পাগলার বউ (শেষ পর্ব)

সাতকাহন ৩০ নভেম্বর ২০১৩, শনিবার, ১২:৪১:২৭অপরাহ্ন গল্প ১২ মন্তব্য

গ্রামের মাঝখানে চৌরাস্তায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল তেঁতুল গাছটি। গ্রাম অঞ্চলে এখন আর সচরাচর বড় গাছ দেখা যায় না। মানুষ রাক্ষসের মত সব খেয়ে নিচ্ছে। এত বড় গাছ এ তল্লাটে আর নেই। এই বিখ্যাত তেঁতুল গাছের নিচে গ্রামের বিচার-আচার, ধর্মীয় সভা এমনকি গানের আসরও বসে। আজ তেঁতুল তলায় সালিশ বসেছে। অভিযোগকারী খালেক এবং দুলাল। তাদের অভিযোগ পাগলার বউ’র ঘরে পর পুরুষ ছিল। তারা তাবড় দিয়েছিল কিন্তু ধরতে পারেনি। পাগলার বউ এই সমাজের শান্তি-শৃংঙ্খলা বিনষ্ট করছে। নিজে পাপ করছে এবং অন্যদের পাপী করছে। সালিশে উপস্থিত আছে গ্রামের প্রধান বিচারক আনসার মণ্ডল, মোসলেম মণ্ডল, নেপাল বিশ্বাস, একরামউদ্দীন হুজুরসহ আরো অনেক গণ্যমান্য মণ্ডল, মাতব্বর। সাধারণ লোকজনের সংখ্যাও অনেক বেশি। আড়ালে-আবডালে মহিলারাও রয়েছে। এধরনের বিচারে গ্রামের মানুষের আগ্রহ থাকে অনেক বেশি। আনসার মণ্ডল গোঁফ মোচড়াতে-মোচড়াতে দুলাল এবং খালেকের কথা শুনলেন। উত্তেজিত হয়ে একরামউদ্দীন হুজুর বললেন, এসপ পাপাচারী মহিলাদের এই সমাজ থেকে উৎখাত করা উচিত। ইরা নিজেরা তো জাহান্নামে যাবেই-এবং আমাদেরকেও নিয়ে যাবে।

গাম্ভীর্য বজায় রেখে আনসার মণ্ডল বললেন, হুজুর, আপনি শান্ত হন। আগে সবার কতা শুনা হোক। তারপর কতা বলবেন।

বিচার মজলিশে ফাসুর-ফুসুর, কানাকানি বেশি হচ্ছে দেখে নেপাল বিশ্বাস উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপোনারা সব্বাই থামেন। আমাদেরকে বিচার করতি দিয়ার সুযোগ দেন।

মোসলেম মণ্ডল উকিলের মত প্রশ্ন করলেন, খালেক-দুলাল, তুরা পাগলার বউর ঘর থেকে একজনের তাবড় দিইচিস ভাল কতা, কিন্তু তার সাক্ষী কিডা?

খালেক বলল, সাক্ষী হচ্ছে জবেদ আলী ভাই। পাগলার বউর বাড়ির কাচের লোক।

আনসার মণ্ডল বললেন, জবেদের ডাক দে।

গাঁইগুঁই করতে করতে জবেদ আলী বলল, আমি আসলে তেরাম কিচু জানিনে। কাল রাতি খালেক আর দুলাল হাঁপাতি-হাঁপাতি এসে আমার ঘুম থেকে জাইগে বললে, তারা নাকি পাগলার বউর ঘর থেকে কার তাবড় দিয়েচে। আরো বললে যে, আমার সাক্ষী দিতি হবেনে। আমি এর বেশি কিচু জানিনে।

আনসার মণ্ডল মাথা ঝাঁকাতে-ঝাঁকাতে বললেন, সবই তো শুনলাম, হাশেমের বউ, তুমার যা বলার আচে বল।

পাগলার বউ বিচার মজলিশের মাঝখানে ঘোমটা মাথায় কলা গাছের মত দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা এর আগেই হয়েছে। আনসার মণ্ডলের নির্দেশ-অপরাধী বিচার সভায় দাঁড়িয়ে থাকবে, বসতে পারবে না। পাগলার বউ নতুন বউর মত নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে একরাউমদ্দীন হুজুর আঙুল নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন, এই মহিলার কারণে যুব সমাজ সপ বে-পতে চলে যাচ্চে। ইদের বিরাট শাস্তি দিয়া উচিত।

পাগলার বউ বাকরুদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আনসার মণ্ডল বললেন, এই বিটি তুমি কতা বলচ না কেন?

শীতের দিনে কুকুর যেমন ছাই গাদা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, তেমনভাবে দাঁড়িয়ে পাগলার বউ বলল, এই গিরামে যত মাগী নাঙ করে, সব দোষ এই পাগলার বউর ঘাড়ে এসে পড়ে।

আনসার মণ্ডল বাঘের মত গর্জন করে বললেন, এই বিটি, তুমার তো বলিহারি সাহস। এই দুলাল দড়ি নিয়ায়, তেঁতুল গাচের সাতে টাঙা এই মাগীর।

একরামউদ্দীন হুজুর বললেন, এই মহিলাকে মাতা ন্যাড়া করে, ঘোল ঢেলে গিরাম থেকে বের করে দিয়াই মঙ্গল।

নেপাল বিশ্বাস বললেন, এই বিটির গিরামের এক সাইডে পাইটে দিয়া যাক।

কান্না জড়ানো কণ্ঠে পাগলার বউ বলল, আমি আমার স্বামীর ভিটে ছেড়ে কুতাও যাতি পারবো না। আমার ভিটেই আমি থাকপো, ইতি মানষির কি সমেস্যা তা বুজতি পারচি নে।

আনসার মণ্ডল দাঁতে দাঁত কামড়ে বললেন, তা বুজবা কেন, তুমি তো কচি খুকি!

আনসার মণ্ডলের বাক্য শেষ হতে না হতেই-ধড়মড় করে বিচার মজলিশে ঢুকে পড়লো তার বাড়ির রাখাল মন্টু। হাঁফাতে-হাঁফাতে ভয়ার্তভাবে সে বলল, দাদা সব্বোনাশ হয়ে গিয়েচে।

আনসার মণ্ডল অভয় দিয়ে বললেন, শান্ত হ তুই। কি হয়েচে খুলে বল্।

রুপালি ফুবু, আপনার মেয়ে-

শঙ্কিতভাবে আনসার মণ্ডল বললেন, হ্যাঁ, রু-রুপালি, কি হইচে?

তোতলাতে-তোতলাতে মন্টু বলল, আপনার মেয়ের ঘরে-আপনার মেয়ের ঘরে সামাদ ঢুকেলো। দাদী হাতেনাতে ধরে ফেলেচে। আইজ সালিশির দিন বাড়ি ফাকা পেইয়ে-

উঠে দাঁড়িয়ে ষাঢ়ের মত গজরাতে-গজরাতে আনসার মণ্ডল বললেন, কি বললি তুই? হারামজাদা, ছোট লোকের বাচ্চা, জুতিয়ে খাল খুলে দোবো। ওরে জ্যান্ত কবর দোবো, আয় আমার সাতে। ওর চৌদ্দ গুষ্টি আমি নিপাত করে ছাড়বো।

আনসার মণ্ডলের রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে মন্টুর গা দিয়ে ঘাম ছুটে এল।

আগের পর্বের লিংক :

পাগলার বউ-১

http://www.sonelablog.com/archives/4157

পাগলার বউ-২

http://www.sonelablog.com/archives/9231

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ