
নামে কি আসে যায়! অঞ্চলভেদে কোথাও খরমা, কোথাও ছোট হাঁটুভাঙ্গা আবার কেউ কেউ তাকে চেনেন হট্টিমা নামে। অবশ্য পাখিটি বগুডি বা ছোট শিলাবাটান নামেও পরিচিত। আজ লিখছি সেই পাখি নিয়েই।
বাল্যবন্ধু বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমির কর্মকর্তা আনসার উদ্দিন খান পাঠানের সঙ্গ নিয়ে প্রায় দেড় বছর পর গত ২৫ ডিসেম্বর রাজশাহীর পদ্মার চরে গিয়েছিলাম। আমাদের সঙ্গে রাজশাহী বার্ড ক্লাবের সভাপতি নাইমুল হাসান এবং আরো দুজন স্থানীয় বার্ড ফটোগ্রাফার ছিলেন। আমরা মোট ৬ জন মাঝি তারিকের নৌকায় উঠে পদ্মার চরে রওনা হই। তখন আকাশে ভোরের সূর্যের আলো উঁকি দিয়েছে মাত্র। কুয়াশা ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। ভোরের কোমল আলো যখন কুয়াশার আঁধার ভেদ করে মর্ত্যে নেমে আসে সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি।
ফটোগ্রাফির জন্য সুন্দর পরিবেশ আর পর্যাপ্ত আলো পেয়ে আমরা সবাই খুশী। আমরা পদ্মার ১০ নাম্বার চরের দিকে যাচ্ছিলাম। এমন সময় মাঝি তারিক একটা চরের সামনে নৌকা ভিড়ালো। কারণ জানতে চাইলে সে বলল, স্যার এখানে গতকাল খরমা বা ছোট হাঁটুভাঙ্গা পাখির দেখা মিলেছিল। শুনে কৌতূহল জেগে উঠল। ২০১৭ সালে এই পাখির ছবি তোলার জন্য বণ্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী আদনান আজাদ আসিফকে সঙ্গে নিয়ে পদ্মার চরে প্রায় আধাবেলা খুঁজে বেড়াই। কিন্তু পাখিটির দেখা মেলেনি।
সত্যি বলতে এই পাখি আমার সংগ্রহে না থাকায় আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল। সবাই মনস্থির করলাম পাখিটির ছবি তুলবো। একে একে সবাই নৌকা থেকে নেমে পড়লাম। তারিক বেশ কিছুটা পথ অগ্রসর হয়ে আমাদের হাতের ইশারায় ডাকলো। তার আহ্বানে বুঝতে পারলাম তারিক পাখিটিকে দেখেছে। আমরা ধীর পায়ে তারিকের কাছে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হচ্ছিলাম। এমন সময় দুটি খরমা পাখি আমাদের সামনে দিয়ে উড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ক্যামেরা তাক করে ক্লিক করলাম। মাত্র দুটি উড়ন্ত ছবি পেলাম। আমার সংগ্রহে আরেকটি পাখি যোগ হওয়ায় তারিককে ধন্যবাদ দিয়ে আবারো নৌকায় ফিরে এলাম। তবে নাইমুল ভাই ছাড়া আমাদের সবারই এটি খরমার তোলা প্রথম ছবি। হ্যাঁ, এতক্ষণ যে পাখিটির কথা বললাম, তার বাংলা নাম নিয়ে আগেই লিখেছি।
আকার ভেদে এই পাখির দৈর্ঘ্য ৪০-৪৫ সে.মি., ওজন ২৮০-৫২৫ গ্রাম। এটি জলচর পাখি। এরা BURHINIDAE পরিবারের অন্তর্গত। এরা বড় হলুদ চোখ লম্বা পায়ের পাখি। ঠোঁট মাথার চেয়ে ছোট, শক্ত, সোজা, প্রশস্ত ও নাকের ছিদ্র লম্বা। ডানা লম্বা ও সূচালো। এদের পায়ের পেছনে কোনো আঙুল নেই। তবে মাঝের আঙুলের নখ প্রশস্ত। এদের পিঠ বালু-বাদামি ও দেহের নিচের অংশ হালকা বালু-বাদামি। পেট সাদা। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা অভিন্ন।
খরমা বা মোটা হাঁটু মরুভূমি, প্রস্তরময় পাহাড়, খোলা শুকনা বনভূমি, নদীর পাড়ে, ক্ষুদ্র ঝোঁপের ছোট ছোট ভূ-খণ্ড, ফলের বাগান ও শুকনো গ্রামের কুঞ্জবনে বিচরণ করে। অধিকাংশ সময় জোড়ায় বা ছোট ঝাঁকে থাকে। এরা আঙুলের মাথায় ভর দিয়ে রাতে হেঁটে হেঁটে পাথর, শুকনো নদীতট ও খোলা বনতলে ঠোকর দিয়ে খাবার খায়। খাদ্যতালিকায় পোকা, কেঁচো, খোলসহীন শামুক, ছোট সরীসৃপ ও ইঁদুর রয়েছে। দিনে এরা শীতল বা ছায়াময় জায়গায় বিচরণ করে। এদের গলার স্বর কর্কশ। পিক-পিক-পিক-পিক–উই উচ্চ শব্দ করে গলা চেঁচিয়ে ডাকে। ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত এদের প্রজননকাল।
প্রজননকালে ঘাস বা বালু বা পাথরের নিচে কোনো কিছু না বিছিয়ে মাটিতে ২-৩টি ডিম পাড়ে। মেয়েপাখি ডিমে তা দেয়। তবে পুরুষপাখি ডিমে তা না দিলেও সারাক্ষণ পাহারায় থাকে। ডিম থেকে ছানা বের হওয়ার পর দুজনই পরিচর্যা করে।
খরমা আমাদের দেশে অনিয়মিত পাখি। দেশের রাজশাহী বিভাগ ও খুলনা বিভাগে নিয়মিত দেখা যায়। এ ছাড়াও ইউরোপ, আফ্রিকা ও ভারতজুড়ে পাওয়া যায়। এরা বিশ্বে বিপদমুক্ত হলেও বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বণ্যপ্রাণী আইনে এই প্রজাতি সংরক্ষিত।
বাংলা নাম: খরমা, ছোট হাঁটুভাঙ্গা, হট্টিমা, বগুডি বা ছোট শিলাবাটান
ইংরেজি নাম: Eurasian stone-curlwe বা Eurasian thick-knee
বৈজ্ঞানিক নাম: Burhinus oedicnemus (Linnaeus, ১৭৫৮)
ছবিগুলো রাজশাহীর পদ্মার চর থেকে তোলা।
২০টি মন্তব্য
সাখাওয়াত হোসেন
এই পাখি ও নামের সাথে এর আগে আমি পরিচিত ছিলাম না। আপনার লেখা থেকে আজ অনেক কিছুই জানলাম। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
শামীম চৌধুরী
শুভ কামনা রইলো।
বন্যা লিপি
অনেকদিন পরে এলেন শা’চ্চু। আমি অবাক হই আপনার এমন পাখি প্রেম দেখে। আবার ভীষণ ভালোও লাগে। কত কত জায়গা খুঁজে খুঁজে বাহারি রকম পাখিদের ক্যামেরা বন্দী করা! যেন যাযাবরের মত। লেখা পড়তে পড়তে যেন আমিও চক্কর কেটে আসি পাখি ভ্রমনে। দারুন
শামীম চৌধুরী
ধন্যবাদ ব’ফু। সত্যিই বলেছেন যাযাবর জীবন। আমি প্রকৃতির সাথে এই জীবন খুব ভালোবাসি। আমার কাছে এটা হচ্ছে নির্জঞ্জাট একটা জীবন। শুভ কামনা রইলো।
প্রদীপ চক্রবর্তী
অনেকদিন পর পাখি দাদার পাখি নিয়ে বিস্তারিত লেখনী পড়লাম।
বেশ ভালো লাগলো,দাদা।
আপনার মাধ্যমে অজানা অনেককিছু জানি।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ দাদাভাই। শুভ কামনা রইলো।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ ভাই।
মোহাম্মদ মনজুরুল আলম চৌধুরী
পাখিটি সম্পর্কে জানানোর জন্য ধন্যবাদ। দারুণ ফ্রেমবন্দী।
শামীম চৌধুরী
কৃতার্থ ভাই।
মনির হোসেন মমি
হাট্রিমাটি টিম তারা মাঠে পারে ডিম।এই পাখি কী সেই পাখি ভাইজান। পাখির ছবি তুলতে কত কষ্টই না করছেন আর আমরা আমারে তাদের পরিচিতি সহ আপনার কষ্টসাধ্য শ্রমে ভাগ নিচ্ছি।কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।ভুলেও যেন ভুলে যাইয়েন না আমাদের আপনার পাখি পোষ্ট আমার খুব প্রিয়। ধন্যবাদ প্রিয়।ভাল থাকবেন।সুস্থ থাকবেন।
শামীম চৌধুরী
জ্বী ভাইজান, এটাই সেই ছড়ার পাখি। ছড়াকার সত্যিই লিখেছিলেন তারা মাঠে পাড়ে ডিম। আমার লেখায় এদের প্রজননের বর্ননা দেয়া আছে। আপনিও ভাল থাকুন।
তৌহিদ
অনেকদিন পরে ব্লগে এলেন ভাই। স্বাগতম।
খরমা পাখির কথা আজই প্রথম জানলাম। আপনার লেখা পড়া মানেই ভীন্ন রকম অনুভূতি হয়। নতুন তথ্য এবং জ্ঞানে সমৃদ্ধ হই আমরা। পাঠক এ জ্ঞান আহরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিন্তু।
আপনার লেখা ভালোলাগার আরও একটি কারণ হচ্ছে নির্ভূল বানানে সহজ শব্দে ঝকঝকে লেখা যা আকৃষ্ট করে রাখে পাঠে। ভাই সপ্তাহে দুটো হলেও লেখা চাই আপনার।
শুভকামনা জানবেন।
শামীম চৌধুরী
নানান ঝামেলা ও কর্মব্যাস্ততায় আসা হয়ে উঠেনি। ভালো থেকো ভাইয়া। শুভ কামনা রইলো।
বোরহানুল ইসলাম লিটন
এক জীবনে যে অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়।
অজানাকে জেনে পরিতুষ্ট হলাম।
আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রেখে গেলাম পাতায়।
শামীম চৌধুরী
আপনার জন্যও রইলো শুভ কামনা।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ভাইয়া কতদিন পর আপনার পাখি নিয়ে লেখা পেলাম। কতকিছু জানতে পারি পাখি নিয়ে লেখায়। এখন থেকে নিয়মিত পাবো তো আপনাকে?? ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
শামীম চৌধুরী
দিদিভাই, নানান ঝামেলা ও কর্মব্যাস্ততায় নিয়মিত আসতে পারিনি। এখন নিয়মিত লিখতে ও জানাতে পারবো পাখি নিয়ে।
শুভ কামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
এই পাখি নিয়ে প্রথম আলোতে পড়েছিলাম। আবারও পড়লাম। ভালো লাগলো।
আপনি কেমন আছেন?
শামীম চৌধুরী
ভালো আছি মুক্তা আপু। শুভকামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
এই পাখির কথা আগে শুনিনি কখনো, দেখেছি বলেও মনে পরছেনা।
সুন্দর পাখিটি সম্পর্কে চমৎকার পোস্ট।
ব্লগে মিস করি আপনাকে।
শুভ কামনা।