
পরম প্রিয় সাত ঋষি,
কেমন আছো আমাকে অভিশাপ দিয়ে?
আমার ডায়রির প্রতিটা খসড়াপাতা দিয়ে যাব পোষ্টমাস্টারের দরজায়। বলে দিব পৌছে দিতে তোমার ঠিকানায়। আমার মুখ দেখা যে তোমাদের হবে না তাই।
তোমাদের অভিশাপে এক মোহকালের ভারি বস্তু যেনো আমি।
এতো সুগন্ধ নিয়ে জন্মেও অযত্ন অবহেলায় পড়ে থেকে থেকে আজকাল আমি হাঁপিয়ে যাই বার বার দু’দন্ডকাল পার হতেই।
ভালবাসা, আবেগের সব শব্দমালা তৃণখণ্ডের মতো মোহোকাল ভেঙ্গে মুড়মুড় শব্দে উঠে আসে বার বার।
সেচ্ছায় অলিখিত মৃত্যুর স্বাদ আমি নিয়েছি বার বার।
লিখিত মৃত্যু তুলে রেখোছো তুমি। কেনো কি যে দুস্বহ দুর্বহতা এই মরেও বেঁচে থাকা! আবেগ অনুভূতির সমস্ত অনুভব মরে মরে আত্মারও মৃত্যু দিয়েছো, তবে কেনো যে পঞ্চভূতে মিশাচ্ছো না আমাকে!
আমার তরে এই লিখিত মৃত্যুর অভিবাদনটুকুও কি দিবে না?
তুমি তো জানো, লিখিত মৃত্যুর অভিবাদন আছে সেখানে অদেখা হা হুতাশ আছে। অলিখিত মৃত্যুর খাতায় অকারণ অভিবাদন পৌছায় না। প্লিজ আমার মুক্তি দেও,,,
নতুবা ঠিক ঠাক এক দিন তারিখই না হয় দেও। কবে হবে, আমার অভিশাপের মুক্তি?
মার্চ এপ্রিল মাসে আশীর্বাদের হাত নিয়ে আকাশের ঠিক মাঝ বরাবর বসে থাকো। স্পষ্ট ফুটে ওঠো। তোমাদের খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না এতোটুকু।
ধ্রুবতারাকে খুঁজতে গেলেই তোমাদের খুঁজে পেতে কষ্ট হয় না। এই যে তোমরা সাত ঋষি সপ্তর্ষি-বশিষ্ঠ, মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত্য আর ক্রতু কারো মনেই কি আমার জন্য এতোটুাকু দয়া হয় না? এতোটুকু আশ্রয় ঐ আকাশে মিটমিট আমিও জ্বলতে পারি।
কতো কতো অভিযোগের প্রশ্ন জমা রেখেছো ও বুকে তা শুধু তোমরাই জানো। তাই কি প্রশ্নবোধক আকৃতি করে রেখেছো নিজেদের?
এই আমি বনকেয়া,, আমারই তো কতো কতো অভিযোগ, অনুযোগ! সামান্য লঘুপাপে গুরুদন্ড দিয়েছো। সে গুরুদন্ডের ভার বইছি আমি অনন্তকাল অবধি। কিন্তু এই যে ঋষি বশিষ্ঠ তার পাশে অরুন্ধতী দেখো ভালবাসায় পরম যত্নে সগৌরবে বসে আছে। অস্পষ্ট হলেও তার অবয়ব খেয়াল করে আমি কিন্তু ঠিকই দেখে নিতে পারি। অরুন্ধতী ঋষি বশিষ্টের স্ত্রী তার প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী। কি যতনে, কতোটা প্রেমে আকাশেও তার বুকের বাম পাশেই আছেন।
অথচ এই আমি বনকেয়া সাদা বা সোনালী রূপে কেতকী, স্বর্ণপুষ্পী, পাংশুলা যে নামেই ডাকো তোমাদের অভিশাপে আজও পড়ে আছি গভীর অরণ্যে।
অনেক তো হলো, এবার তবে আশীর্বাদের হাতটি বাড়াও। মুখ তোলো। তোমাদের বিলাসী ও বাগানে কেয়া ফোটাও যতনে।
গভীর এ বনজ্যোৎস্নায় সবুজ বনে, একা একেবারে একা আমি
যেখানে শ্রবণ, স্পর্শ, দর্শণ একেবারে অপ্রত্যাশিত।
সেখানে,
মধুগন্ধভরা ভীতসন্ত্রস্ত মনে লুকিয়ে আছি আমি।
একাই ফুটি একাই ঝরে পড়ি
সুন্দরতর সোনালী কেতকী। আমি না হয় সোনালী কেতকীই বলি নিজেকে!
তোমাদের অভিশাপে দেবতার পৌরাণিক ভালবাসায় আমি যেখানে নিষিদ্ধ সেখানে মানবের সখের বাগান বিলাসে ঠায় পাওয়া,
বা
প্রিয় নিজস্ব আমার সে অবয়ব তার জন্য আমার, আমার জন্য তার বিলাসী কাজল প্রেম বড় বেমানান।
ঠান্ডা বরফ হীমশীতলে আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ের উঁচু স্থানে আমার বাস ছিলো।
আমি ফুটেছিলাম প্রচন্ড ভালবাসায়, শিবের আরাধনায়।
কিন্তু দেবতাদের পারষ্পারিক রেশারেশির ফলে আমি বার বার অভিশপ্ত হলাম, কখনো সীতার কখনো সাত ঋষি তোমাদের।
অভিযোগ উঠলো আমি শিবের প্রেমে মিথ্যে বলেছি। বা কখনো রামের গৌরব রাখতে মিথ্যে বলেছি তাই মিথ্যা বলার সে অপরাধে অভিশাপ দিয়ে দিলে আমায়। সুগন্ধি কেতকী হয়েও আমি শিবপূজায় নিষিদ্ধ হোলাম।
কোনো আরাধনায় আর আমার স্থান হলো না।
হিমালয়ে পেলাম তোমাদের অভিশাপ আর ফল্গু নদীর তীরে পেলাম সীতার অভিশাপ।
সীতার অভিশাপে অভিশপ্ত হলাম চুপ থাকার অপরাধে।
রাম সীতার বনবাসের সময় রাজা দশরথের মৃত্যু সংবাদে পুত্র রাম পুত্রবধূ সীতা মৃত্যুশোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে।
পিতার পিণ্ডদানে ব্যাকুল রাজা রামচন্দ্র ছুটলেন গ্রামে চাল ও ফলের আশায়। দেবতা হয়েও বুঝলেন না সংসার ইহলোক ছেড়ে গেছে যে পরলোকে তার তরে পিণ্ডদান বৃথা।
শোক আর অশৌচি নিয়ে সীতা একা জরাজীর্ণ দেহকে এলিয়ে দিলেন আমার ঝাড়ের পাশে।
আমার সুগন্ধ দিয়ে তাকে ভরিয়ে রাখলাম।
রামের অপেক্ষায় অপেক্ষায় সীতা অস্থির হলো পিণ্ডদানে কারণ, পিণ্ডদানের সময় চলে যাচ্ছিলো। উপায়ন্তর না পেয়ে সীতা ঝুলিতে থাকা একমুঠো চাল দিয়ে পিণ্ডদানের প্রস্তুতি নিলেন।
পিণ্ডদানে সীতা সফলও হলেন। রাজা দশরথ পিণ্ডদানে তৃপ্ত হয়ে ফিরে গেলেন।
পিণ্ডদানের সামগ্রী জোগাড় করে রাম ফিরে এসে প্রচন্ড তাড়া দিতে লাগলো সীতাকে।
সীতা পিণ্ডদান করে ফেলেছেন শুনে রাম অবিশ্বাসের সাথে তাকালো সীতার পানে। সীতা সাক্ষী করলেন আমায় ও ফল্গু নদীকে। আমরা চুপ ছিলাম কিছুই দেখিনি এমন। শুনেছি কিছু না বলা চুপ থাকা বোবার নাকি শত্রু নেই। স্বামী স্ত্রীর মান অভিমান মিষ্টি ঝগড়ার মধ্যে ঢুকব না এই ভাবনায় চুপ থাকলাম। নির্বাক দৃষ্টিতে সব দেখতে লাগলাম।
সীতাকে বিশ্বাস না করে পুনরায় পিণ্ডদানে ব্যস্ত রাম। সব তৈরি করে পিতাকে স্বরণ করতেই পিতা ধিক্কার দিলেন পুত্রকে।
কারণ, পুত্রবধূর পিণ্ডদানে তৃপ্ত পিতা। তবে কেনো আবারও পিণ্ডদান!
সত্য প্রমাণে সীতা তখন রাগে দুঃখে ক্ষোভে অপমানে আমায় অভিশাপ দিলেন।
যে কেয়ার সুবাসে শিব মোহিত হতো সে ফুলের আর পূজো নিবে না শিব।
এই ফুলে পূজো দিলে শিবই হবেন অর্ঘ্যদাতার সর্বনাশের কারণ। আমি নির্বাক সব মাথা পেতে নিলাম।
আমি পড়ে রইলাম আমারই চোখের নোনাজলে অবহেলায়।
হাজার বাক্যস্রোত আমার মন্থর হয়ে আসছে। আজ আর লিখছি না। অভিশাপের পাত্রী যতো, যদি তাদের তরে লিখিত মৃত্যুর দুয়ার খোলো কভু তবে সবার আগে আমি কেতকী সে পথের প্রথম পথিক হব। আমার এই বিনীতটুকু রেখো শুধু।
ইতি
কেতকী।
#আমার_লেখা_চিঠিপর্ব।
পৌরানিক কাহিনির উপর লেখা।
যদিও পুরানো লেখা কিন্তু ঠিক করলাম,, শুধু আমার ফেবু পেজ আর ব্লগেই সব লেখা প্রকাশিত।
১২টি মন্তব্য
হালিমা আক্তার
আবার পড়তে হবে। হাজিরা দিয়ে গেলাম।
রিতু জাহান
ধন্যবাদ আপু,,
রোকসানা খন্দকার রুকু
বাপরে! কি কঠিন ভাষা ভাই।।
চিঠি এমন করেও লেখা যায় তাহলে। সবটাতেই দেখছি সমান দখল।
অশেষ শুভকামনা🌹
রিতু জাহান
একসময় ব্লগে চিঠি লেখা হতো খুব।
চিঠি পর্বগুলো দারুন লাগে আমার। বলতে পারো আমার সবচেয়ে প্রিয় বিষয়।
ভালো থেকো রুকু।
সাবিনা ইয়াসমিন
মনে হলো চিঠির আদলে কেতকী আত্মকথা জানলাম।
হু, আগেও একবার পড়েছি। বলে নিই, আগেরটার চেয়ে এটা সহজ লাগছে। ঐ চিঠির কিছু কিছু অংশ খুবই দুর্বোধ্য লেগেছিল 😔
শুভ কামনা 🌹🌹
রিতু জাহান
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু,,
মেমনের বাবা এজন্য আমাকে বলে একটা লেখা বার বার পড়ে ঠিক করতে।
সংসার করব, তার পোলাপান পড়াব না লিখব পড়ব নিজে।
এখন থেকে বার বার পড়ে ঠিক করে তারপর প্রকাশ করব ভেবেছি।
বন্যা লিপি
মনে হলো বাল্মিকীর রামায়ণ। যদিও মহা ভারত, রামায়ণ পড়া এত সহজ না। আমি একবার নিয়েছিলাম হাতে, পড়ার চেষ্টায়,,,, দাঁত ভেঙে যাবার জোগাড় হয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো মাথার তারে জ্যামজট লেগে যাচ্ছে।
আপনি লিখে শান্তি পেয়েছেন। আর আমি শব্দগুলো পড়ে পড়ে তৃপ্তি নিলাম। বোঝাবুঝি থাকলো পাশের ঘরে।
রিতু জাহান
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু। ভালবাসা নিবেন।
আমি বাল্মিকীর আর্যবন্দনা, রামায়ন আর এদিকে বেদ, মহাভারত পড়েছি।
আমি পুরো খন্ড কিনেছি।
বাংলা সাহিত্যের আঁতুড়ঘর বলি আমি এসব বইকে।
এতো চমৎকার চমৎকার কাহিনি আছে,,
গ্রিক মিথ ও বেশ লাগে আমার।
মনির হোসেন মমি
প্রথমবার পড়ে মন্তব্য দিতে সাহস হয়নি তখনও এই পোস্টে কোন মন্তব্য জমা পড়েনি।এখন মন্তব্য জমা পড়লেও কারো মন্তব্যেই লেখাটির মুল ভাব পাইনি তাই অপেক্ষা কেউ যদি বলে দেয়…..
চিঠি এতো কঠিন যিনি পড়বেন তার চুল মাথায় থাকবে কিনা সন্দেহ আছে।
রিতু জাহান
হা হা,,,, চুলের যত্নের জিনিস আছে লেখকের কাছে শুনলাম।
ভালো থাকবেন মনির ভাই,,
হালিমা আক্তার
ডায়রির খসড়া পাতা পোস্ট মাস্টারকে না পাঠিয়ে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন। একটু পড়ে পড়ে চর্চা করে নেই। প্রথম বার পড়ে চলে গিয়েছিলাম। ভাবলাম নকল করা যায় কিনা দেখি। বাব্বাহ , বার কয়েক পড়ে ভাবার্থ বুঝে মন্তব্য করতে পারলাম না। তবে কিছুটা বুঝতে পেরেছি। যাই হোক আরো এরকম চিঠি চাই। ধন্যবাদ ও শুভকামনা রইলো।
রিতু জাহান
আপু,, দিয়েছি আবারও চিঠি।
পড়ে জানাবেন প্লিজ।
দেরিতে আসার জন্য মাপ চেয়ে নিচ্ছি। কুড়িগ্রামে গিয়ে গরমে কাহিল, মাইগ্রেনের ব্যাথায় মনে হচ্ছিলো এবার মনে হয় শেষ যাত্রা আমার।
শুভকামনা রইলো আপু।