
পথে কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই পুরনো পল্টন পৌঁছে যায় ফাতমী। সেইফ হাউজে ঠিকানা মত পৌঁছে দেখে সেটা একটা একতলা বাড়ি, উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। গেটে হর্ন বাজাতেই গার্ড দরজা খুলে দেয়। বড় একটা লনের ঠিক মাঝখান দিয়ে ড্রাইভওয়ে। ড্রাইভওয়ের শেষমাথায় গাড়ি বারান্দা। লনের চারপাশে সীমানা দেয়াল ঘেঁষে অনেকগুলো গাছ লাগানো ঘন করে। এই গাছগুলো বাইরের দিক থেকে একতলা বাড়িটাকে সবার দৃষ্টির আড়াল করে রেখেছে। গাড়ি বারান্দায় গাড়িটা পার্ক করতেই একজন কেয়ারটেকার এসে তাকে স্বাগত জানায়। ভেতরে ঢুকে ফাতমী দেখে রুচিশীল আসবাবপত্র দিয়ে ভেতরের প্রত্যেকটা কক্ষ খুব সুন্দর করে সাজানো। কেয়ারটেকার তাকে তার কক্ষ দেখিয়ে দেয়। কক্ষে ঢুকে বেডসাইড টেবিলের উপরে ব্রিফকেসটা রেখে বিছানায় বসে পড়ে ফাতমী। বসতেই সারাদিনের জমা ক্লান্তি যেন তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বিছানা থেকে উঠে কক্ষের একপাশে দেয়াল আলমারি টা খুলে ফাতমী দেখে সেখানে তার সাইজের কাপড়-চোপড় আগে থেকেই সাজিয়ে রাখা। সে ভাবে, একটা শাওয়ার নিয়ে সামান্য কিছু খেয়ে একচোট ঘুমিয়ে নিতে হবে। শাওয়ার সেরে বেরুতেই দেখে কেয়ারটেকার বেডসাইড টেবিলে খাওয়া রেখে গেছে একটা ট্রেতে করে। খেয়ে নিয়ে সাথে সাথেই শুয়ে পড়ে ফাতমী। আর শোবার সাথে সাথেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় সে।
ঘুম ভাঙতেই ধড়মড় করে উঠে বসে ফাতমী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধে সাড়ে ছটা বাজে। তারমানে টানা আড়াই ঘণ্টা ঘুমিয়েছে সে। আড়াই ঘন্টার গভীর ঘুমে শরীরটা খুব ঝরঝরে লাগছে তার। বেল বাজিয়ে কেয়ারটেকারকে ডেকে এক কাপ কফি দিতে বলে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ওয়াসিমের ফাইলটা খুলে বসে ফাতমী।
নামঃ ওয়াসিম আকবর চৌধুরী। ডাকনাম পান্না।
জন্মঃ অক্টোবর ২০, ১৯৪৮।
উচ্চতাঃ ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি।
গায়ের রংঃ ফর্সা।
পিতাঃ ওয়াহিদ আকবর চৌধুরী। পেশায় স্কুল শিক্ষক। ঠিকানাঃ ৮৯ নাম্বার কাপাসগোলা রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
মাতাঃ সুলতানা খাতুন চৌধুরী। পেশায় গৃহিণী।
ওয়াসিমের আর কোনো ভাইবোন নেই।
সে বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। ভালো দাবা আর ফুটবল খেলে। দারুণ আবৃত্তিও করে সে। আবৃত্তিতে স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেশকটি প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে সে। প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ। এছাড়াও নজরুল, সুকান্ত এবং আবুল হাসানের কবিতাও তার খুব ভালো লাগে। ছাত্র হিসেবেও ভাল, তবে যাকে বলে তুখোড়, তা সে নয়।
ওয়াসিম রাজনীতি সচেতন, দেশ নিয়ে ভাবনা আছে তার। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অনেক নেতার সাথেই পরিচয় আছে তার। এদের কয়েকজনের ঘনিষ্ঠও সে। তবে সক্রিয় রাজনীতি কখনোই করেনি সে। তার পরিকল্পনা আছে ভবিষ্যতে স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকা বা ইংল্যান্ড থেকে উচ্চতর ডিগ্রী নেয়ার। এরপর দেশে ফিরে অধ্যাপনা করাই তার ইচ্ছে।
কোনরকম রোমান্টিক সম্পর্কে বর্তমানে সে জড়িত নয়। তবে ডিপার্টমেন্টের তিন বছরের জুনিয়র ফৌজিয়া খানম এর প্রতি তার দুর্বলতাটা মোটামুটি সর্বজনবিদিত। ফৌজিয়াও সেটা জানে। কিন্তু পরিবারের রক্ষণশীলতার কারণে ফৌজিয়া বিয়ের আগে কোনো রকম সম্পর্কে জড়াতে দ্বিধান্বিত। ওয়াসিমও ফৌজিয়ার এই মনোভাব মেনে নিয়েছে। তার ইচ্ছে আছে, বিদেশের স্কলারশিপটা নিশ্চিত হয়ে গেলে পারিবারিকভাবে ফৌজিয়ার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। তার পরিবার রাজি হলে বাগদান সম্পন্ন করে দেশের বাইরে যাবে সে, আর ফিরে আসার পরই বিয়ের পাটটা চুকিয়ে ফেলবে। ওয়াসিমের পরিবার মধ্যবিত্ত, মোটামুটি স্বচ্ছল। কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি অনুরাগী, রুচিশীল এবং শিল্প-সাহিত্যে আগ্রহী হিসেবে ওয়াসিমের পরিবারের ভালো সুনাম আছে পুরো চট্টগ্রাম জুড়ে। এজন্যই ওয়াসিমের ধারণা যে, তার এবং ফৌজিয়ার বিয়ের প্রস্তাব ফৌজিয়ার পরিবার মেনে নেবে।
ফাইলে ওয়াসিম সম্পর্কে এটুকুই লেখা। ফাতমী পুরো লেখাটা কয়েকবার পড়লো। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কিছু নোটও নিল। এভাবে বেশ কবার পড়ার পর ওয়াসিম সম্পর্কে ফাইলে থাকা সমস্ত তথ্য তার মাথায় গেঁথে গেল স্থায়ীভাবে।
এরপর ফাইলে রাখা একটা খাম হাতে নিল ফাতমী। খামের উপর ওয়াসিমের নাম লেখা। খামটা খুলতেই অনেকগুলো ছবি বেরিয়ে এলো। প্রথম ছবিটা একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি। ছবিটার দিকে তাকাতেই ফাতমী চমকে উঠলো। তার ছবি এই ফাইলে কি করছে! বিমুঢ়ভাবে সে ছবিটা উল্টে পেছনদিকে দেখল ওয়াসিমের পুরো নাম লেখা। এটা দেখে তার বিমুঢ়তা বাড়ল বই কমল না। বাকি ছবিগুলোতে সে স্রেফ চোখ বুলিয়ে গেল। প্রায় সবই ওয়াসিমেরই নানান রকম ছবি। কোনটায় একা, কিছু কিছুতে পরিবারের সাথে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথেও আছে কয়েকটা। বিভিন্ন এ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ওয়াসিমের বাবা মায়ের ছবিও আছে বেশ কিছু। কাছে এবং দূর থেকে তোলা ফৌজিয়ারও অনেকগুলো ছবি আছে। খুব মিষ্টি শিশুর সারল্যে ভরা চেহারা ফৌজিয়ার। তার একটা ক্লোজ আপ ছবিতে চোখ আটকে গেল ফাতমীর। কিন্তু পুরোপুরি মনোযোগের সাথে ছবিগুলো দেখতে পারছিল না ফাতমী। কর্নেল খোখারের কাছ থেকে ওয়াসিম আর তার চেহারার, শারিরীক গঠনের, উচ্চতার এই অদ্ভুত মিলের রহস্য না জানা পর্যন্ত মনোযোগ আর ফিরবে না বলেও বেশ বুঝতে পারছে সে।
(চলবে…)
২১টি মন্তব্য
ইঞ্জা
দারুণ ভাবে এগিয়ে চলেছে তোর লেখা, কোথাও এর ছেদ নেই, গল্পের পট পরিবর্তন আসন্ন তা বুঝতে পারছি বন্ধু, দুর্দান্ত টুইস্ট দিয়ে অপেক্ষায় রেখে দিলি আমাদের, এখন পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ বন্ধু! 🙂
ইঞ্জা
ভালো থাকিস।
নিতাই বাবু
সোনেলার বুকে ভালো একটা পর্ব। পড়তে ভালো লাগে, তাই পড়ছিও। তবে হ্যাঁ, আপনার এই ছদ্মনামের পাশাপাশি আসল নামটা জানতে পারি? জানালে দিদি, নাহয় দাদা বলে সম্বোধন করতে পারতাম। কিন্তু এখন অন্যকিছু বলেও সম্বোধন করতে পারছি না, যদি ভুল হয় তাই।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ! হা হা হা! আসল নামেই তো লিঙ্ক পোস্ট করেছি সোনেলার ফেসবুক গ্রুপে! আর এখানেও তো বিশাল গোঁফওয়ালা ছবি আছে একটা। অতএব দাদা ডাকাটাই সমীচীন হবে মনে হচ্ছে! 😂😂😂
নিতাই বাবু
ভার্চ্যুয়াল জগৎ হলো তেলেসমাতি জগৎ দাদা। অনেকেই বাবা-মায়ের রাখা নাম গোপন রেখে বনের বাঘ সিংহের নাম আর গাছগাছালির ছবি ব্যবহার করে। তাই অনেক সময় বিপাকে পড়তে হয়। অনেকবার আমি নিজেও বোকা হয়েছি। দাদাকে দিদি আর দিদিকে দাদা সম্বোধন করে কালামুখো দেখেছি অনেক। তাই এখন ছদ্মনাম দেখলেই ভয় পাই। জেনে নিতে ইচ্ছে করে, দাদা নাকি দিদি বলতে হবে।
বোকা মানুষ
হা হা হা! এখন তো নিশ্চিত হলেন! 🙂
মোহাম্মদ দিদার
অসাধারণ লিখেছেন দাদা।
পরের পর্বের অপেক্ষায়…
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ!
আরজু মুক্তা
ভালো লাগছে।
অপেক্ষায়—-
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ 🙂
মনির হোসেন মমি
গল্প টুইষ্টের দিকে এগুচ্ছে মনে হচ্ছে।ভাল লাগছে। চলুক ভাইয়া।
বোকা মানুষ
দেখা যাক কি হয়! 😉
তৌহিদ
উহ! আবারো টুইস্ট রেখে শেষ করলেন!! এই গল্প পুরোটা না পড়ে মন ভরবেনা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ!
মোস্তাফিজুর খাঁন
আগেই মন্তব্য করতে পারতাম । কিন্তু, এতো ভালো গল্পটা পড়ার পর ১ম এবং ২য় কিস্তি পড়ার কৌতুহলের কারনে পড়ে মন্তব্য করতে দেড়ি হলো ।
অসাধারন সুন্দর লেগেছে,,, ।
আশা করছি এর পরের পর্বে অনেক রহস্য পাব ।
ধাপে ধাপে পর্বগুলো আরো উত্তেজনাপূর্ণ হবে ।
বোকা মানুষ
ধন্যবাদ 🙂
শাহরিন
এই গল্পের ভক্ত হয়ে পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
বোকা মানুষ
কৃতজ্ঞতা! 🙏
সাবিনা ইয়াসমিন
এমন সময়ে এসে গল্প থামিয়ে দেন,, ভাল্লাগেনা। রহস্য এখন তুমুল পর্যায়ে এসে গেছে। ফাতমীর কাছে ওয়াসিমতো ছিলোই, এখন যুক্ত হলো ফৌজিয়া!!
নেক্সট পর্ব কি তাড়াতাড়ি দেয়ার জন্যে অনুরোধ করবো ভাই??
বোকা মানুষ
হা হা হা! ধারাবাহিকের মজাই তো এটা! নেক্সট পর্ব দুয়েক দিনের মধ্যেই পাবেন। 🙂