
আমার পছন্দের পাঁচটি বইয়ের কথা বলি। প্রথমেই ওরহান পামুকের ‘ইস্তানবুল, একটি স্মৃতির শহর’। স্কেচধর্মী এই বইটা নানা কারণে ভালো লেগেছে। প্রথমত, গদ্যের বই হিসেবে এটি দুর্দান্ত। দ্বিতীয়ত, এই বইটা পড়লে ইস্তানবুল শহরটা ভিসা ছাড়া ঘুরে ফেলা যায়। স্থাপত্যের শহরে ঘোরাঘুরি সবসময় আনন্দদায়ক।আর একটা ব্যাপার হচ্ছে,―বইটা ওরহান পামুক এমনভাবে লিখেছেন, যেন চমৎকার একটা উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতা হয়। পড়ার পর তাই ঢেঁকুর ওঠে। মনে হয়, ইস্তানবুল শহরটা পৃথিবীতে ছিল না―এটা ওরহান পামুক নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সৃষ্টি করেছেন।
এরকম আর একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হচ্ছে আহমদ ছফার লেখা ‘যদ্যপি আমার গুরু’। এই বইটা মূলত একজন শিক্ষকের প্রতি ছাত্রের ট্রিবিউট। কিন্তু এর যে ব্যাপারটা আমার ভালো লাগে তা হলো স্টাইল। এটা প্রতিবারই ফ্রেশ। কোনো ভনিতা নেই। একেবারে সরাসরি। যেন আহমদ ছফা মাত্রই লিখে শেষ করেছেন। আমি ‘যদ্যপি আমার গুরু’ দশ-বারো বার পড়েছি এবং প্রতিবারই আহমদ ছফার গদ্যের মুনশিয়ানা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
মোঘল স্থপতি বাবুরের আত্মজীবনী পড়েও এরকম মুগ্ধ হয়েছিলাম। বইটার নাম ‘বাবুরনামা’। এই বইটা দারুণ একটা অভিজ্ঞতা আমার জন্যে। সাধারণত আত্মজীবনীগুলো যেমন হয়, বাবুরনামা তার থেকে একটু আলাদা। এটার শুরু হয়েছে, এভাবে―
‘শাবান মাসে সূর্য যখন কুম্ব রাশিতে আমি তখন কাবুল থেকে হিন্দুস্থান পানে যাত্রা করলাম। বাদাম চশমা ও জাগদালিকের পথ ধরে ছয় দিনের দিন আমরা আদিনাপুর এসে পৌঁছালাম। এর পূর্বে কোন উষ্ণ দেশ কিংবা হিন্দুস্থান দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
আদিনাপুর যখন এসে পৌঁছলাম তখন এক সম্পূর্ণ অভিনব জগতের দৃশ্য আমার চোখের সম্মুখে ভেসে উঠল। আমি দেখলাম এ জগতের ঘাস পৃথক, বৃক্ষরাজি পৃথক; এখানকার বন্যজন্তু আলাদা, এর পাখি আলাদা। এমনকি এ জগতের যাযাবর জাতি ইল এবং উলুসদের আচার আচরণও আলাদা।’
কাজেই বাবুরনামা আত্মজীবনী হলেও এটা মূলত ভিনদেশী এক মানুষের হিন্দুস্তান দেখার অভিজ্ঞতা। তিনি এখানে আনারস, তরমুজ এমনকি ময়ূরের মাংস খেতে কেমন তাও বর্ণনা করেছেন। আমি যে কয়বার বইটা পড়েছি, প্রত্যেকবারই বাবুরের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। একইসঙ্গে আমার মনে হয়েছে, বাবুরের নামের আগে ‘সম্রাট’ শব্দটা যুক্ত হওয়া কোনো ঘটনা না। যার এ ধরনের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা আছে―তিনি তো সম্রাট হবেনই।
আত্মজীবনী ঘরানার আর একটি বই আছে আমার পছন্দের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘জীবনস্মৃতি’। এখানে তার লেখালেখির পুরো জার্নি আছে। এর মধ্যে সঙ্গীত বিষয়ক প্রবন্ধগুলো তো খুবই দারুণ। তবে আমার কাছে ইন্টারেস্টিং লাগে জীবনস্মৃতির মেকিং। আঙ্গিকগত দিক থেকে এই বইটা অসাধারণ। চাবি লেখা জাতীয় যে রচনাগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন এর কোনো তুলনা হয় না। যারা সৈয়দ মুজতবা আলী বা হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার লেখাগুলো পড়েছেন, তারা বুঝতে পারবেন এই ধরনের লেখায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কী অসাধ্য সাধন করেছেন। বলতে বিব্রত লাগছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বড় ফিচারিস্ট ছিলেন।
আমার কাছে মনে হয়―ভালোমত জীবনস্মৃতির পোস্টমর্টেম করতে পারলে যে কারো পক্ষেই সহজে লেখালেখি করা সম্ভব। পড়ার সময় শুধু তিনি কি বলছেন না দেখে, কি করছেন তা দেখতে হবে। এখানে তিনি ‘শ্রীকণ্ঠবাবু’, ‘অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী’, ‘প্রিয়বাবু’, ‘রাজেন্দ্রলাল মিত্র’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ ও ‘শ্রীযুক্ত আশুতোষ চৌধুরী’ নামের যে রচনাগুলো লিখেছেন―খুশিতে, ঠ্যালায়, ঘোরতে এগুলো আমরা এখনো লিখে চলেছি।
চারটা বইয়ের কথা বলে ফেলেছি। এবার কিং অব হররের কথা বলা যাক। স্টিফেন কিং এর একটা বই আছে, ‘অন রাইটিং’। এটা তার বেশিরভাগ বইয়ের মত ভূতের গল্প না। ক্রাফট বিষয়ক রচনা। এই বইয়ের কথাবার্তাগুলো অনেকটা এরকম―‘An opening line should invite the reader to begin the story. it should say : Listen, Come in here. You Want to know more about this’.
আপাত দৃষ্টিতে অত্যন্ত কাটখোট্টা লাগতে পারে। কিন্তু এই বইটা অদ্ভুত। স্টোরি টেলিং, হিউমার আর বোঝাপড়ার দুর্দান্ত রসায়ন হলো ‘অন রাইটিং’। ভূতের গল্পের গ্র্যান্ডমাস্টার এখানে যা বলেছেন, বাংলা ভাষায় তার সারমর্ম হলো―বিড়াল শুধু বাসর রাতে নয়, লেখালেখিতেও মারতে হয়। কাজেই আসুন, বিড়াল মারি।
স্পেশাল মেনশন : সিপাহী বিদ্রোহের সময় মির্জা গালিব ফার্সি ভাষায় একটা ডায়েরি লিখেছিলেন। ‘দাস্তাম্বু’। ১৮৮৭ সালের মে থেকে পরের বছরের ২১ জুলাই পর্যন্ত ১৫ মাসের দিল্লি শহরের পরিস্থিতি দাস্তাম্বুতে আছে। সঙ্গে আছে মির্জা গালিবের বন্দী জীবন-যাপনের বর্ণনা।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হচ্ছে, এখানে ভাষা নিয়ে মির্জা গালিব রীতিমত ছেলেখেলা করেছেন। গদ্যের ক্লাস নিয়েছেন। এখানকার প্রতিটি শব্দ যেন একেকটি কোমল পাথর। যেন পৃথিবী মির্জা গালিবের পায়ের কাছে নতজানু হয়ে আছে। বলছে, গালিব, তুমি আমাকে আঘাত করো। আর তিনি উৎসাহ পেয়ে ব্লাড ডায়মন্ড সিনেমার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মত সবকিছু ভেঙ্গেচুরে ফেলছেন। তো, এখন পর্যন্ত এই হলো আমার পছন্দসমূহ। নিজের জন্য আমি এই বইগুলো পড়তে চাই।
জুলাই, ২০১৯
১৫টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অসাধারণ লিখেছেন নিজের ভালোলাগার অনুভূতি গুলো। জীবনী তেমন পড়া হয়না তবে এখন থেকে পড়ার চেষ্টা করবো আপনার উল্লেখিত লেখাগুলো। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। শুভ সকাল
নাজমুস সাকিব রহমান
আপনিও, সুস্থ থাকবেন। সুন্দর থাকবেন। আর অন্যদের জীবনী না পড়লেও আমার লেখা পড়বেন। হা হা। শুভেচ্ছা নেবেন।
জিসান শা ইকরাম
বুক রিভিউ ভালো হয়েছে।
অনেক দিন পরে লিখলেন, নিয়মিত লেখুন।
নাজমুস সাকিব রহমান
পেশাগত কারণে নিয়মিত পোস্ট দেয়া সম্ভব হয় না। লিখে ফেলে রাখি। দিন, মাস, বছর চলে যায়। তারপর মনে পড়ে, আরে ওই লেখা তো পোস্ট দেয়া হয়নি!
ভাল আছেন নিশ্চয়ই।
কামাল উদ্দিন
বুঝা যাচ্ছে আপনি অনেক বই পড়েন। এক সময় আমিও বইয়ের পোকা ছিলাম। প্রতম দিকে শরৎচন্দ্রের বইয়ের প্রতি জোক থাকলে পরবর্তিতে কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানাই আমার কাছে সব থেকে প্রিয় হয়ে উঠে। আপনার লেখনি পড়ে বাবুরনামাটা পড়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
নাজমুস সাকিব রহমান
বাবুরনামা চমৎকার বই। পড়তে পারেন। এটা বাংলা একাডেমি দুই খণ্ডে বের করেছিল। খোঁজ নিতে পারেন। ধন্যবাদ।
কামাল উদ্দিন
দেখি সময় সুযোগ পেলে চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ ভাই।
নাজমুস সাকিব রহমান
শুভেচ্ছা নেবেন।
তৌহিদ
বই রিভিউ ভালো লেগেছে। সবগুলিই পড়ার ইচ্ছে রইলো। তবে এত পুরোনা লেখা নয় আপনার কাছ থেকে আমরা নিত্যনতুন লেখা চাই।
ভালো থাকবেন।
নাজমুস সাকিব রহমান
তারিখটা মাথা থেকে ফেলে দিয়ে পড়েন। আর ১০০ বছর আগের লেখা হলেও আপনি যদি প্রথমবারের মত পড়েন, সেটা আপনার জন্য নতুন লেখা। আশা করি, বুঝতে পেরেছেন। শুভেচ্ছা নেবেন।
তৌহিদ
এই তারিখটাইতো গন্ডোগোল পাকিয়েছে ☺
তৌহিদ
তবে লেখাটি সোনেলার জন্য নতুন হলেও অনলাইনে আগেই এসেছে তাইনা? ফেসবুকে?
ভালো থাকবেন ভাই।
নাজমুস সাকিব রহমান
এটা ফার্স্ট পাবলিশড হয়েছিল দৈনিক আজাদীতে। তারপরে অনলাইন ..। আমার সব লেখাই পত্রিকায় প্রকাশিত। ব্লগে দেয়ার কারণ, আর্কাইভ তৈরির লোভ। মরে যাওয়ার আগে একটা ভালো আর্কাইভ তৈরি করে যেতে চাই। যাতে একজন হলেও আমাকে মনে রাখেন!
ফয়জুল মহী
বেশ ভালোবাসা ও শুভ কামনা আপনার জন্য।
সুরাইয়া পারভীন
বক রিভিউ পড়ে বই গুলো পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা রইলো। আর রিভিউ উপস্থাপন দুর্দান্ত।
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়