ণ গামছা। গামছা দিয়ে মুখ মুছে নিলো সে। আর সেই সাথে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

নদীর নাম তুলসী গঙ্গা। নদীর ধারে সবুজে ছাওয়া ছোট গ্রাম। সেই গ্রামেই মাজেদের জন্ম। বাপ-দাদা সবাই ছিল মাঝি। সেই সূত্রে নদীর সাথে তার আত্মার সম্পর্ক। ছয় বছর বয়স থেকেই মাজেদ বাপের সাথে নৌকায় আসা যাওয়া শুরু করে।
এভাবেই তার হাতে খড়ি হয়।

তার বাপজানের পর গ্রামের সবার নদী পারাপারের দায়িত্ব এসে পরে মাজেদের উপর। বাপের রেখে যাওয়া একটা খেয়া নৌকায় সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাত্রী পার করতো। গ্রামের এপারের যাত্রীকে হাটের দিকে পার করতো। হাট শেষে আবার তার নৌকা গ্রামের মানুষ বাড়ি ফিরতো। নৌকা চলতো মানুষের সুখ-দুঃখের কথা, মামলা-মোকদম্মার কথা, দেশের কথা, রাজনীতির কথা।
এভাবে গল্পে গল্পে মাজেদের নৌকা তীরে ভিড়ত।

এইতো বছর দুয়েক আগের কথা, রতন ঘোষের পোয়াতি বউয়ের প্রসব বেদনা ওঠে। রাত চারটার দিকে মাজেদ মিয়াকে ডেকে নিয়ে যায় রতনের ছোট ভাই সুজন। তরিঘরি করে নৌকা ছাড়ে সে। রতনের বউকে নদী পার করে। হাসপাতাল পর্যন্ত সঙ্গে যায় মাজেদ। সেদিন দুপুরেই রতন ঘোষের ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান হয়।
রতন ঘোষ গ্রামে ফিরে সবার প্রথম মাজেদের বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে যায়। এরপর থেকে সেই বাচ্চার অন্নপ্রাশন থেকে শুরু করে এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই যেখানে মাজেদ দাওয়াত পায়নি।

আবার গ্রামের সবচেয়ে ধুমধামের বিয়ের সাক্ষীও তার নৌকা। সৈয়দ সাহেবের বড় মেয়ের বিয়ের আয়োজন সাত গ্রামের কেউ ভুলবে না। বিয়ের দিন বরযাত্রীর শেষ নাই, তিন তিন বার নৌকা ভরে বরযাত্রী পার করে সে, বউ নিয়ে ফেরার আগে মাজেদের নৌকা রঙিন কাগজে সাজানো হয়। ক্যামেরা দিয়ে সেদিন তার নৌকার কত ছবিই না তোলা হয়!

নদীর ঘাটে এসে এমন হাজারো ঘটনা আজ তার স্মৃতিতে ভেসে উঠছে। মনটা আজ তার বেশ উদাসীন।

মাজেদের বাপ খেয়া পারাপারের বিনিময়ে বছরে দু'বার গ্রামের লোকের থেকে ফসল উঠাত। তখন মাজেদও যেত বাপের সাথে ফসল তুলতে। বাপ মরার পর মাজেদ যখন পুরোদস্তুর মাঝি,পারাপারের বিনিময়ে কাচা পয়সা পেত সে। একবার মোড়ল সাহেবকে ধরে টাকার বিষয়টা পাকাপাকি করে সে। গ্রামের মানুষও সহজেই মেনে নেয়।
সেই টাকায় বউ আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার ভালোই চলছিল তার।
মাজেদের জমিজমা না থাকলেও বাড়ির উঠানে তার বউয়ের শখের বাগান। সেখান থেকে সারাবছর অল্প-সল্প সবজি আসে। এভাবে টানাটানির সংসারে সুখের অভাব ছিল না মাজেদ মিয়ার।

কিন্তু বছর খানেক আগে হাটে চা খেতে খেতে কোরবান চাচা একটা খবর দেন। নদীর উপর নতুন ব্রিজ হবে।
ব্রিজের সাথে রাস্তাও কিছুটা পাকা হওয়ার কথা। গঞ্জের সাথে গ্রামের যোগাযোগ ভালো হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুরই উন্নতি হবে। কোরবান চাচা বেশ আনন্দের সাথেই খবরটা দেন। মাজেদের সাথে চায়ের দোকানে বসা সবার মনেই একটা ফূর্তির বাতাস বয়ে যায়। শুধু মাজেদ মিয়া হঠাৎ বিষম খায়। বুকটা ধরফরিয়ে ওঠে। চা শেষ না করেই সে উঠে পড়ে।

নৌকা বাওয়া মাজেদের বাপ-দাদার পেশা। বংশ-পরম্পরায় সেও এ কাজ করে আসছে সেই ছোটকাল থেকে। মাজেদের আর কোনো কাজ জানা নেই। না আছে জমি।
মানুষের জমি বর্গা নেবে, তাও তো সে পারবেনা। না সে জমিতে হাল দিতে জানে, না জানে কোন মাটিতে কতটুকু সার লাগে।
বাড়ি-ভিটাটুকু ছাড়া আর কিছু নেই তার।
ব্রিজ হলে সংসার কিভাবে চলবে সে চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে মাজেদ।

এর কিছুদিন পর থেকে কাজ শুরু হয়। শহর থেকে বড় বড় মেশিন আসে। বালু আসে। আসে সিমেন্ট। শ্রমিক আসে, সেই সাথে ইঞ্জিনিয়ার।
দেখতে দেখতে ব্রিজের কাজ শুরু হয়ে আবার শেষও হয়। সাথে বন্ধ হয়ে যায় মাজেদ মিয়ার নৌকা।

বেশ কিছুদিন আগে ব্রিজের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধনের দিন বড় নেতা আসেন। তাঁকে দেখতে গ্রামের সব মানুষ ঘাটে আসে। কবুতর উড়িয়ে ব্রিজ উদ্বোধন হয়। আর সেদিন মাজেদের গা পুড়িয়ে জ্বর আসে।

আজ ব্রীজের পাশে সেই পুরোনো ঘাটে এসে তাই অনেক কথাই তার মনে পড়ে। গ্রামের মানুষের যোগাযোগের সুবিধা দেখে তারও ভালো লাগে। বুঝি একটু আনন্দ হয়। সে একরকম মিশ্র অনুভূতি নিয়ে রোদে চিকচিক করা নদীর জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকে।

হঠাৎ এক লোক মোটরসাইকেল নিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করে, 'ভাই, এটা কি মাজেদ মিয়ার ব্রিজ?'
ব্রিজের নাম শুনে মাজেদ মিয়া বেশ অবাক হয়। উত্তরে হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে। নৌকা বন্ধ হলেও মানুষ তার নামটা ভুলে যায়নি। তার শুকনো ঠোঁটে হালকা একটা হাসি ফুটে ওঠে।

0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ লেখা

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ