পতঙ্গভুক পাখি ‘নীল শিলা দামা’

শামীম চৌধুরী ২৪ জানুয়ারি ২০২০, শুক্রবার, ১১:৫০:২৮অপরাহ্ন পরিবেশ ২৯ মন্তব্য

বিস্তীর্ণ জলরাশি। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। অনেক দূরে বিশালাকার পণ্যবাহী জাহাজ সমুদ্রের বুকে ভেসে আছে। কখনো কখনো স্পীডবোট বা ইঞ্জিনচালিত মাছ ধরার ট্রলারগুলো দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। তার পেছনে সাদা-কালো মিশেল রঙ্গের গাঙ্গচিলের ঝাঁক আহারের খোঁজে উড়ে যাচ্ছে। যেন হাত দিয়েই ধরা যাবে। দূরে একখণ্ড ভূমি সমুদ্রের মাঝে জেগে আছে।

আমরা হাঁটছি শুকনো দ্বীপ ধরে। জোয়ারের পানি একটু একটু করে আমাদের অস্তিত্ব গ্রাস করে নিচ্ছে। তখন সমুদ্রে জোয়ারের সময়। একপর্যায়ে পুরো দ্বীপ একবুক পানিতে ডুবে গেল। দেশি-বিদেশি পাখির কলতানে দীপ মুখরিত হয়ে উঠল। যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ। এটাই সোনাদিয়া দ্বীপ।

বার্ড বাংলাদেশ-এর আয়োজনে উপকূলীয় পাখি গণনার কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সম্প্রতি সোনাদিয়া দ্বীপে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে আমরা চারজন কক্সবাজার গিয়েছিলাম। কক্সবাজারে আমাদের সঙ্গে যোগ দেন বন্যপ্রাণি গবেষক ও ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফ এবং অভিনেত্রী ও ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফার ফারজানা রিক্তা। স্পীড বোটে সোনাদিয়া দ্বীপের কালাদিয়া চরে যখন পৌঁছলাম তখন সকাল ৯টা। যাত্রা পথের দু’পাশে হরেক প্রজাতির পাখি।

টিমের সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল ছবি তুলতে। এক পর্যায়ে  সমুদ্রের তীরে বালুর চরে বসেই শেষ করলাম দুপুরের খাবার। এরই ফাঁকে আদনান উখিয়ায় তার কুমিরের খামারে যাওয়ার অনুরোধ করলে আমরা রাজি হই। সোনাদিয়া দ্বীপে কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় কক্সবাজার ফেরত আসি। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে সন্ধ্যা সাতটায় আমরা দুটি সিএনজি অটো রিকশায় চেপে উখিয়ার পথে রওনা হলাম। রাত ৯টায় বাজল কুমিরের খামারে পৌঁছতে। আদনানের বাংলোতে পৌঁছার পর ঠিক হলো রাতে ইলিশ-বেগুন ভাজার সঙ্গে সবজি খিচুরির ব্যবস্থা হবে। আমাদের টিমের কিসমত খোন্দকার ভাই আগ্রহ নিয়ে খিচুরি রান্নার দায়িত্ব নিলেন। আর ফারজানা রিক্তা ইলিশ মাছ, বেগুন  ভাজার দায়িত্ব নিলেন। রাতের খাবার শেষে কিছুক্ষণ আড্ডা আর দিনের কাজ নিয়ে আলোচনা শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম আমরা।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আদনানের সঙ্গে বন্যপ্রাণী ও কুমির নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে ছবিও তুলি। সকালের নাস্তা শেষ করে বের হয়ে যাই বিশাল কুমির খামার দেখতে। বেশ কিছু পাখির ছবি তুলে রুমে আসি। আফজাল ভাই ও আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আফজাল ভাই বলেন, ভাই নীল শিলা দামা। পাখিটি প্রথমবারের মত দেখলাম। বেশ কিছু ছবি তুলে ফেললাম সঙ্গে সঙ্গে।

Blue rock thrush বা নীল শিলা দামা Monticola গোত্রীয় ২৩ সেমি দৈর্ঘ্যের ৫০ গ্রাম ওজনের ছোট আকারের পতঙ্গভুক পাখি। লেজ ডানার তুলনায় ছোট  ও পা লম্বা। নীল শিলা দামা শীত থেকে গ্রীষ্ম পর্যন্ত বাদামী থেকে নীল রঙের হয়। প্রজননকালে ছেলে পাখির পিঠ গাঢ় নীল-বেগুনী এবং ডানা ও লেজ কালচে বাদামী হয়। মেয়েপাখির দেহ নীলচে আভা ও কালচে ডোরা ও বাদামী থাকে। ডানা ও লেজ কালচে বাদামী। ঠোঁট বাদামী। পা ও পায়ের পাতা কালো। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারা ভিন্ন।

নীল শিলা দামা সাধারণত পাথরের ঢাল, পাথুরে নদীতট, খাঁড়া পর্বত বা খাঁদ, মুক্ত বন, পতিত জমি ও লোকালয়ে বিচরণ করে। সবসময় এরা একা থাকতে পছন্দ করে। গরমের সময় এরা লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। কিন্তু শীত মৌসুমে লোকালয়ে আসে। বাড়ির ছাদ, দেয়াল ও খুঁটিতে বসে এরা শিকার খোঁজে এবং মাটিতে নেমে শিকার ধরে। এদের খাদ্য তালিকায় রয়েছে পোকামাকড়, টিকিটিকি, ছোট ব্যাঙ, ডুমুর ও রসালো ফল। প্রজনন সময় এরা জোড়ায় থাকে।

এপ্রিল থেকে জুলাই মাস এদের প্রজননকাল। সেই সময় এরা শিলা, খাড়া পর্বত, গাছ বা দেয়ালের ফাঁটলে ঘাস, মূল ও চুল দিয়ে বাটির মত করে বাসা বানায়। নিজেদের বানানো বাসায় মেয়ে পাখি নীল বর্ণের ৩-৫টি ডিম পাড়ে। মেয়ে পাখি একাই ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটায়। পুরুষ ও মেয়ে পাখি মিলে বাচ্চাদের পরিচর্যা করে। ১৫-১৬ দিনে বাচ্চা বাসা থেকে উড়ে যায়।

নীল শিলা দামা বাংলাদেশের দুর্লভ পরিযায়ী পাখি। শীত মৌসুমে দেশের অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রাশিয়া, সাইবেরীয়া, ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল ও চীনে এদের দেখা যায়।

বাংলা নাম: নীল শিলা দামা

ইংরেজি নাম: Blue rock thrush

বৈজ্ঞানিক নাম: Monticola solitarius

 ছবিগুলি উখিয়া থেকে তোলা।

0 Shares

২৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ